ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সামাজিক ব্যাধি ‘ইভটিজিং’

রাসেল আহমেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৩
সামাজিক ব্যাধি ‘ইভটিজিং’

ঢাকা: ইভটিজিং একটি সামাজিক ব্যাধি। সমাজের কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোকের মাধ্যমে তা ঘটে থাকে।

সংগঠিত হওয়া এই উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা কি খুবই কঠিন কাজ? এ বিষয়ে কিছু বলার আগে দুটি ঘটনা তুলে ধরছি-

ঘটনা ১: মিতু(ছদ্মনাম) একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কিছুদিন আগে ক্লাস শেষে প্রতিদিনের মতো সে একটি পাবলিক বাসে করে বাসায় ফিরছিলো। বাসটি মোটামুটি ভীড়।   ভীড়ের মধ্যে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের একটি সিটে বসে পড়ে সে। তবে তার দুর্ভাগ্য এই যে, তার সিটটির পাশেই দাঁড়িয়েছিলো দুজন বখাটে যুবক।

বাসটি সিটি কলেজ থেকে গুলিস্তানের দিকে চলতে শুরু করে, এক পর্যায়ে মিতুর উপর শুরু হয় ওই বখাটে যুবকদের মানসিক অত্যাচার। তারা মিতুকে নানাবিধ অশ্লীল মন্তব্য করতে শুরু করে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ওই বখাটে যুবকদের পাশে কতিপয় ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে থাকলেও মিতুর উদ্দেশ্যে বখাটেদের করা অশ্লীল মন্তব্যের কোন প্রতিবাদ করেনি। আর মিতুও মানসম্মানের ভয়ে কোন উত্তর দেয়নি। পরিশেষে মিতু সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে আর ওই পাবলিক বাসে উঠবে না।

ঘটনা ২:  রাজধানীর দনিয়ার এ,কে উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুল ছুটি শেষে মিথিলা (ছদ্মনাম) স্কুলের পাশের একটি গলি দিয়ে বাসার দিকেই যাচ্ছিলো। চার বখাটে তার পিছু নিলো। তাদের পিছু নিতে দেখে অনেকটা সন্দেহ নিয়েই আমিও(লেখক) তাদের পিছু নিলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি ছেলেগুলো মোটামুটি মেয়েটিকে ঘিরে ধরেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম ওই চার বখাটের মধ্যে একজন মেয়েটিকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, তাদের পাশ দিয়ে অনেক লোকজন হেটে যাচ্ছে, কিন্তু কেউই কিছু বলছে না। আমি বলতে পারিনি, কিছু করতেও পারিনি, শুধু অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখেছি।

কেন দেখেছি তাও বলছি: একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম লাভ করায় অনেকটা পিতা-মাতার নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই বেড়ে উঠেছি। ফলে, কাউকে শারিরিকভাবে মোকাবেলা করার কৌশল আমার জানা নেই। তাই ওই চার বখাটেকে মোকাবেলা করাও আমার সম্ভব হয়নি।

তবে হয়ত কেউ আমার সাথে থাকলে আমিও এগিয়ে যেতাম। যাই হোক, পরে মেয়েটি বখাটেদের সকল লাঞ্চনা সহ্য করে কাঁদতে কাঁদতে বাসার দিকে চলে গেল। একই এলাকার হওয়ার ওই মেয়েটি স্কুলে যাওয়ার পথে আমার (লেখক) সাথে আরেকদিনের দেখা হয়েছিল।

তখন আমি দেখলাম মেয়েটি এখন আর একা নয়, সাথে তার মাও আছেন। আমি বুঝতে পারলাম ওই দিনের ঘটনার পর থেকে হয়ত মেয়েটি এখন আর একা বের হতে সাহস পায়না।

উপরের দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ইভটিজিং শুধু নারীদের মানসিক সমস্যাই সৃষ্টি করেনা, তাদের স্বাধীনতাও ধংস করে। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, স্পিকার নারী, সংসদ উপনেতা নারী, সে দেশে নারীর স্বাধীনতার উপর বখাটেদের এ ধরনের আঘাত সত্যিই হতাশাজনক।

ইভটিজিং বন্ধে বর্তমান সরকার নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছেন। করেছেন শাস্তির বিধান। তবে সেই শাস্তির বিধানটি সর্বক্ষেত্রে কার্যকর হচ্ছে না। ফলে অনেকটা অপ্রতিরোধ্য রয়ে গেছে ইভটিজিং।

বাংলাদেশের দন্ডবিধি আইনের ৫০৯ এবং ২৯৪ আইন অনুযায়ী ইভটিজিং বা উত্যক্ত বা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার জন্য একজন অপরাধীর জেল-জরিমানা হতে পারে। এছাড়া ডিএমপি অ্যাক্টের ৭৫, ৭৬ ধারা অনুযায়ীও এটি একটি অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে।

ইভটিজিংয়ের ভয়াবহতায় ইতিমধ্যে ঝরে গেছে অনেক প্রাণ। সম্প্রতি ইভটিজিং সংক্রান্ত কিছু মৃত্যুর পর তৎপর হয়ে ওঠে সরকার। সংসদেও ইভটিজিং বন্ধ ও শাস্তির বিধান নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিষ্ট্রেট দিয়ে তাৎক্ষনিক শাস্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

তবে কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও অনেক ইভটিজিংয়ের ঘটনা রয়ে যাচ্ছে অগোচরে। তবে অগোচরে বললেও ভুল হবে, কারণ উপরের দুটি ঘটনা পড়লেই বোঝা যায়, সমাজের অনেক মানুষ এ ধরণের ঘটনা দেখেও কোন প্রতিবাদ করেননা।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা-ঘাট, শপিং মল, বাস, ট্রেন, মোবাইল, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন জায়গায় ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন নারীরা। দু:খের বিষয় হলো- ইদানিং অনেক শিক্ষিত ভালো পরিবারের সন্তানরাও ইভটিজিং এর সাথে সম্পৃক্ত। কেউ হয়ত বন্ধুর সহচর্যে এ ধরনের অন্যায়ের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। আবার কেউ সামাজিকভাবেই এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

সামাজিকভাবে সচেতন হলেই ইভটিজিংয়ের মত অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব। ইভটিজিং বন্ধে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ভূমিকা রাখতে পারে।    
১. পরিবারের সদস্য একে অপরকে সচেতন করতে পারে।
২. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
৩. কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীগণ ইভটিজিং বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারেন।
৪. রাস্তা-ঘাটে চলাচলকারী যে কোন নাগরিক টিজিং বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন।
৫. আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্য সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন।
৬. আমি-আপনি সকলেই আমরা এই নোংরা ব্যাধির বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে পারি।

এককথায় সমাজের সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসই পারে ইভটিজিং নির্মুল করতে। আসুন আমরা সবাই মিলে

ইভটিজিং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। ইভটিজিং বন্ধে সবাই এগিয়ে আসুন।
(লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ)

বাংলাদেশ সময় : ২৩৩৭ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৩
সম্পাদনা: সুকুমার সরকার, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।