সংলাপের মাধ্যমে বিরাজমান রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান চেয়ে দেশের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। নেতা-নেত্রীরাও সংলাপের কথা বলছেন।
এই নিবন্ধটি লেখার সময়ও দেখলাম জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়েছেন। দল-মত নির্বিশেষে সবাই সংলাপের মাধ্যমেই চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের দাবি জানাচ্ছেন।
কিন্তু বিদ্যমান সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংলাপের সম্ভাবনা কতটুকু বা সংলাপের এজেন্ডা কী ও লক্ষ্য কী এ নিয়ে তেমন কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেই। আমাদের ধারণা দুই নেত্রী একসাথে বসলেই দেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যদি তা হয়েও থাকে সেজন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন তা আছে কিনা সেটিই বিবেচ্য। আর সে সদিচ্ছা থাকলে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানের জন্য সংলাপ অপরিহার্য নয়।
রাজনীতিতে এসময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শান্তিপূর্ণভাবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল করাই এ মুহুর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা। ক্ষমতার রদবদল মানে আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপির ক্ষমতায় আসা নয় আবার আওয়ামী লীগেরও ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকা নয়। কারণ, গণতন্ত্রে যদি বিশ্বাস করি তাহলে ব্যালটের শক্তির ওপর আস্থা রাখতে হবে। অন্য কোনো শক্তির ওপর আস্থা রাখলেই পা পিছলে পড়ার আশংকা থাকে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর যতটা না ক্ষতি হয়, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণতন্ত্র। তাই সংলাপের মূল বিষয় হতে হবে গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা ও রাষ্ট্রযন্ত্রে তার প্রতিফলন। একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমেই তা সম্ভব।
দেশের রাজনৈতিক সংলাপের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সাফল্যের নিদর্শন নেই বললেই চলে। সাফল্য তো অনেক পরের কথা, অতীতের সংলাপের উদ্যোগগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো রকম আস্থা পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারেনি।
১৯৯৪ সালে কমনওয়েলথ মহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা সংকট নিরসনে দুই নেত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি খুব একটা আশার আলো দেখতে না পেয়ে পাঠালেন তারই বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ানকে। নিনিয়ান অস্ট্রেলিয়ার গভর্ণর ছিলেন। বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংলাপ তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় তার কিছু অভিজ্ঞতাও ছিল।
নিনিয়ান অনেক চেষ্টা করার পর সমস্যা সমাধানে একটি ফর্মুলা তৈরি করেছিলেন। তিনি দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভার প্রস্তাব করেছিলেন যেখানে প্রধানমন্ত্রীসহ পাঁচ জন থাকবেন ক্ষমতাসীন দলের ও পাঁচ বিরোধী দলের। কিন্তু বিধি বাম! সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করছিল সে সময়ের বিরোধী দল, আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সংলাপ আয়োজনে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেলেন নিনিয়ানের মতো বিচক্ষণ কুটনীতিক।
সবকিছু ভেস্তে যাওয়ায় বিএনপি সরকার একদলীয় নির্বাচন করে। মাগুরার নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচন ইতিহাসে যেমন একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। আবার সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদেই পাস হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল।
সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিক্ত অভিজ্ঞতার সত্ত্বেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হয়েছিল। সে নির্বাচনের মাধ্যমেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী (বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের সরকার)সরকার ছাড়া দেশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের নজির নেই। ৯৬, ২০০১ ও ২০০৯- এ তিনটি নির্বাচন এ সাক্ষ্যই বহন করে। যদিও সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়কের পূর্বাপর ইতিহাস আমাদের জন্য সুখকর নয়। বর্তমান সরকার অবশ্য এটিকেই অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে।
একথা সত্য যে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ কোনো রাজনৈতিক সমাধান নয়। কিন্তু এছাড়া আমাদের কাছে আর কোনো রাজনৈতিক সমাধান ছিল না। ফলে সংবিধান সংশোধন করে অগণতান্ত্রিক বা ultra-Democratic এ বিধানটি জারি করা হয়েছিল তবে অধিকতর গণতন্ত্রের স্বার্থে আমাদের এ অগণতান্ত্রিক বিধানটি মেনে নিতেই হয়েছিল।
কিন্তু আমাদের দেশে কোনো বিধানই যে শেষ পর্যন্ত সুফল বয়ে আনে না তা আমরা দেখলাম বিচার বিভাগের রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথ কিছুটা সুগম হলেও বিচার বিভাগ হলো চরম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের শিকার। নির্বাচনকে নিরপেক্ষ করতে গিয়ে বিচার বিভাগ দলীয়করণ করে ফেললাম। গণতন্ত্রকে বিপদমুক্ত করতে অধিকতর বিপদের মধ্যে পতিত হলাম।
