ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কান্নার প্রতিশব্দ আশরাফুল!

রুবেল আবিদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৬ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৩
কান্নার প্রতিশব্দ আশরাফুল!

ঢাকা: আগের দিনও আকাশে উজ্জ্বল রোদ ছিল। রাতের আকাশ জুড়ে জ্বলজ্বল করে তারারা তাকিয়ে ছিল।

মন ভালো করা মৃদু বাতাসও বইছিল। জৈষ্ঠ্যের রাতে বসন্তের আঁচ নিতে নিতে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। পরের দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙল অন্য এক আবেশ নিয়ে। মাথার কাছে যে খোলা জানালা দিয়ে রাতের উজ্জ্বল আকাশ দেখছিলাম, সেই আকাশ আমার কাছে ভিন্ন রূপে আবির্ভূত। মেঘের ভারে গম্ভীর। মনে হচ্ছিল কেউ যেন মুখ ভার করে বসে আছে। একটু পরেই কেঁদে ফেলবে।

হয়ত কাকতাল হবে। আগের রাত আর ৩১ মের সকালের তুলনা করতে গিয়ে আমার প্রথমে মনে পড়ল বর্ষায় ইংল্যান্ডের আকাশ আর বাঙালি নারীর মনের কথা। এই বৃষ্টি, এই রোদ। কখনো গোমড়া মুখ, কখনো হাসিতে উজ্জ্বল। ক্রীড়া সাংবাদিকতা করি বলেই হয়ত এই দুটোর সঙ্গে নিজের অজান্তেই তুলনা করে ফেলি ক্রিকেটে চিরকালিন অননুমেয় কোনো দলের পারফরম্যান্সের সঙ্গে। পাকিস্তান চিরকালিন অননুমেয় দল এ ছাড়া আর কোনটি!

মানুষের মন বলে কথা। দূর আকাশে অকল্পনীয় গতিতে ছুটে চলা রকেটের চেয়ে দ্রুত দৌঁড়ায়। আমার মন তখন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ছুঁয়ে ফেলল মোহাম্মদ আশরাফুলকে। নিজের প্রতিভার কানাকড়িও বুঝতে না পারা বাংলাদেশের এই ব্যাটসম্যানটিও যে চিরকালিন অননুমেয় এক পারফরমার। বিছানায় শুয়ে শুয়েই এসব ছাইপাশ ভাবছিলাম। মেঘলা সকালে আরেকটু ঘুমিয়ে নেয়ার লোভটা সামলে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার তাড়া ছিল। অফিসের চিন্তায় ভাবনার জগতে ছেদ পড়ল।

খুব বেশিক্ষণ অবশ্য নয়। বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে আবার অলসভাবে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। আবার আশরাফুল-ভাবনা পেয়ে বসল মনকে। ছেলেটা যে কী! কেন যে নিজেকে চিনতে পারে না? ও কী কখনোই সেটা পারবে না। এত মানুষের ভালো লাগা আর ভালোবাসার মূল্য বুঝে সেটা কী কখনোই শুধতে পারবে না!! কতবার এসব ভেবেছি। ভালো খেলতে খেলতে হঠাৎই বোকার মতো কোনো শট খেলে আশরাফুলের আউট হয়ে যাওয়ার পর ভেবেছি। ম্যাচ রিপোর্ট লিখতে লিখতে অবচেতন মনে ভেবেছি। আর ভেবেছি নিজের একান্ত অনেক সময়েও।

আশরাফুলকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে চোখের কোনে চিকচিকে একটু জলও এলো। বুঝলাম ও খারাপ খেললে মনে মনে খুব বকাঝকা করি। আগে পত্রিকায় কড়া ভাষায় লিখতাম। এখন টেলিভিশনে কড়া কন্ঠে সমালোচনা করি। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে  চোখ থেকে জলের ফোটা সরাতে সরাতে বুঝলাম ভোলা-ভালা এই ছেলেটিকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি বলেই এমনটা করি।

