এক.
সম্প্রতি লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা তারেক রহমান একটি সভায় জনসমক্ষে এসেছেন। ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে এ ছিলো এক আলোড়ন জাগানো খবর।
কারণ তারেক রহমান প্রকাশ্যে আসায় অনেকেরই কপাল খুলেছে, আবার কারো কপাল পুড়েছেও।
গত ২০ মে তারেক তার কর্মীদের সামনে আসেন। এতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন কর্মীরা। কিন্তু এ উদ্দীপনা বেশি সময় স্থায়ী হয় নি। কপাল-পোড়া কর্মীরা রুষ্ট হয়ে ওঠেন। শুরু হয় তাণ্ডব। লন্ডনের সেন্ট্রাল প্লাজা হোটেল যেন হয়ে উঠে বিশৃংখলা আর হট্টগোলের ক্ষেত্র।
শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ আসে। তারেককে সভার জায়গা বদল করে চলে যেতে হয় অন্যত্র। কারণ হোটেল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে পুলিশ এসে তাদের তাড়িয়ে দেয়। তারপর তারা ইস্ট লন্ডনের পাম ট্রি রেস্টুরেন্টে তাদের কর্মীসভা শেষ করে।
সেদিন থেকেই উচ্চারিত হচ্ছিলো যুক্তরাজ্য বিএনপি’র নতুন কমিটি গঠনের সংবাদ। কর্মীরা সেদিন তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিভাবে যুক্তরাজ্যে নিবেদিত প্রান বিএনপি কর্মীরা বাদ পড়ছেন, কিংবা কিভাবে অর্থের কাছে পদ বিক্রি হচ্ছে এসব প্রসঙ্গ পর্যন্ত খোদ তারেক রহমানের সামনেই উচ্চারিত হতে থাকে।
নর্থ-ওয়েস্ট ইংল্যান্ডের একটি আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্যেই এ কথাটি উচ্চারণ করেন। তারেকের কিছুই করার ছিলো না। তারা তাকে যেভাবেই হোক বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য কমিটির সঙ্গে পাল্লা দিতে একটা ব্যালান্সে যেতে হবে। অর্থ-বৈভবের পাশাপাশি অন্তত যুক্তরাজ্যের কিছু প্রতিশ্রুতিশীল এবং রাজনৈতিক দক্ষ নেতাদের সামনে আনতে হবে।
কিন্তু বিধি বাম ওইসব নেতার। অফিসিয়ালি না হলেও শেষপর্যন্ত একটি কমিটির খবর চাউর হয়েছে ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। এতে প্রধান নেতৃত্বে যাদের নাম এসেছে, তারা বৈভবে সমৃদ্ধ। সামাজিক মাধ্যমে আসা নতুন কমিটির সভাপতিকে অনেকেই বলছেন- তিনি যেন আরেক কমরুদ্দিন, যে কমরুদ্দিন একসময় আগলে রেখেছিলেন তারেক জিয়াকে। সাবেক এই প্রভাবশালী সভাপতির মৃত্যুর পর তাকে ব্রিটেনে তার ছায়া হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন তারেক রহমান।
দুই.