সে সময়ে নিনিয়ানের ফর্মুলা অমান্য করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ একটি পাল্টা ফর্মুলা দিল। তারা সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে অস্থায়ী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্বাহী করে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব করলো। সেই একই দাবিতে তারা সংসদ অধিবেশও বর্জন করলো। গণতন্ত্র সংসদে অবস্থান করতে পারল না। বিএনপিও সহনশীল হতে পারল না।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে একথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। গত কুড়ি বছরের রাজনীতি পর্যালোচনা করলে আমরা দেখবো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। শুধু স্থান-কাল-পাত্র ভিন্ন।
তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী নিনিয়ানের যে প্রস্তাব গ্রহণ করতে অপারগ হয়েছিলেন তিনি এখন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সে পথেই হাঁটছেন।
সংবিধানের ৫৭(৩) অনুচ্ছেদের বিধান মতে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার পদে বহাল থাকবেন । অর্থাৎ তত্ত্বাবাধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকার যে নামেই ডাকি না কেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার পদে আসীন থাকবেন। তাঁর অধীনেই হতে যাচ্ছে আগামী সংসদ নির্বাচন।
সংবিধানের এ বিধানটি পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে আবার অনেক দেশেই নেই। তাতে গণতন্ত্রের কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি। বর্তমান সরকার সে কথাটিই বলছে। তারা গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে চায় ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার হস্তান্তর চায়। কিন্তু সমস্যাটির কেন্দ্রবিন্দু হলো-আস্থার সংকট। রাজনীতিতে আস্থাহীনতা থাকলে কোনো ফর্মুলাই কাজ করে না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা স্বাধীনতার চার দশক পরেও গণতন্ত্রের পথকেই নির্ধারণ করতে পারি নি। কোন পথে গণতন্ত্র হাঁটবে আর কোন উপায়েই বা জনগণের ক্ষমতার হস্তান্তর হবে সে প্রশ্নের সুরাহাই আজো হয়নি।
সংলাপ হতে হলে সরকারকে আগে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা সংবিধান সংশোধন করতে সম্মত। কারণ, বিরোধী দলের মূল দাবি হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন না করা। সেটি বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সেটি যে ফর্মুলাতেই হোক না কেন। কারণ, প্রধানমন্ত্রী তাঁর উত্তরসূরী না আসা পর্যন্ত তাঁর পদে বহাল থাকবেন। প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদে বহাল রেখে বিরোধী দল নির্বাচন করবে কিনা সেটি আরো বড় প্রশ্ন। মন্ত্রিসভা বহাল থাকুক বা না থাকুক প্রধানমন্ত্রীকে স্বপদে বহাল রেখে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ নিলে অবশ্য সমস্যার সমাধান হতে পারে। বিরোধী দল তাতে সম্মত হলে তো আর সংলাপের দরকারই হয় না।
তবে নির্বাচনকালীন মধ্যবর্তী এ সরকারের নাম আমরা যা-ই দিই(অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক) এটি মূলত থাকবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন একটি সরকার। সংবিধান তাই বলছে।
কাজেই, সংলাপ করতে হলে সংবিধান সংশোধনে সরকারকে সম্মত হতে হবে ও সেই সাথে বিরোধীদলকেও তাদের গোঁড়মির পথ থেকে সরে আসতে হবে।
বিরোধটি এখানেই শেষ নয়, কারণ কেবল প্রধানমন্ত্রীই নন, অন্য মন্ত্রীরাও সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার পর স্বপদে বহাল থাকতে পারবেন। সংবিধানের ৫৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মন্ত্রীরাও থাকবেন তাদের পূর্বসুরী না আসা পর্যন্ত। নির্বাচনও করবেন স্বপদে বহাল থেকে।
৫৮(৪) অনুচ্ছেদটি ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি আরো নিশ্চিত করেছে।
এ বিধানগুলো কতটা গণতান্ত্রিক বা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে কতোটা সামঞ্জস্যপূর্ণ সে আলোচনা পরের কোনো এক লেখায় করবো।
তবে সংবিধানের ভাষ্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সংলাপের জন্য অনুকল তো নয়ই বরং পরস্পরবিরোধী। সংলাপের জন্য সংবিধানকে বিরোধীদলের জন্য অনুকূল ও বিরোধীদলকেও জনগণের ক্ষমতার উপর আস্থাশীল হতে হবে। তা না হলে সংলাপ করে আদতে কোনো ফায়দা হবে না। আর বাস্তবে তো সংলাপ করতে কোনো পক্ষই আগ্রহী নয়। এটি নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে স্পষ্ট।
এমনই একটি পরিস্থিতিতে মাননীয় স্পিকার সংলাপের উদ্যোগ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। অবশ্য এটিকে আগ্রহ না বলে সম্মতি বলাই ভালো। রাষ্ট্রের দ্বিতীয় অভিভাবক হিসেবে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য স্পিকারের একটি ইতিবাচক ভূমিকা সবাই প্রত্যাশা করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় স্পিকার প্রথমে সংসদে সংলাপ হলে তার উদ্যোগ নিতে সম্মত হয়েছেন। এটিই স্বাভাবিক ও তার এখতিয়ারভুক্ত। গণতন্ত্রে সংসদই সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
উল্লেখ্য, বাংলানিউজকেই তিনি প্রথম তার এই সদিচ্ছার কথা জানান।
কিন্তু চলমান রাজনীতি সংসদ থেকে শত যোজন দূরে। তাই স্পিকার এক রকম বাধ্য হয়েই সংসদের বাইরেও এ সংলাপের উদ্যোগ নিতে সম্মত হন। স্পিকার হিসেবে তাঁর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কিন্তু সন্দেহ, অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার রাজনীতিতে তিনজন নারী নেত্রী- মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও বিরোধীদলীয় নেত্রী কি আমাদের গণতন্ত্রের পালে হাওয়া দিতে পারবেন?
লেখক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর