ঢাকা: জাতীয় বাজেট বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ‘মানবাধিকার’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে প্রয়োগ করা হয়। কারণ রাষ্ট্র নাগরিকের সুনির্দিষ্ট কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাজেট প্রণয়ন করে না বরং বাজেটের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে নাগরিকের ‘মানবাধিকার’ ধারণাটির সঙ্গে যা কিছু সংশ্লিষ্ট তারই একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে।
কিন্তু তারপরও মানবাধিকার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কয়েকটি বিষয়ের দিকে এই নিবন্ধটির আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। প্রথমেই দৃষ্টি দিতে চাই ‘প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন’ সম্পর্কে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের দিকে। মন্ত্রী বলেছেন, দুর্নীতি দমন ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এবং দুর্নীতি ও সুশাসনের ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেছেন।
কিন্তু বর্তমান জোট সরকার সবচেয়ে সমালোচিত হয়েছে দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার জন্যই। দলের প্রান্তিক কর্মী থেকে শুরু করে সরকারের অংশীদারদের কারো কারো নামও এক্ষেত্রে উঠে এসেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। ব্যাস্টিক পর্যায়ের কেলেঙ্কারি সরকারকে নানাভাবে বিব্রত করেছে, পাশাপাশি সামষ্টিক পর্যায়ে দুর্নীতির লাগামও টেনে ধরতে পারেনি তারা। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে দুর্নীতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সততা ও নিষ্ঠা এক্ষেত্রে তেমন কোনো কাজে আসেনি।
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন দৃশ্যমান নয়। যদিও এ দু’টো ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে ও একক রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ হয়েছে।
দুর্নীতি দমন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে পুরোপুরি সফল বা ব্যর্থ কোনোটিই হয়তো বলা ঠিক হবে না। কারণ এ ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার কমতি ছিল না। কিন্তু control ও monitoring phase- এ সরকার প্র্রশ্নবিদ্ধ।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বড় উদ্যোগ এটি। কিন্তু এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘ই-গভর্নেন্স’ চালুর উদ্যোগ নিলেও তা পুরোপুরি সফল ও কার্যকর করা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে ২০০৯ সালের ‘জাতীয় আইসিটি আইন ও নীতিমালা’ ও ২০১১ সালের ‘আইসিটি ট্রাস্ট আইনই’ বড় উদ্যোগ। যার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ন্ত্রণ।
রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখনো এর আওতায় আনা যায়নি। যেগুলোকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে সেগুলোও জন চাহিদা মেটাতে পারছে না। আর অর্থমন্ত্রী যে সাফল্যগুলোর ফিরিস্তি দিয়েছেন তার বেশির ভাগই অর্জিত হয়েছে প্রাইভেট সেক্টরে। এক্ষেত্রে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল না।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি সন্তোষজনক। শিক্ষার বিস্তৃতির জন্য সরকার সাফল্যের দাবিদার। ২৬ হাজারেরও বেশি প্রাথমিক ও কমিউনিটি বিদ্যালয় জাতীয়করণ সরকারের জন্য বড় একটি বিনিয়োগ। এছাড়া ঝরে পড়া ৭ লক্ষাধিক শিশুকে ২২ হাজারেরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
খাদ্য নিরাপত্তায় বর্তমানে আমরা স্থিতিশীল। তবে ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও বজায় রাখতে করণীয় বিষয় নিয়ে তেমন কোনো দিক নির্দেশনা বাজেটে নেই। সরকার খাদ্যগুদামের সংখ্যা বৃদ্ধিতে যতটা তৎপর ও সফল, ভবিষ্যতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সেরকম পদক্ষেপ নেই। কিন্তু আগামী দিনে সরকারকে খাদ্যের অধিকার মোকাবেলায় অনেক শক্তি বিনিয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে আর্থিক বিনিয়োগকে কার্যকর করতে হলে উপযুক্ত কৌশল প্রণয়নের বিকল্প নেই।
সরকার ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি, ২০১১’ ও ‘জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ,২০১২’ প্রণয়ন করেছে সত্যি, কিন্তু এ নীতি বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে না পারলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এই খাতে ভৌত-অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও জনগণের স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধি পায়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার যে সাফল্যের দাবি করেছে সেটি একেবারেই গৌণ। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড গঠন ও ঝড়-তুফান হলে মোবাইলের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে মানুষকে সাইক্লোন শেল্টার সেন্টারে যেতে বলা জলবায়ু মোকাবেলার মূল বিষয়বস্তু হতে পারে না। দুর্যোগ প্রশমন ও আশ্রয় কেন্দ্র বা ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদী পদক্ষেপের কথা নেই। Climate Chang Trust Fund- এর আওতায় সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে উপকূলবর্তী অঞ্চল রক্ষা করা। সে বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই।