কথা হলো- তারেক রহমান জনসম্মুখে আসার পর যতটুকু প্রভাব পড়েছে ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে তার চেয়ে যেন ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছে দেশ। আওয়ামী লীগের নেতা কিংবা মন্ত্রীরা তারেক রহমানের বক্তব্য নিয়ে মন্তব্য করছেন প্রতিনিয়ত। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার- তারেকের বক্তৃতার পর যেন সরকার নড়েচড়ে উঠেছে। তার বিরুদ্ধে এর আগে আনীত অনেক মামলা পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে। মানি লন্ডারিং কিংবা অন্যান্য দুর্নীতি মামলাগুলো দিয়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রতিদিন তারেককে নিয়ে এই উচ্চারণে তাকে যেন সম্ভ্যাব্য প্রধানমন্ত্রীর খাতায় নাম লেখানো হচ্ছে। আর যা নিয়ে বিএনপি-ও বসে নেই। বিএনপি’র বর্তমান মুখপাত্র শামসুজ্জামান দুদুতো বলেই দিয়েছেন- ভাবী প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াবেন না।
আসলে দুদু ভুলেই গিয়েছেন, তারেকের ব্যাপারে এ সব প্রচার-প্রচারণা মূলত বিভ্রান্তি নয়, ফ্যাক্ট। এ নিয়ে কোন লুকচুরি হচ্ছে না। শুধু যে ব্যাপারটা সরকার করছে, তা হলো সরকার চাইলে ব্যাপারটা আগেই একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতে পারতেন। যেহেতু তারেকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা আদালতে প্রক্রিয়াধীন, সেহেতু এগুলোকে আইনের ধারাবাহিকতায় রাখাই উচিৎ ছিলো। তারেক জিয়ার ২০ মে’র বক্তৃতাটি কমিউনিটিতে কোনই ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে নি, বরং একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে। কারণ, যেভাবে তারেককে নমঃ নমঃ করে বক্তৃতা দেন কর্মীরা, সে হিসেবে এমনকি ব্রিটেনের কর্মীদের কাছেও যে তিনি ধোয়া তুলসীপাতা নন, তার প্রমাণ সেদিনের সেই হট্টগোল কিংবা মারামারি। কিংবা দু-একজন নেতার সাহস দেখানো, যারা ঠিকই বলতে পেরেছেন বিএনপি’র কমিটি কিংবা নেতা নির্বাচন অর্থে বেচা-কেনা হয়। আমার মনে হয়, তারেক কিংবা তার এই ‘অতি জনপ্রিয়তাকে’ই (অন্তত ব্রিটেনে) সরকার তুলে ধরতে পারতো। তার কারণে ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে, এটা সংবাদমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচার করতে পারতো। তার কিংবা তাদের রাজনৈতিক সহিংসতায় এমনকি ব্রিটেনের মতো দেশে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কার্যকলাপ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এটা প্রচার করতে পারতো। তা না করে এ ঘটনার পরপরই তার উপর থাকা মামলাগুলোর আইনি প্রক্রিয়া জোরদার করাতে কিছুটা হলেও এ প্রক্রিয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেলো।
অন্যদিকে তারেককে দেশে ফিরিয়ে নেওয়াটা সহজ হবে বলেও মনে হয় না। কারণ এখানকার বিচারিক প্রক্রিয়ায় ব্রিটিশ সরকার পর্যন্ত হতাশায় ভোগে। খোদ ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উদ্যেগী হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী সন্ত্রাসী হিসেবে বহুল আলোচিত আবু কাতাদ-কে তার দেশ জর্ডানে পাঠানো সম্ভব হয় নি। দীর্ঘ বারো বছর ধরে তিনি ব্রিটেনেই আছেন। সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পর্যন্ত এ নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলছে। সুতরাং রাজনৈতিক আশ্রয়ী কাউকে এ দেশের আদালত আশ্রয়গ্রহণকারীর দেশে যে ফেরত পাঠাবে না, তা ধরেই নেওয়া যায়। অন্তত দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন না হলে তারেককে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না, এটা বলা যায়। ব্রিটেন সরকারও আদালতের বাইরে কোন কিছু করার মতো শক্তিও রাখে না। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারের এ বিষয়ক হম্বি-তম্বি থেকে সরে দাঁড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
তিন.
