দেশে নির্বাচনের হাওয়া বইলে এক ধরনের উৎসবের আমেজ টের পাওয়া যায়। ঢাকায় বসবাস করেন কিংবা ঢাকার বাইরে, সবখানেই মানুষের আলোচনায় নির্বাচন শব্দটি মুখ্য হয়ে ওঠে।
এতোদিন ধরে বিরোধীদল সজোরে বলে আসছিলো যে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই তারা অংশগ্রহণ করবে না। এ জন্য দেশের সম্পদ ধংস করে হরতাল, খুন-জখম, নৃশংসতা আমরা কম দেখি নি। বিরোধী দলের আচরণে অনেক মানুষই এমন ভীত হয়ে পড়েছিল যে, কেউ কেউ বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কায় পড়েছিলেন। বিএনপির রাজনীতি নিয়ে প্রাথমিক যে প্রশ্নটি উঠেছিল তাহলো, বিএনপি কি আসলে তার নিজের “রাজনীতি” করছে? প্রতিটি দেশেই অনেক রাজনৈতিক দল থাকে এবং প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নিজস্ব রাজনীতি থাকে। সে হিসেবে বিএনপি’রও নিজস্ব কিছু রাজনীতি রয়েছে যা দলটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমল থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে এসছে। বিগত ২০০১ সালে জোট সরকারের আমলে তা বড় ধরনের হোঁচট খায় জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কারণে। বিশেষ করে বাংলাদেশকে পুরোপুরি ধর্মরাষ্ট্র বানানোর যে সহিংস পথ জামায়াতের প্রশ্রয়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিছু রাজনৈতিক দল বেছে নেয়, তা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গেও পুরোপুরি খাপ খায় না। এমনকি যে ভয়াবহ দুর্নীতির ঘটনা ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘটেছে তা-ও জিয়াউর রহমানের ইমেজের সঙ্গে মানানসই নয়। সন্দেহ নেই এসবের খেসারত দলটিকে দিতে হয়েছে বিগত সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।
কিন্তু বিগত বছর খানেক যাবত নিজস্ব রাজনীতি থেকে সরে এসে জামায়াতের খোলসে বিএনপির ঢুকে পড়ার ব্যাপারটি এখন আর কোনো গোপন কথা নয়, মাঝে মাঝেই দলটির নেতানেত্রীদের মুখ থেকেই এর সত্যতা জানা যায়। অনেকে আবার একথাও বলছেন যে, রাজনীতিকে কী করে “আউটসোর্সিং” করতে হয় তা শিখতে হবে বিএনপির কাছ থেকে। কারণ বিগত বছর খানেক ধরে দেশে যে সরকার-বিরোধী রাজনীতি চলছে তার নিয়ন্ত্রণ বিএনপি’র হাতে ছিল না, ছিল জামায়াতের হাতে। এবং শেষ পর্যন্ত হেফাজতের মতো ধর্মসর্বস্ব গোষ্ঠীকে দিয়ে বিএনপি পার হতে চেয়েছে ক্ষমতার সাগর, বলাই বাহুল্য সবকিছুতেই দলটি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
মূলতঃ এই ব্যর্থতা জনগণের সামনে দলটির অবস্থানকে বেশ নড়বড়েই করেছে। কিন্তু যে মুহূর্তে বিএনপি ৪ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে সে মুহূর্তে মানুষ বিএনপি’র নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তিকে বাহাবা দিয়েছে এ কারণে যে, দলটি শেষ পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান ও শক্তিটি ধরতে পেরেছে। এটা খুবই সত্যি এবং আশার কথা যে, বাংলাদেশের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলই নির্বাচনমুখি এবং নিয়মতান্ত্রিক। আর বাংলাদেশের মানুষও যে নির্বাচনমুখি একথাও সত্য। সুতরাং যে কোনো নির্বাচনে সব পক্ষ অংশগ্রহণ করবে, জনগণ নিজেদের “পাওয়ারফুল” ভাববে একটি মাত্র ভোটের মালিক হিসেবে- এটাই সকলে চায় এবং গণতন্ত্রের সৌন্দর্যও সেখানে। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবো না - এই গোঁয়ার্তুমি থেকে সরে এসে বিএনপি’র নির্বাচনে অংশ নেয়া তাই এই সময়ের বাংলাদেশে সবচেয়ে ইতিবাচক ঘটনা। কিন্তু এই ইতিবাচক ঘটনাকে কতো ভাবে যে নেতিবাচক ঘটনায় বদলানোর চেষ্টা চলছে তাই-ই আজকের লেখার বিষয়।
যে কোনো নির্বাচনে প্রচার প্রচারণায় অভিনবত্ব থাকে, থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ ৮০ বা ৯০-এর দশকে যে ভাবে নির্বাচনী প্রচারণা হতো আজকে সেভাবে সম্ভব নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রচারণায়ও নানা অভিনবত্ব চোখে পড়েছে। কিন্তু সব দেশেই নির্বাচনী প্রচারণার কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বা নিয়ম থাকে, যেগুলো মেনে চলাটা প্রার্থীদের জন্য একান্ত জরুরি। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেয়া বিধি ও নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে হয় প্রার্থীদের। কিন্তু মিথ্যাচার আর কুৎসা দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ঘায়েল করার প্রবণতা স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। এবং এই কাজটি কেবল যে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে করা হয়ে থাকে তা নয়, কাজটি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর রাজনৈতিক দল থেকেই মূলতঃ করা হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে আমরা নির্বাচনী প্রচারে ধর্মকে ব্যবহারের কথা উল্লেখ করতে পারি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম এমন একটি বিষয় যা রাজনৈতিক দলগুলো হরহামেশাই ব্যবহার করে থাকে। এদিক দিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান খুবই নাজুক। প্রতিবার এই দলটির বিরুদ্ধে বিরোধী পক্ষ থেকে “ইসলাম আক্রান্ত” বলে ধুয়া তোলা হয়।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, বাংলাদেশ ভারত হয়ে যাবে; টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এক হাতে কোরআন আরেক হাতে গীতা নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে গীতা প্রাধান্য পাবে’’-- বিএনপি’র সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারকের পক্ষ থেকে - এরকম সব প্রচারণা চালানো হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই প্রচারণা-কৌশল এতোদিনে পুরোনো হয়ে যাওয়ার কথা ছিল; কারণ কোনোভাবেই দলটি ইসলাম-বিরোধী তো নয়ই বরং অনেক সময় ধর্মকে উগ্রভাবে ব্যবহারের কাছে নতি স্বীকার করায় প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেদিক দিয়ে বিচার করলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ইসলামবিরোধী তকমা এঁটে দেয়াটা নিছক মূর্খামি।
চলমান সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও সেই একই প্রক্রিয়ায় বিএনপি-জামায়াত জোট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছে। বিগত সময়ে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ হেফাজতি তাণ্ডব চলেছে তার শুরুটা মূলতঃ গুজব থেকেই। বিরোধী দলের একদল দায়িত্বশীল (?) নেতা, যাদের মধ্যে বেগম জিয়া নিজেও পড়েন, বলতে শুরু করলেন যে, বাংলাদেশে নাস্তিকদের উত্থান ঘটেছে এবং তা ঘটেছে সরকারের মদদে। যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের গণ-জোয়ারকে ঠেকাতে যে ধরনের মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়া হয়েছে তার নজির জ্ঞাত ইতিহাসে কেবলমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার গোয়েবলসের কর্মকাণ্ডেই খুঁজে পাওয়া যায়। সর্বশেষ ৬ মে তারিখে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ ঠেকাতে সরকারের পুলিশি অ্যাকশনে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে বিরোধী দলের