মা-মাটি মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালবেসেছিলেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই যুক্ত হয়েছিলেন মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।
কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী একাত্তরের ঘাতকচক্র তাঁকে বেশিদূর এগোতে দেয়নি। ১৯৮৫ সালের ১১ জুন নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। সঙ্গে ছিল তাঁর বড় ছেলে, ঘাতকেরা তাঁকেও রেহাই দেয়নি। একই সঙ্গে পিতা ও পুত্রকে তারা হত্যা করেছিল।
বঙ্গবন্ধুর একান্ত ঘনিষ্ট সহচর বীর মুক্তিযোদ্ধা এখলাসউদ্দিন আহমেদ তাঁর বড় ছেলে এহসানুল হক টুলূকে নিয়ে নড়াইলের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেলেন। কালিয়ার বেন্দার চরের বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলযোগে যাত্রা করেন। তখন সকাল সাতটা। ঘাতকেরা আগে থেকে ওঁৎ পেতে বসে ছিল। বারুইপাড়া খেয়াঘাটে আসতেই তাঁদের ওপর নির্মম ভাবে গুলি ছোড়া হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান পিতা ও পুত্র। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ঘাতকচক্র নড়াইল-কালিয়ার জনগণের কণ্ঠস্বরকে সরিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাদের কায়েমী স্বার্থ।
১৯৩২ সালের ১০ জানুয়ারি শহীদ এখলাসউদ্দিন আহমদের জন্ম। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অস্তবেলায় বিকাশিত তাঁর কৈশোর। ব্রিটিশরা গেল। শুরু হলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের আর এক নয়া ঔপনিবেশিক শাসন। নানা দিক দিয়ে পাকিরা বাঙালীদের দমিয়ে রাখতে চায়। দীর্ঘদিন ধরে তাদের অপশাসন টিকিয়ে রাখতে তারা এদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। এজন্য শুরু হয় ভাষার ওপর আক্রমণ।
কিন্তু বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা এ আক্রমণকে বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেয়নি। তারা প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ গুঁড়িয়ে দিতে পাকি শাসকচক্র ছাত্রদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে। এর ঢেউ আছড়ে পড়ে দেশের প্রত্যন্ত আঞ্চলে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকা নড়াইলের কালিয়ায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। শহীদ দিবসের মহা তরঙ্গে এখলাস উদ্দিনও তরঙ্গায়িত হন। ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকি শাসকদের নানা ধরনের বৈরী অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তাঁর তখন থেকে শুরু। ধীরে ধীরে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করেন।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনের একজন নেপথ্যচারী সংগঠক, ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন প্রভৃতি ঐতিহাসিক ঘটনাতরঙ্গে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের সঙ্গে থেকে তিনি নিজেকে এক অন্যরকম বিশিষ্টতায় দাঁড় করান। হয়ে ওঠেন জননন্দিত। আসে ১৯৭১ সাল। বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের কাল। কালিয়ার এই বীরসন্তান ও সেদিন ঘরে বসে থাকেননি। তিনি জেলা পর্যায়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তিনি ছিলেন যশোর জেলা সংগ্রাম পরিষদের একজন সদস্য। পাঁচ সদস্যের এ কমিটিতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন মশিউর রহমান, সোহরাব হোসেন, রওশন আলী এবং মোশারফ হোসেন। ৩ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি যশোর শহরে ছিলেন। তারপর নড়াইল, কালিয়া লোহাগড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি বয়রা যুদ্ধশিবিরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলার দামাল ছেলেদের অসম সাহসিকতার সুবাদে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখলাসউদ্দিন আহমদ নড়াইলের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
নড়াইলের উন্নয়নে তিনি তাঁর সকল ভাবনা কেন্দ্রীভূত করেন। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর তিনি নানারকম হেনস্থার শিকার হন। তাঁকে কারা অন্তরীণও করা হয়। জনগণের অপার ভালবাসায় তিনি ১৯৭৭ সালে কারাগারে থেকেই কালিয়ার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারচক্র তাঁকে কখনও স্বস্তিতে থাকতে দেয়ানি। তাঁকে সর্বদাই ঘায়েল করার সুযোগ খুঁজেছে। এক পর্যায়ে সেই সুযোগ তারা পেয়েও যায়। তাঁকে তারা ১৯৮৫ সালের ১১ জুন নির্মমভাবে হত্যা করে। কিন্তু এলাকাবাসী আজও তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
রিফাত বিন ত্বহা, সম্পাদক, দেশকথাটোয়েন্টিওয়ান.কম
tohanewsjk@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪ ঘণ্টা, জুন ১০, ২০১৩
এনএস/