চিরায়ত অকৃত্রিম সম্পর্কের এক অসামান্য দিন জুনের তৃতীয় রবিবার; ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। দিনটি উৎসর্গিত পৃথিবীর সকল বাবাদের জন্য।
সব বাবাই শাসনে কঠোর, ভালোবাসায় কোমল, স্নেহে উদার, ত্যাগে অগ্রগামী। সন্তানের মাথার ওপর যাঁর স্নেহচ্ছায়া বটবৃক্ষের মতো, সেই বাবার প্রতি বাবা দিবসে বিশ্বব্যাপী ঘটা করে জানানো হবে বিনম্র শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। সন্তান যতই বড় হোক না কেন বাবার কাছে সে সব সময়ই ছোট। সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে অসীম সংগ্রাম করে স্নেহপ্রবণ বাবা, শত কষ্টের মধ্যেও সন্তানের জন্য সাধ্যমতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই যার আনন্দ তিনিই তো আমাদের বাবা। যেকোন ধরনের দুঃখ-কষ্ট একাই সহ্য করেন বাবা। সব সময় চেষ্টা করেন দুঃখ-কষ্ট যেন তার সন্তানদের স্পর্শ না করে। সন্তানের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। তাদের ক্লান্তি ও কষ্ট ভুলে যান যখন তাদের সন্তানের কণ্ঠে ভাসে- ‘আমার পৃথিবী বলতে বাবা আমি তোমাকেই বুঝি’ এবং ‘বন্ধু না হয়ে কেন বাবা হলে না, বাবার মতো আদর করে চুমু দিলে না?’
ভালোবাসার এই বন্ধন মনকে শীতল করে দেয় পরম তৃপ্তিতে। ইতিহাস বলে ১৯০৯ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটনের স্পোকান নামক ছোট্ট শহরে জনৈক সোনোরা লুইস ডডের মায়ের মৃত্যুর পর তার বাবা উইলিয়াম জ্যাকসন পরম মমতায় তাদের ছয় ভাইবোনকে বড় করেন। তারা কখনোই তাদের মায়ের অভাব বুঝতেই পারেননি। যেনো বাবাই তাদের মা। বাবাই ছিলো তাদের সব কিছু। ডড ভাবলো মা দিবসের মতো বাবা দিবসও থাকা উচিত। তিনি তার স্বপ্ন পূরণে নিরলস ভাবে কাজ করে গেলেন। তার এ স্বপ্ন বাস্তব হলো যখন ১৯১৬ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এ দিবসকে সমর্থন করেন এবং জাতীয় আইনসভাতেও স্বীকৃতি দেন। সেই থেকে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ৮৭টি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। কিন্তু এসব দেশের বাবা দিবস পালনের তারিখ যেমন ভিন্ন তেমনি তাদের রীতিও আলাদা আলাদা। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালন করে বেশ কিছু দেশ, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
পারিবারিক বন্ধন আর ভালোবাসার চিরন্তন সমারোহ ছিল এ বাংলাদেশ। কখনো কখনো আমার কাছে মনে হতো ‘মা দিবস’ ও ‘বাবা দিবস’ এটা পশ্চিমা বিশ্বের জন্য। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ইদানিং অনেকটাই পাল্টে যাচ্ছে। অনেক বাবা-মার স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। সন্তানরা বড় হয়ে কর্মব্যস্ততায়, লেখাপড়া ও নানা কাজের চাপে বাবা-মাকে প্রায় ভুলেই যাচ্ছে। কেউবা প্রবাসে, কেউবা বাবাকে গ্রামে রেখে শহরে পাড়ি জমায়, আবার কেউবা শহরের অন্য কোথাও আলাদা কুঠুরিতে বাবা-মাকে ফেলে রেখেছেন। বৃদ্ধ বয়সে তাদের সন্তানের কাছে বাবা-মার যা প্রাপ্য তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ইদানিং বাংলাদেশের তথাকথিত হাই সোসাইটি, এমনকি শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে বাবা-মাকে বিচ্ছিন্ন করে বৃদ্ধাশ্রমে বা পৃথক স্হানে রাখার প্রবনতা দিনদিন বেড়েই চলছে। প্রায়শঃ পত্রিকার পাতায় দেখা যায় নিন্মবিত্ত, মধ্যবিত্ত অথবা গরীবের সন্তানেরা অবৈধভাবে অঢেল অর্থবিত্ত অর্জনের পর তারা তথাকথিত সামাজিক মর্যাদার মিথ্যা অভিনয়ের কারণে বাবা-মাকে লোক চক্ষুর অন্তরালে পাঠিয়ে দিতে স্বাচ্ছন্দ অনুভব করেন। তারা অতীতকে ভুলে এতটাই অসৎ ও নরপিশাচ হন যে বাবা-মার পরিচয় পর্যন্ত গোপন করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। তারা বুঝতেও চান না যে, বাবা হলেন অদ্বিতীয় আলো, যার আলোয় আলোকিত হয়েই তার জীবনের পথচলা শুরু হয়েছে।