২০০৯ এর Climate Change Strategy and Action Plan- অনুযায়ী কাজের কোনো অগ্রগতি নেই। এছাড়া দেশে বনায়নের যে দাবি (১৭.০৮ শতাংশ এলাকা) করা হয়েছে তা কাগজেই আছে, বাস্তবে নেই। ক্রমবর্ধমান মরুকরণ, বৃক্ষ নিধন ও বন-উজার এ সাক্ষ্যই বহন করে।
পরিবেশ দূষণ রোধে বড় বড় প্রজেক্টের কথা বলা হলেও (চামড়া ও পোশাক শিল্পে ইটিপি) সামগ্রিক পরিবেশ দুষণ রোধে উদ্যোগের কথা বলা হয়নি। ২০১৫ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ ভূমি বনায়নের আওতায় আনার যে কথা বলা হচ্ছে তার কোনো নজিরও বাস্তবে নেই।
শ্রমখাতে সরকার গত চার বছরে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারগুলো আমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়েছে। কাজেই নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করতে হয়েছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রক্রিয়া আরো বেগবান করতে হবে।
তবে ১৯৮২ সালের ইমিগ্রেশন অর্ডিন্যান্স বাতিল করে নতুন আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
প্রবাসী শ্রমিকদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে দূতাবাসগুলোকে ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালে যে ২১ লক্ষাধিক জনশক্তি বিদেশে পাড়ি দিয়েছে তাদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ ২০১২ সালে ১৪.১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ রেমিটেন্স জিডিপির ১১ শতাংশ, বৈদেশিক সাহায্যের ৬ গুণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ১৩ গুণ। কাজেই প্রবাসী শ্রমিক অধিকার রক্ষায় ও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে আরো বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিদ্যমান ৩৫টি ও বাস্তবায়নাধীন ৩৮টি প্রশিক্ষণকেন্দ্র যেন কেবল প্রকল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, সেদিকে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। এছাড়া অভিবাসন ব্যবস্থায় ডিজিটালাইজেশনের যে কথা বলা হয়েছে সেটি বাস্তবায়িত হলে এক্ষেত্রে সুশাসন ও উন্নত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হবে।
নারী ও শিশুদের জন্য সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়নের কথা বললেও এক্ষেত্রে আইন ও নীতি প্রণয়ন ছাড়া আর কোনো অর্জন চোখে পড়ে না।
যদিও ‘জাতীয় নারী নীতি, ২০১১’, ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০’, ‘জাতীয় শিশু নীতি, ২০১১’ ইত্যাদি প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়গুলোও জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করছে। কিন্তু এ প্রতিশ্রুত বিষয়গুলো বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে তেমন উদ্যোগ নেই। জেন্ডার বাজেটে প্রস্তাবিত ৮০ কোটি টাকা খুবই অপ্রতুল। এটিকে আরো বর্ধিত করা প্রয়োজন।
দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উন্নয়নে বাজেটে কোনো আশার বাণী নেই। সড়ক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে এবারের বাজেট। হিজড়া, দলিত, হরিজন ও বেদে সম্প্রদায়কে সমাজের মূলস্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার সরকারি উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এক্ষেত্রে ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা প্রাথমিক বিনিয়োগ হিসেব একেবারে কম নয়।
অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনের জন্য সরকার ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পন (সংশোধন) আইন, ২০১২’ ও ‘অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তি বিধিমালা, ২০১২’ প্রণয়ন করেছে।
কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে এ আইনের সুফল পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। জেলা ট্রাইব্যুনালগুলোকে আরো কার্যকর ও সক্রিয় করা প্রয়োজন।
তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সরকার ১৩ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু এতে নাগরিকদের তথ্যের অধিকার নিশ্চিত হয়নি। কারণ তথ্যদাতাদের সচেতনতা এক্ষেত্রে বড় বাধা। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রাপ্তি ওপরওয়ালাদের আশীর্বাদ ছাড়া মেলে না।
এছাড়া আইন ও বিচার খাতে লক্ষ্যণীয় কোনো বিনিয়োগ এবারের বাজেটে নেই। আশা করি সংশোধিত/সম্পূরক বাজেটে আইন ও বিচার খাত যথাযথ গুরুত্ব পাবে। আইনের শাসন নিশ্চিতে এই খাতে প্রচুর রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রয়োজন।
আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার তথা গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় বাজেটে এ বিষয়গুলোর যথাযথ প্রতিফলন থাকা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৭ ঘণ্টা, জুন ০৭, ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস ও রাইসুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর