ঢাকা: আমাদের দেশ নদ-নদী দিয়ে ঘেরা একটি দেশ। এদেশে প্রায় ৫৭টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী।
নদীতে যে বাঁধগুলো দেওয়া হচ্ছে- তা কখনও দেওয়া হচ্ছে সেচ প্রকল্পের জন্য, আবার কখনও বা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য। বেশিরভাগ বাঁধ নদীর উজানে দেওয়ায় আমাদের দেশে প্রবেশের পর এসব নদী মোটামুটি মৃতপ্রায়। উত্তর দিক থেকে প্রবেশ করা তিস্তার বিভিন্ন স্থানে বাঁধ প্রকল্প নির্মিত হয়েছে। তিস্তার উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা ইউনিয়নের ১২০ কিলোমিটার উজানে ব্যারেজ তৈরি করা হয়েছে। ২১২.৫৩ কি: মি: দীর্ঘ ৪৪টি স্লুইস গেট সহ এই বাঁধটির তিনটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় সেচ প্রকল্প, দ্বিতীয় পর্যায় পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প আর তৃতীয় পর্যায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল খনন করে নৌপথ তৈরি। প্রথম পর্যায়ের কাজ হয়ে গেছে ১৯৪৫ সালেই।
তিস্তা নদীতে বর্তমানে দুটি বাঁধ রয়েছে। একটা বাংলাদেশের সীমান্তে আর অপরটি ভারতে। দুটি বাঁধই দেওয়া হয়েছে সেচ প্রকল্পের জন্য। জলের প্রাপ্যতা এতে অনেক কমে গেছে। বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি পলিও সরিয়ে নেওয়া হয়, ফলে নদীর প্রতিবেশের অনেক পরিবর্তন ঘটে। পানিবিদ্যুৎ বাঁধের ক্ষেত্রে পানি ধরে রেখে পরবর্তীতে ছেড়ে দিলেও পলি কিন্তু সেখানে জমা থেকেই যায়। আর তার কারণে নদীর বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের খাদ্যশৃঙ্খলেও পরিবর্তন আসে। এমন অনেক সময়ই হয়ে থাকে, নদীর পানি ও তার সঙ্গে বয়ে চলা পলির ওপর নিয়ন্ত্রণ চলে এলে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ, অণুজীব বিলুপ্ত হয়ে যায় আমাদের অজান্তেই।
টিপাইমুখ বাঁধের ক্ষেত্রে ভারত যদিও এখনও বলছে নদীর পানি আটকে কোনো ধরনের সেচকাজ করবেনা। কিন্তু এতে পলিও আটকে থাকবে যদিও পরবর্তীতে পানি ছেড়ে দেওয়া হবে। এর সঙ্গে আরেকটি বিষয়েও পরিবর্তন আসবে। সেই ভয়াবহ পরিণতির কথা উল্লেখ করলেন আইইউসিএন এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর ড. ইশতিয়াক সোবহান। টিপাইমুখ বাঁধ দিলে পানির পরিমাণ বিভিন্ন ঋতুতে যেটুকু আসার কথা, তা পাল্টে যাবে। শীতে সাধারণত আমাদের দেশের হাওর অঞ্চলে পানি কমে গিয়ে ধান চাষের উপযোগী এলাকা তৈরি হয়, কিন্তু এই বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে, শীতেও ওই অঞ্চলে পানি থাকবে। ড. ইশতিয়াক তাই বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পকে আমাদের দেশের আঙ্গিকে মরুকরণ না বলে জলকরণ বলে আখ্যায়িত করতে চান। কারণ এই বাঁধটি বাস্তবায়িত হলে হাওর অঞ্চলে বর্ষাকালে পানি শুকিয়ে যাবে, আর শীত মৌসুমে পানি এসে সব ফসল নষ্ট করে ফেলবে। বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে সবসময় মানুষের সুবিধার কথা ভাবা হয় উল্লেখ করে এই পরিবেশবিদ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা সেচ কাজ সম্পন্নের জন্য বেশিরভাগ বাঁধ নির্মিত হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে দেখা যেত ইলিশ মাছ পদ্মা থেকে উজান অঞ্চলে-ভারতের এলাহাবাদ পর্যন্ত সাঁতরে চলে যেত। কিন্তু ফারাক্কা নির্মাণের কারণে এখন ইলিশের বিচরণক্ষেত্র কমে গেছে। ইলিশ বেশ গভীর পানিতে বিচরণ করতে পছন্দ করে। তাই ইলিশের জন্য গভীর খালগুলো সংরক্ষিত রাখতে পারলে জীববৈচিত্র্য হারাবার সম্ভাবনা কম।
কিন্তু তা করতে হলে আন্তর্জাতিক নদী যেসব ভূখন্ডের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, সেসব দেশগুলোর মধ্যে সমঝোতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা খুবই জরুরি। ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলোর ক্ষেত্রে বাঁধ নির্মাণে সমঝোতা করতে গেলে বাংলাদেশকে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তার কারণ হলো ভারতের নদী বিষয়ক প্রকল্পগুলো স্থানীয় রাজ্য সরকারের অধীনে। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়না। তিস্তার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যনার্জী পানির হিস্যা চুক্তিতে রাজী না হওয়ার পেছনে কারণটাও তাই একটু জটিল, বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। ভারতের অঙ্গরাজ্য সিকিমের পানি ছাড়ার ওপর নির্ভর করে, তিস্তার কত শতাংশ পানি বাংলাদেশকে দেওয়া সম্ভব হবে। তাই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা এখনই।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আরো বলেন, আজকাল তিস্তার বিভিন্ন স্থানে যে হারে বাঁধ নির্মিত হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের প্রাপ্য পানির পরিমাণ এমনিতেই কমে যাবে। প্রত্যেক ভূখন্ডে বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থেই নেওয়া হচ্ছে। সেখানে নদীর স্বার্থ দেখা হয় খুবই কম, বা না বললেই নয়। তিস্তাকে যদি পুরো একটি অঞ্চল হিসেবে না দেখে খণ্ড খণ্ড হিসেবে দেখলে সমস্যা আরো বাড়বে। জাতীয় স্বার্থে যখন বাঁধ নির্মাণের প্রসঙ্গটি চলে আসে, তখন রাষ্ট্র সীমানার বাইরে থাকা মানুষের কথা ভাবা হয়না। আর ঠিক তখনই ঝামেলা বাড়ে। মানুষের স্বার্থও এই ব্যাপারে কতটুকু রক্ষা হচ্ছে, তাও প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক সময় বাঁধ নির্মাণের কারণে তার কাছাকাছি এলাকায় বসবাসরত অধিবাসীদের বসতবাড়ি ভেসে যাওয়া সহ নানা ধরনের ক্ষতিসাধন হয়। তাই সীমান্তের ওপারে বাস করা মানুষের ব্যাপারটি ভাবনার মধ্যে নিয়ে আসা অনেক কঠিন। চীন ভাবছে, ব্রহ্মপুত্রের ওপর বাঁধ দিতে গেলে ভারতের কথা ভাববার কিছু নেই, তেমনি বাংলাদেশের বিষয়টিও গণনার মধ্যে আনার ক্ষেত্রে ভারতকে দেখা যায় বেশ উদাসীন। আসলে, চিন্তাধারায় পরিবর্তন এনে সহনশীল মনোভাব বজায় রেখে আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলে অভিমত দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
আর নদীর নিজের অধিকারও সংরক্ষণ করা দরকার। সেক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। সমুদ্রের পানি অধিকার আইন থাকলেও আন্তর্জাতিক নদী অধিকারের ব্যাপারে সে ধরনের কোনো নীতিমালা নেই। আর তা দ্রুত না করা হলে সীমান্ত নদীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় সীমান্তবর্তী উভয় দেশকেই ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫১ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০১৩