তারেক রহমান গতানুগতিক রাজনীতির কথাই বলেছেন। তিনি ব্রিটেনে তার কর্মীবাহিনীকে স্থানীয় এমপিদের সঙ্গে লবিং করার আহবান জানিয়েছেন। অর্থাৎ প্রকারান্তরে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের একটা চিত্র তুলে ধরতে। নিঃসন্দেহে সরকারের এ চিত্র কোন ভালো চিত্র নয়।
ক’বছর ধরে নির্বাসিত জীবনে থাকায় তারেক অন্তত একটা ব্যাপার বুঝে নিয়েছেন, তার মা খালেদা জিয়া কিংবা তিনি সরকার সরাতে পারবেন না।
বিএনপি’র আন্দোলন-সংগ্রামে মৌলবাদীদের উপর নির্ভরশীলতা, পৌণপুনিক হরতাল-অবরোধ কিংবা অগ্নিসংযোগ প্রভৃতিতে বাংলাদেশ এখন ধূমায়িত। শৃংখলিত আন্দোলনের পথ তারা এখন আর চেনে না। তাইতো সরকার পতনের সম্ভাবনাও সুদুর পরাহত। মহাজোট সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করবেই। এটা হয়ত তারা মেনে নিয়েছে।
তারেক রহমান জেনে গেছেন, আন্দোলন সরকার পতনের প্রধান কোন পথ নয়। জনগণ দিয়ে সরকার নামানো যাবে না। তিনি লন্ডনের জনসভা থেকেই বুঝে নিয়েছেন, তার কর্মীরা কিভাবে পদ আর ব্যবসা নিতে সহিংসতায় মেতে উঠে।
কি একটা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই যেন হাঁটছেন তারেক। ব্রাসেলসে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট। ঘন ঘন ব্রাসেলস যাচ্ছেন তিনি। ২০ মে’র বক্তৃতার আগেও তিনি গিয়েছিলেন সেখানে, পরেও গেছেন। রাজনীতিতে পাকাপোক্ত হতে তাঁর সময় লাগতে পারে ঠিকই, কিন্তু জামায়াতীদের সঙ্গে যোগসাজস করে অর্থ বিলানোর প্রক্রিয়া জানতে তার বেগ পেতে হবে না। কারণ ব্যবসা ধরতে পটু ইউরোপীয়ানরা। সুযোগ পেলে ব্রিটিশ কিংবা ইউরোপীয়ানরা ব্যবসা ছাড়বে না।
এমপিদের সঙ্গে লবিং করার বিষয়ে তিনি বলেন, বার বার যেন ইউরোপীয়ান এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টারিয়ানেদের সঙ্গে তার কর্মীরা বৈঠক করেন। বার বার মতবিনিময় করে তারা যেন জানিয়ে দেন বাংলাদেশের কথা।
বার বার তাদেরকে বলা হলে তারা না-কি এক সময় সব বিশ্বাস করবে।
কিন্তু পশ্চিমারা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধার ধারে না। তাদের সামনে আন্তর্জাতিক রাজনীতিটাই প্রধান, ব্যবসাটাই মুখ্য।
আর তাদেরকে বলতে হয় না, বাংলাদেশে কি ঘটছে। পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়, এমনকি মুঠো ফোনে। সেজন্যেই বলি, তারা বিএনপি সরকারের আমলটাও জানে। সেসময়েই তাদের হাইকমিশনারকে(ব্রিটিশ) বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। সেসময়েই একুশে আগস্ট হয়েছে। তাদের সময়েই জেলায় জেলায় বোমা ফুটেছে। সুতরাং লবিং করে বর্তমান বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরা মানে ব্রিটিশদের কাছে সেই বিভীষিকাময় অতীতকেই স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
চার.
তারেক রহমান যা-ই করুন না কেন, তিনি শান্তভাব দেখিয়ে যেভাবেই বক্তৃতা দেন না কেন, তার বক্তৃতায়ই প্রমাণ হয়েছে, তার দল শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে ক্রমশঃ। আর সেজন্যেই ব্রিটিশদের কাছে ধর্ণা দেওয়ার আবদার।
আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই- ক্ষমতার পালাবদল জনগণ দিয়েই হয়। জনগণই নির্ধারণ করবে দেশের দায়িত্বভার কার হাতে যাবে। আর যদি সেই বিশ্বাস তারেক রহমানে না থাকে, তবে কেন-ই-বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন কিংবা নির্বাচনের জন্যে রাজপথে রক্তের হোলিখেলা কিংবা হরতাল-অবরোধ দিয়ে মানুষের জনজীবন অতীষ্ঠ করে তোলা?
ফারুক যোশী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক: Faruk.joshi@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৯ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১৩
জেডএম/