এই ভালোবাসায় ছেদ আনল বেরসিক মোবাইল। কর্কশ শব্দে বেজে উঠল পাশের টেবিলে রাখা ফোনটি। এবার ঘুম আর অলসতাকে বিদায় বলে উঠতেই হলো। ভাবছিলাম, বসই হয়ত ফোন করেছে। হয়ত বলবে রুবেল, একটু জলদি করে অফিসে যাও। শুভ (মাঝহারুল আমিন শুভÑআমার এটিএন নিউজের সহকর্মী) একা সকালটা সামলাতে পারবে না। কিন্তু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি না বাবু ভাইয়ের (মাহাবুব আলম খানÑএটিএন নিউজের স্পোর্টস ইনচার্জ) ফোন নয়। অপরিচিত একটি নম্বর রিং করে যাচ্ছে আমার মোবাইলে। প্রথমবার ফোনটি ধরতে পারলাম না। আবার বেজে উঠল। ফোনটি ধরলাম।

ওপার থেকে প্রথমে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। প্রায় আধা মিনিট ফোনের ওপারের কন্ঠটি কেঁদেই চলল। আমি কান্না শুনলাম। প্রশ্ন করলাম কে? ওপার থেকে ভেসে এলÑ ভাইয়া, আমি তন্বী। বুঝলাম আমার ছোট শ্যালিকা। জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো কাঁদছো কেন? মনে হলো এই প্রশ্নে কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল। এর পর কাঁদতে কাঁদতেই ভেঙে যাওয়া গলায় ও বললÑভাইয়া এটা সত্যি না, কিছুতেই সত্যি না। তাই না?

আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। কী সত্যি নয় তন্বী? ও উত্তর করলÑকেন, তুমি জানো না? তুমি তো সাংবাদিক। আজ একটি দৈনিক যে লিখল, আশরাফুল স্পট ফিক্সিং করেছে।

মোহাম্মদ আশরাফুল, বাংলাদেশের ক্রিকেটে চিরকালই এক কান্নার নাম। ব্যাট হাতে যতবারই মাঝের ২২ গজে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন; বাংলাদেশের এই লিটল জিনিয়াস তার ভক্ত-সমর্থকদের ততবারই মনে হয় কাঁদিয়েছেন। কখনো কাঁদিয়েছেন এ দেশের ক্রিকেটকে অদ্ভুতসুন্দর কিছু উপহার দিয়ে, কখনো কাঁদিয়েছেন চরম ব্যর্থ হয়ে।

২০০১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অনিন্দ্যসুন্দর এক ইনিংস উপহার দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট রোমান্টিকদের চোখে জল এনেছিলেন আশরাফুল। চামিন্ডা ভাসের বাঁহাতের গতির কারুকাজ আর মুত্তিয়া মুরালিধরনের ডান হাতের ঐন্দ্রজালিক ঘূর্ণিতে পুরো ক্রিকেট বিশ্বই যখন মোহিত, বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানরা পতিত; শ্রীলঙ্কার এই দুই মহারথীকেই তখন মোহে ফেলে দিলেন ১৭ বছরের বালক আশরাফুল। ভাসের আগুনের গোলাকে পাত্তাই দিলেন না। মুরালিধরনের ইন্দ্রজাল কাটলেন তার হাতের সোলেমানি তলোয়ার দিয়ে। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে অভিষেক টেস্টেই সেঞ্চুরি করে গড়ে ফেললেন সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান হওয়ার রেকর্ড।

এর পর বাংলাদেশের ক্রিকেটে আরও কত মহাকাব্য রচনা করেছেন তার হাতের ব্যাট দিয়ে। টানা ৪৭টি ওয়ানডে জয় না পাওয়া বুভুক্ষু বাংলাদেশকে জয়ের মুখ দেখালেন তিনি ২০০৪ সালে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে সেই ম্যাচে ৩২ বলে ৫১ রানের ভয়ালসুন্দর এক ইনিংস খেলে এ দেশের মানুষকে জয়ের আনন্দে কাঁদিয়েছিলেন তিনি।

টেস্ট ক্রিকেটে এ বছরের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসটিও ছিল তার। ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে ভারতের বোলিং আক্রমণকে কচুকাটা করে অসাধারণ তিনটি ছয় আর ২৪টি চারে খেলেছিলেন ১৫৮ রানের জ্বলজ্বলে এক ইনিংস।  

তবে আশরাফুলকে তার যে ইনিংসটি ক্রিকেটের বিশ্ব সভায় সবচেয়ে বেশি করে চিনিয়েছে, সেটি ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০১ বলে ১০০ রান করেছিলেন তিনি। আর তার এই ইনিংসের ওপর ভর করেই কার্ডিফে বাংলাদেশ রচনা করেছিল অস্ট্রেলিয়া-বধ মহাকাব্য। মধ্যরাতে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠেছিল জয়োল্লাসে। এ দেশের লাখ লাখ ক্রিকেট ভক্তের চোখ নিংড়ে আনন্দাশ্রু ঝরেছে সেই রাতে। এমন আরও কত ইনিংস। কত চোখকে আরও কত আনন্দের প্লাবনে ভাসিয়েছেন তিনি।