নেতারা প্রচার করতে থাকেন। যখন টেলিভিশন অনুষ্ঠানেই তাদের কাছে প্রমাণ দাবি করা হয় তখন তারা বালখিল্য ‘প্রমাণাদি’ হাজির করেন যা মূলতঃ বিভিন্ন প্রপাগান্ডা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছিল জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তখন এ-ও দাবি করা হয় যে, মতিঝিলে নিহতদের লাশ হেলিকপ্টারে করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে রাজশাহীতে গিয়ে জানা গেলো যে, এখন হেলিকপ্টার থেকে জামায়াতশিবির চক্র নেমে এসেছে ট্রাকে। তারা ল্যাপটপ হাতে ঘরে ঘরে গিয়ে ৭টি ট্রাক ভর্তি লাশের ছবি দেখিয়ে বলছে, এটা হেফাজতিদের লাশ, যা বেনাপোল দিয়ে সীমান্তের ওপারে পার করে দেয়া হয়েছে। একই অভিযোগ শুনেছি বরিশালে এবং সিলেটেও। খুলনার ব্যাপারটা জানি না একদমই।
তবে ধারণা করা যায় যে, সেখানেও এই হেফাজত-কার্ড খেলা হয়েছে। খালেদা জিয়া হেফাজতকার্ডের ওপর ভিত্তি করে সরকারকে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন, যাতে তিনি সম্পূর্ণই ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু তার দলীয় রাজনীতিকে যেহেতু তিনি “আউটসোর্সিং” করেছেন জামায়াতের কাছে সেহেতু তিনি জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছেন এই হেফাজতিপ্রপাগান্ডা চালানোর জন্য। যদিও সিটি নির্বাচন স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন, তবুও এই নির্বাচন অনেকটাই জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে বা করা হয়েছে এবং জাতীয় নির্বাচনের মতো এতে অবাধে মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে। আমি জানি না, নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বিষয়টি কীভাবে দেখছেন। মাঝেমাঝেই পত্রপত্রিকায় তাদের বিভিন্ন রকম বক্তৃতা প্রকাশিত হয়, তারা প্রার্থীদের বিশেষ করে যারা দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য লড়ছেন তাদের নানা রকম ভুল-ত্রুটি, অবহেলার খবর জনগণের সামনে তুলে ধরছেন। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারনায় এরকম জঘন্য মিথ্যাচার নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য এখনও পর্যন্ত শোনা যায়নি।
এটা ঠিক যে, গণতন্ত্রের যারা গ্রহীতা বা রিসিভিং এন্ড-এ যারা থাকেন তাদেরও দায়িত্ব থাকে গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার। আমরা একথা সকলেই বুঝি যে, নেতা বা রাজনীতিকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ সাধারণ মানুষের ভেতর থেকেই নেতা বেরিয়ে আসেন এবং রাজনীতিও আবর্তিত হয় সাধারণ মানুষকে ঘিরেই। সেক্ষেত্রে সাধারণ ভোটারদেরও সচেতন থাকা উচিত যে কোনো ভাবে যেনো তাদেরকে মিথ্যে তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত না করা হয়। বিশেষ করে দেশে এতোগুলো টেলিভিশন থাকা সত্ত্বেও মতিঝিলে হেফাজতের সমাবেশ ভেঙে দেয়ার দৃশ্য লাইভ দেখানোর পরও যদি কেউ এরকম মিথ্যাচার করে এবং তা ব্যবহার করে একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটারদের প্ররোচিত করে তাহলে সে দায়ভার অনেকটাই ভোটার তথা গণতন্ত্রের গ্রহীতাদের ওপরও গিয়ে বর্তায়। আর এই গ্রহীতা আমি, আপনি, আপনারা সকলেই। আজকে রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট কিংবা খুলনায় এই মিথ্যাচারের ঘটনা ঘটছে কাল সারাদেশ ব্যাপী ঘটবে এবং তার মূল টার্গেট কিন্তু আমরা, সাধারণ জনগণই।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৩ ঘণ্টা, জুন ১৩, ২০১৩
লেখক: সাংবাদিক, গল্পকার
masuda.bhatti@gmail.com