ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বাবার বুকের শেষ উত্তাপ

আবদুল হাসিব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৭ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৩
বাবার বুকের শেষ উত্তাপ

সাত বছরের দুরন্ত চল-চঞ্চল বালকটি যখন হাঁটছি, খেলছি, নীলিমায় ঘুড়ি উড়াচ্ছি, মুক্ত বিহঙ্গের মতো সারাদিনমান কি অবাধ চারিদিকে ছোটাছুটি করছি, ঠিক সেই সময়! হঠাৎ একদিন সূর্য ওঠার কিছুটা সময় আগে, আমার কঁচি হাতটি ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গেলেন আমার গর্ভধারিণী, আমার জন্মধাত্রী জননী, আমার অপার অনিঃশেষ প্রশ্রয় প্রশান্তির নিকুঞ্জ; আমার স্নেহময়ী ‘মা’! পৃথিবীর সূর্যোদয়ে শিশিরস্নাত হয়ে প্রকৃতি যখন উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে ঠিক সেই সময় চিরতরে স্তিমিত হয়ে গেলো আমার মায়ের জীবন সূর্য। নবীন সূর্যের অরুণরাঙা আলোর মাঝেও আমি অন্ধকারে ডুবে গেলাম।

আমি সকলের মাঝে থেকেও হয়ে গেলাম একেবারে একা! এবং সেদিন থেকে পৃথিবীর পথে মাতৃহীন কষ্ট-কাতর এক বিষণ্ণ বালকের শুরু হয় পথ চলা।

মা চলে যাবার পর যে সকল বিষয় বস্তুর কাছে মায়ের স্পর্শ রয়ে গেলো, যে সকল জিনিসগুলো স্পর্শ করে করে মায়ের স্পর্শ অনুভব করতাম। বিষয়ের মধ্যে ছিলো মায়ের কণ্ঠস্বর! সহসাই কানে বেজে উঠতো মায়ের ডাকাডাকি, মায়ের কথাবার্তা! কানে বেজে ওঠা এমন সুরের মোহাচ্ছন্নতায় আমি কাতর হয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকতাম। পৃথিবীর কিছুই তখন আর আমার ভালো লাগতো না। আর বস্তুর মধ্যে যা ছিলো তা আজকের প্রজন্মদের পরিচয় করিয়ে দেয়াই এক ধরনের কঠিন ব্যাপার হয়ে উঠেছে। বড়ঘরের সাথে সংযুক্ত মায়ের একখানা পাকঘর ছিলো, যেখানে উনার জীবনের সিংহভাগ সময় ব্যয় করে অবশেষে চলে গেছেন এ ধরাপৃষ্ঠ থেকে। আমার মায়ের জীবদ্দশায় জানা হয়নি- এ পৃথিবীটা কতো সুন্দর! আর কতো বড়! স্মৃতিবিজড়িত মায়ের এই পাকঘরে অর্থাৎ রন্ধনশালায় রেখে গেছেন, তার দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহৃত মাটির কিছু হাড়ি-পাতিল ও কলস এবং অ্যালুমোনিয়ামের ও টিনের কিছু থালা-বাসন আর ছিলো সিরামিকের কিছু বাটি; পানি পান করবার জন্যে ছিলো কাচের গ্লাস ও অ্যালুমোনিয়ামের কয়েকটি মগ। অ্যালুমোনিয়ামের মগগুলো আমরা ছোটরা ব্যবহার করতাম। মায়ের রেখে যাওয়া ঐ জিনিসপত্রগুলোই তখন আমার শান্তির পরশ পাওয়ার অবলম্বন ছিলো। আমি আড়ালে আবডালে মায়ের ব্যবহৃত জিনিসগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার স্পর্শ নিতাম এবং ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বুক ভাসাতাম!  

দ্রুত পরিবর্তনের যুগে আমার জন্ম। সময়ের এমন এক সন্ধিক্ষণে আমি জন্মে ছিলাম যখন প্রাচীনের প্রতি আধুনিকের পুরোদমে আধিপত্য বিস্তার চলছে। আমার জ্ঞান হবার পর আমি আমার চোখের সামনে দেখেছি এবং নিজে ব্যবহার করেছি মাটির থালা-বাসন এবং ডাবর নামক পানপাত্র (ডাবর - বাটির মতো; ওটাই পানপাত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো। ) মা-কে রান্না করতে দেখেছি মাটির হাড়ি-পাতিলে। এবং দেখতে দেখতে চৈনিক পরিব্রাজকের মতো চিনের সিরামিক’এর থালা-বাটি আর কাপ-প্লেটগুলো আগ্রাসী দখলদারিত্বের মতো আমাদের ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈজসপত্রগুলোকে অল্পদিনের মধ্যে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। হ্যাঁ, আধুনিকতার আগ্রাসী আক্রমণে সারা দুনিয়া জুড়ে প্রতিদিন মানুষ হারিয়ে ফেলছে তার লালিত অতীতকে এবং তার গর্বের অতীত ঐতিহ্যকে।