এই আশরাফুল আবার চরম ব্যর্থ হয়েও কম কাঁদাননি বাংলাদেশের মানুষকে। যেখানে আশরাফুল একটু ধৈর্য্যরে পরিচয় দিলেই সহজে জয় পেত বাংলাদেশ, সেখানে আশরাফুল অবিবেচকের মতো শট খেলে আউট হয়ে ফিরেছেন। মানুষ কেঁদেছে হেরে যাওয়ার ব্যর্থতায়। চোখের জল ফেলেছে প্রিয় আশরাফুলের অপারগতায়।

মাঝে কিছুদিন আশরাফুল তো দলে শুধু আসা-যাওয়াই করেছেন। কখনো ভালো খেলে দলে ঢুকেছেন। কিন্তু একটা-দুটো ইনিংস খেলে আবার খেই হারিয়ে ফেলতেন। বাদ পড়তেন আবার। মানুষ আশরাফুলের ব্যর্থতা আর দল থেকে বাদ পড়ায় কাঁদত। সবার ভালোবাসায় আবার দলে ফিরতেন আশরাফুল। তার শুভকামনা করে চোখের জল ঝরত ভক্তদের।

ক্যারিয়ারের উষা লগ্নে যেমন ছিলেন, সেই আশরাফুল ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসেও একটুও বদলাননি। কাঁদাচ্ছেন এখনো। তবে আশরাফুলের ভক্ত-সমর্থকদের এবারের কান্নাটা একটু অন্যরকম। ম্যাচ পাতানোর মতো লজ্জাজনক অপরাধে অভিযুক্ত আশরাফুল। প্রথমে এটা যেন কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না। যেমন পারেনি ৩১ মে ভোরবেলা আমাকে ফোন করা তন্বী।

বোকা আর ভোলা-ভালা ছেলেটা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে যেমন সবাইকে কাঁদিয়েছেন, তেমনি কাঁদাচ্ছেন সব অভিযোগ মাথা পেতে স্বীকার করে নিয়ে। ক্রিকেট মাঠে যেমন রেকর্ড গড়েছেন, তেমনি রেকর্ড গড়লেন এ ক্ষেত্রেও। দোষ করে তা স্বীকার করার লোক বাংলাদেশের ইতিহাসে আশরাফুলই সম্ভবত প্রথম। শুধু দোষ স্বীকার করেই শেষ করেননি আশরাফুল। ভক্ত-সমর্থক থেকে শুরু করে পুরো জাতির কাছে অবনত মস্তকে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি।  

আশরাফুল এভাবে চোখের জলে ক্ষমা চাওয়ার পর আমার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলÑ কোনো রান না করে অথবা দলকে ঘোর বিপদে ফেলে আউট হয়ে ফিরছেন আমাদের প্রিয় অ্যাশ, মুখখানা তার অবনত। যেন সবার কাছে ক্ষমা চাইছেন।

সাংবাদিকদের কী আর ভক্ত হতে নেই! আশরাফুলের লক্ষ-কোটি ভক্তের মধ্যে আমিও একজন। ভক্ত হিসেবে চোখ নিচু করে তার অবনত মস্তকে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে মনের গহীনে আমি কাঁদতাম। মনে হয় আশরাফুলের আর সব ভক্তদের বেলায়ও ঠিক তাই হতো। তার ভক্তরা এখনো কাঁদছে। হায়রে! ভোলাভালা ছেলেটা ভক্তদের সারাটা জীবন শুধু কাঁদিয়েই গেল!! কখনো আনন্দে, কখনো অব্যক্ত কষ্টে। তাই তো বলি, আশরাফুল বাংলাদেশের ক্রিকেটে চিরকালিন এক কান্নার নাম। যেন কান্নার একদম ঠিক প্রতিশব্দÑ আশরাফুল। (e-mail: rubelabid@gmail.com)

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৪ ঘণ্টা, ১১ জুন ২০১৩
সম্পাদনা: সেকান্দার আলী, বিভাগীয় প্রধান স্পোর্ট/এফএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।