যাদের বাবা আজ আমাদের মাঝে নেই, তাদের উপলব্ধি এতটাই তীব্র ও বেদনাবিদুর, যাদের বাবা এখনো কাছে আছেন তাদের পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব নয়। যাদের বাবা আজ নেই তাদের প্রতি আজকের দিনে সমবেদনা জানাই। বাবারা সব সময় আমাদের মাঝেই আছেন এবং চিরকাল থাকবেন। যদিও বাবার অনুপস্থিতি কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হবার নয়। সন্তান বাবার ঋণ কখনো পরিমাপ ও শোধ করতেও পারে না। পরিবারের মহীরুহ হয়ে দায়িত্ব পালনে, সন্তান-সংসার পরিচালনায় ব্রতী যিনি, সেই বাবার প্রাপ্য সম্মান প্রদর্শনে একদিন কিছুই নয়। তবুও শুধুই তার জন্য একটি দিন, একটু আলাদা করে উদযাপন করতেই ‘বাবা দিবস’। কিন্তু আমার দেশের অধিকাংশ বাবাই অবহেলিত থেকে যাবেন কারণ তারা জানেনই না ‘বাবা দিবস’ কি? এর তাৎপর্যই বা কী? জানি, এদিনে বিত্তবানেরা তাদের বাবাকে সুন্দর ও দামী গাড়ি, ইনফিনিটি, এলিয়েন্স, বস, হুগো ব্র্যান্ডের অফিস ব্যাগ, কেউবা আবার মানিব্যাগ, ঘড়ি ও চশমা কিনে দিবেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, বাবারা সন্তানের কাছে কোন দামী উপহার চান না, তারা চান শুধু সন্তানের সান্নিধ্য, হাসিমাখা মুখ আর সাফল্য। আর এতেই তাদের প্রাণ ভরে যায় অনাবিল আনন্দে। তাই বিশেষ এই দিনটিতে বাবার পাশে কিছুটা সময় থাকুন, তার ভালো লাগা-মন্দ লাগা বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করুন। তার কাছে আপনার ছোট বেলার গল্প শুনতে চাইতে পারেন। একটা সময় বাবা আমাদের হাত ধরে চলতে শিখিয়েছেন আজ যেন তার মানসিক শক্তি হতে আমাদের কোনো কার্পণ্য না থাকে। আজকের জন্য হলেও বলুন ‘বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি’। যাদের বাবা আজ নেই সবাই তাদের বাবাদের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া-আশির্বাদ করুন আর একবার হলেও বলুন ‘বাবা, আমি তোমাকে খুব বেশি মিস করি’।
আমাদের দেশে আমরা তেলা মাথায় তেল দিতে বেশি পছন্দ করি। আমরা ঘটা করে সন্মান জানাই যাদের যশ, খ্যাতি ও প্রতিপত্তি আছে তাদের। আমরা রত্নগর্ভা মা ও সফল বাবা উপাধি দিয়ে মেডেল তুলে দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি যাদের দাদা-দাদী, বাবা-মা ও নিজেরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে ফুল বিছানো পথ বেয়ে সফলতা পেয়েছেন। আমরা কখনোই সে বাবা-মাদের দেখতে পাই না, যারা পেটে পাথর বেধে, অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে সন্তানের সফলতা অর্জনে নিজের জীবনকে নিঃশেষ করে দিয়েছেন। আজ এ দিনে সে সকল বাবার প্রতি আমার স্যালুট। জনৈক সোনোরা লুইস ডডকে জানাই অভিনন্দন বাবার প্রতি এমন অসীম ভালোবাসার জন্য। বলতে দ্বিধা নেই, কাকতালীয়ভাবে ডডের বাবার মতো আমার বাবাও তার জীবনের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে আমাদের ছয় ভাই-বোনকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলেছেন। শিখিয়েছেন কিভাবে সীমিত সম্পদকে কাজে লাগাতে হয়, কিভাবে জীবনকে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়তে হয় আর সততা ও আদর্শকে আঁকড়ে ধরেও জীবনে সফলতা অর্জন করা যায়। আমার বাবার জন্য খুব গর্ব হয়। আর এমন বাবার সংখ্যাই তো আমাদের দেশে বেশি। বাবা তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি। আজ তাই প্রমিজ করলাম, সৃষ্টিকর্তার কৃপায় তোমার সংগ্রামী বাবার জীবনী আমি লিখে যাবো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। শুধু তোমার কাছে অনুরোধ, বাবা প্লিজ নেভার সে গুডবাই।
লেখক: ড. মো. নজরুল ইসলাম প্রান্তিক; সহকারী অধ্যাপক; ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে জাপান সোসাইটি ফর দি প্রমোশন অব সায়েন্স (জেএসপিএস) পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে ইউনিভার্সিটি অব টোকিওতে সমুদ্রের পরিবেশ ও বাস্তব্যবিদ্যার ওপর উচ্চতর গবেষণারত।
বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১৩
সম্পাদনা: এম জে ফেরদৌস, নিউজরুম এডিটর