সাত বছর বসয় থেকে জীবনকে নতুন মাত্রায় চিনতে শুরু করলাম। শুরু হয় অকল্পনীয় অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনের বন্ধুর পথ দিয়ে কঠিন যাত্রা। বাবা! হ্যা; ছিলেন। বাবা তার উজাড় করা ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে উভয় কূলের কবোষ্ণ আদর মিশিয়ে প্রচেষ্টার ত্রুটি রাখেননি - আমার অপরিসীম শূন্যতার মাঝে পরিপূর্ণতার জোয়ার বইয়ে দিতে। কিন্ত এই অসম্ভব কাজটি কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। তবে বাবা অনেকটা করতে পেরেছেন ভেবে তৃপ্তি পেতে আমি তাকে বহুবার দেখেছি অথচ আমি শতাংশের একাংশও তৃপ্ত হইনি। তবে সেটা বাবাকেও বুঝতে দেইনি। কারণ যাকে হারিয়ে আমার সমস্ত ভেতরটা শূন্যতার হাহাকারে ব্যথিত বিধুর, যার অভাবে আমার ভেতর খররোদ্দুর উত্তাপে বিরাণ মরুভূমি; সেখানে সেই বাতাস স্নেহের হিমেল শান্ত পরশ দিতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে।

দুঃখকে চেপে রেখে আড়ালে আবডালে নীরবে নির্জনে কাঁদবার স্বভাবটা সেই শৈশব থেকেই। আমার সেই স্বভাবসুলভ আচণের কারণে বাবাও অতো করে ভেবেচিন্তে দেখবার সুযোগ পাননি। সরাসরি যেটা দেখেছেন সেটা নিয়ে ভেবেছেন, সমাধানের প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন, সফলও হয়েছেন। তবে মাঝে মাঝে চরমভাবে ব্যর্থও হয়েছেন - যখন উভয় সঙ্কটে পড়েছেন। এভাবে ছোট বড় ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে প্রবাহিত হয়েছে আমার জীবন নদীর চব্বিশটি বছর। সেই চব্বিশটি বছর ছিলো জীবনের সুদীর্ঘ সময় যা পার হয়েছে কঠিন ঝড়ঝঞ্ঝার ভেতর দিয়ে। দুঃখ-সুখের কমল-কাঁটা সম্পৃক্ত চব্বিশটি বছরে যতো চোখের জল আমি ঝরিয়েছি তা জানে বিগত স্তব্ধ নিশাকাল আর জানে সিঁথানের নরম নীরব বালিশ।

আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে যখন বিদেশে চলে আসবার উদ্দেশ্যে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলা থেকে বার বার ঢাকা আসছি আবার বিয়ানীবাজার ফেরত যাচ্ছি, দুঃখের শতচিহ্ন ক্ষত বুকে ধারণ করে আষাঢ়ে মেঘ হয়ে গুরুগম্ভীর ঘুরছি। দুঃখের ধ্রুপদ রাগিণী অষ্টপ্রহর বাজছে বুকের ভেতর তবুও কারো কাছে একটি টাকা-পয়সাও যেমন চাচ্ছি না, তেমনি কাউকে কিছু বলছিও না; এমনকি বাবাকেও না। কানাডা আসার ব্যাপারে তিনবার যখন তিনটি তারিখ ঠিক হয়েও ঢাকা থেকে ফ্লাইট হয় না, কোন না কোন একটা অজুহাতে ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়; তাতে করে উদাসীনতা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে আমার হতাশা। এমন এক দোদুল্যমান পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে আমি যখন ঢাকার হোটেলে নিশিবাসে সময় গুণছি, দিনরাত্রি কাটাচ্ছি তখনকার এক গভীর রাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, কেউ একজন নারী, যাকে আমি স্পষ্ট চিনে উঠতে পারিনি, উনি আমাকে আদেশের সুরে বলছেন, - ‘হাসিব, তুমি বাড়ির উঠোনে যাও; বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারটি তোমার জন্মদাতা পিতার কাছে গিয়ে খুলে বলো, তবেই তোমার ফ্লাইট হবে, তবেই তোমার বিদেশ যাওয়ার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। ’

বাবাকে বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারটা অবগত করছি না, সে অপরাধবোধ আমাকে অবশ্যই মাঝে মাঝে দগ্ধ করছে। অন্যদিকে অব্যক্ত চাপা একটা কষ্ট আমাকে তা করতে সাহসী এবং পাষাণ করছে। স্বপ্ন দেখার পরের সকালেই চলে যাই ঢাকা সোনার গাঁ হোটেলের প্রথম তলায়, কেএলএর-এর (হল্যান্ড এর এ্যারলাইন্স) অফিসে সেল্স ম্যানেজার সাম্মি সাহেবের কাছে। সাম্মি সাহেবকে ফ্লাইটের পরবর্তী তারিখ জিজ্ঞাস করলে তিনি প্রায় ৯০% নিশ্চয়তা দিয়ে জানালেন যে, ‘আশা করি পাঁচ সাত দিনের মধ্যে আপনার ফ্লাইট এর একটা সুব্যবস্থা হয়ে যাবে। ’ বিশেষ করে আমাদের দেশের ট্রাভেল এজেন্সির নিশ্চয়তার শতকরা ‍হার যদিও আমার জানা আছে তবুও সাম্মি সাহেবের ‘আশা করি’ শব্দটির সাথে আমার বুকের ভেতর বিশ্বাসের শক্ত সেতু নিমেষে নির্মিত হয়ে গেলে আমি অফিস থেকে বের হয়েই সোজা কমলাপুর রেল স্টেশনে চলে যাই। সেখান থেকে শাহজালাল এক্সপ্রেস যোগে বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা দেই। উদ্দেশ্য বাবার সাথে ক’টা রাত কাটাবো এবং সবকিছু খুলে বলবো। রাত প্রায় একটার দিকে বাড়ি এসেই বাবার বুকে মাথা রাখলাম। বাবা আমাকে যেভাবে জড়িয়ে নিলেন তাতে বুঝাই গেলো এঘরের সবার ছোট ছেলেটি এখনও বড় হয়নি।

সেদিন সেই রাতে অবাক বিস্ময়ে বাবা আমার মুখের দিকে স্থির পাহাড়ের মতো তন্ময় থাকিয়ে অনেকক্ষণ কিছু যেন দেখছিলেন, কিছু যেন খুঁজছিলেন। কে জানে, হয়তো বা তখন আমার মুখাবয়বে জন্মলগ্নের লেগে থাকা কোন দাগ, কোন ক্ষুদ্র চিহ্ন খুঁজছিলেন, নয়তো বা পরখ করে দেখছিলেন, কিভাবে আমি আমার বুকের ভেতরের নরম জমিনে দুঃখের চারাগুলো সযত্নে রোপন করে রেখেছি। লো ভল্টেজের বিদ্যুৎ বাতির নরম আলো যখন আমার বাবা’র চোখে ধরিয়ে দিলো, আমার চোখ থেকে নিস্পন্দিত জল গড়িয়ে নামছে! আমার চোখে জল দেখে বাবার বুকের ভেতরের বরফ জমা কষ্টগুলো নিমেষে জলোচ্ছ্বাসের মতো উন্মতাল হয়ে উঠলে তাঁর দুচোখ দিয়ে খরস্রোতা নদী বইতে থাকলো। শৈশবের মতো করে বাবা আমাকে তাঁর প্রাক্তন আসক্তিতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আমার ললাটে আদর মেখে কাঁদতে কাঁদতে যে দুর্লভ কথাগুলো সে দিন সে রাতে আমাকে বলেছিলেন, সে গুলো আজকের এই রচনায় এতো স্বল্পপরিসরে আনতে পারছি না। এতো বড় বড় কথা, যার ভাবার্থ জীবনভর আমার কাছে এতো গভীর! কী করে কথাগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এখানে আমি দেই। সুতরাং আমার কাছে রেখে যাওয়া আমার বাবার বাণীগুলো এখানে অপ্রকাশিত রয়েই যাক। এবং বাবা’র সেই কথাগুলো আমার বুকের ভেতর সযত্নে রক্ষিত থেকে লালিত হউক। ওটা ওখানেই আমৃত্যু অক্ষত এবং অটুট থাকবে।

বাবার বুকের শেষ উত্তাপ আমি নিয়েছিলাম, ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭ সাল, রোজ মঙ্গলবার, সকাল সাড়ে ১০টার শেষ অনু সেকেন্ড পর্যন্ত। যদিও ঢাকা থেকে কানাডা অভিমুখে আমার ফ্লাইট হয়েছিলো ৬ অক্টোবর ১৯৮৭ইংরেজি, রোজ মঙ্গলবার। এই পনের দিনের মধ্যে ঢাকা থেকে আমার আর বাড়ি যাওয়া হয়নি, বাবাকেও আর স্পর্শ করা হয়নি। আমার নিয়তি বাবার সাথে আমাকে আর  মিলতেও দেয়নি। বাড়ির সামনে প্রকাণ্ড পুকুর, পুকুরের পূর্ব প্রান্ত ঘেঁষে গোরস্থান। বিদায়ের প্রাক্কালে বড় বোন আর বড় ভাই ছাড়া বাকি পাঁচ ভাইবোনরা উপস্থিত ছিলেন। বলাবাহুল্য, আমি ছিলাম পরিবারের সবার ছোট। আমার অসুস্থ বাবা তাঁর হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে পুকুর পার পর্যন্ত এসেছিলেন আমাকে আরো কিছুটা পথ এগিয়ে দেয়ার জন্যে। গোরস্থানকে সামনে রেখে আমরা সবাই দাঁড়ালাম জিয়ারত করবার মানসে। কৈশোরের মতো করে বাবা আমাকে তাঁর বুকের সামনে রেখে মায়ের কবর জিয়ারত করলেন। মোনাজাতের সময় বাবা জোরেসুরে অশ্রুসজল চোখে খোদার দরবারে যেমন করে বললেন, তেমনি মায়ের আত্মাকে উদ্দেশ্য করেও বললেন, ‘তোমার পাগলের জন্যে দোয়া করো, তার যখন একমাত্র উদ্দেশ্য স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে যাবে; সুতরাং তার এই আশাটা যেন পূর্ণই হয়ে যায়। হাওয়ারুন’র মা তুমি তোমার হাসিব’র জন্যে এই দোয়াটাই আজ করো। ’ মোনাজাত শেষে বাবা তাঁর প্রশান্ত বুকের ভেতর আমাকে জড়িয়ে নিয়ে বাচ্চাদের মতো করে খুব কাঁদলেন। তাঁর চোখের উষ্ণ পানি আমার মাথার ওপর টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়ে মাটিতে ছিটকে পড়তে দেখে আমি চমকে উঠি, আমি শিউরে উঠি! আমি আরো অশান্ত অস্থির হয়ে উঠি।

এই প্রথম আমার বুকের ভেতর একটা অপ্রত্যাশিত আশঙ্কা মূর্তিমান হয়ে উঠলো। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম কিভাবে আমি আমার বাবাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবো। বারবার কেন যেন আমার মন বললো, এইবার আমার ফ্লাইট আর বাতিল হবে না। আমার বিদেশ যাওয়া হয়ে যাবে। আমি আসলেই কানাডা চলে যাবো। আর যে দিন জীবনে স্বপ্ন পূরণ করে স্বনির্ভর হয়ে চোখেমুখে সফলতার উজ্জ্বল আলো মেখে বাড়ি ফিরবো, সেদিন হয়তো আমি আমার বাবাকে আর খুঁজে পাবো না! এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যঞ্জনাময়ী বেদনায় আমার সমস্ত ভেতরখানা ভরে উঠলে। আমার দেহখানা তখন বাবার স্নেহমাখা বুক থেকে তুলে নিয়ে কিছুতেই যেন সরে আসতে পারছিলাম না। উপস্থিত স্বজনরা তখন বাবার বুক থেকে আমাকে ছাড়িয়ে আলাদা করে মক্তব ঘরের সামনে নিয়ে এসে রিক্সায় তুলে দেন। পিছন ফিরে চেয়ে দেখলাম বাবা আমার কাঁদতে কাঁদতে আর কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে গেছেন! এবং বাচ্চাহারা হরিণের মতো অব্যক্ত কষ্টে ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে অপলক তাকিয়ে বারবার চোখ মুছছেন।

আমার তখন মনে হয়েছিলো, এই স্বার্থপর পৃথিবীর সকল স্বপ্ন সাধ ত্যাগ করে বাবা’র বুকেই ফিরে যাই! কিন্তু গেলাম কই? আমি তো সেদিন সেসময় আমার ঝাপসা চোখ মুছতে মুছতে নির্মমভাবে ক্ষণকালের ভেতরেই বাবার দৃষ্টির আড়ালে চলেই গেলাম। এবং ৭ অক্টোবর ১৯৭৮, বুধবার, কানাডার টরন্টো শহরে অবস্থিত পিয়্যারসন্স এয়াপোর্টে সন্ধ্যা ৬টায় এসে অবতরণ করলাম। আর সেই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে অনাবাসী হয়ে গেলাম। অতঃপর, প্রবাসের সুদীর্ঘ সময় ৫ বছর পার করে ১৯৯২ সালের ২৪ নভেম্বর, মঙ্গলবার, আমি যখন বাড়ির উঠোনে গিয়ে পৌঁছি, তখন বাবাহীন নিষ্প্রভ নিষ্প্রাণ এই বাড়ির আশেপাশের ঝোপঝাড়ে, পুকুর পাড়ে, দালানের গায়ে বাবা’র সকরুণ মুখচ্ছবিখানি কেবল ভেসে ভেসে উঠতে দেখেছি। এবং আমি আমার ঝাপসা চোখ মুছতে মুছতে ক্লান্ত হয়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম নিয়েছি।

লেখক: কানাডা প্রবাসী কবি, ছড়াকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক ও সাংবাদিক।

বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।