ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নারী সাংসদ: নারী ও বাক-স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক

জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৫ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৩
নারী সাংসদ: নারী ও বাক-স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক

বাংলাদেশে বাক-স্বাধীনতা এবং সেই সাথে নারীদের অধিকার হরণে কু-চক্রান্ত চলছে এমনটি দাবি করে এদেশের নারী নেত্রীগণ তথা আমরা সচেতন নারী সমাজ বেশ কিছুদিন ধরেই বেশ সোচ্চার। দেশ আফগানিস্তানে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে টকশো ও পত্র পত্রিকায় আমরা সুশীল চিন্তাবিদেরা বিশেষ চিন্তিত ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছি।

খামাখা চিন্তা-ভাবনা করে আমরা নারীরা নিজেদের বহু যতনে গড়া রূপসৌন্দর্যের অপূরণীয় ক্ষতি করছি বলেই আসলে প্রতীয়মান হতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী স্বাধীনতা বিলুপ্তির পথে এই সব মিডিয়া প্রপাগাণ্ডা ছাড়া আদৌ যে কিছু নয় তা সাম্প্রতিককালে আমাদের মহান জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে মনোনীত বিরোধীদলীয় মহান(?) সাংসদ রেহানা আক্তার রানু, নিলোফার চৌধুরী মনি, শাম্মী আক্তার ও সরকার দলীয় সাংসদ অপু উকিলের সাম্প্রতিক বক্তৃতায় বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

জাতীয় সংসদে রেহানা আক্তার রানুর ব্যবহৃত আঞ্চলিকতা সমৃদ্ধ বিশেষ শব্দটি নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু হয়েছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলা ভাষা বিশারদগণ কর্তৃক অবশেষে শব্দটিকে নিতান্তই নিরীহ একটি ক্রিয়াপদ বলেই ঘোষণা করেছেন। বাংলিশ বলে অপবাদ দেয়া নতুন প্রজন্মকে খাঁটি আঞ্চলিক ভাষায় ফিরিয়ে আনার জন্য রানুকে অবশ্যই জাতীয় সম্মাননা প্রদানের প্রস্তাব জাতীয় সংসদেই পেশ করা যেতে পারে।

রানুর ব্যবহৃত শব্দটিকে হুইপ আ স ম ফিরোজ ‘নিষিদ্ধপল্লী’তে ব্যবহার করা হয় বলে বেশ হম্বিতম্বি দেখিয়ে এক্সপাঞ্জ করার দাবি তুললেও এখন উল্টো তার ভাষা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দেখে আমরা জনগণ তার উপরই বেশ চটে আছি। আর কথায় কথায় আমাদের নেতাদের নিষিদ্ধ পল্লী নিয়ে উদাহরণ টানার ব্যাপারটি কেন জানি সে পল্লী নিয়ে যে তাদের বিশেষ অভিজ্ঞতা রয়েছে সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহকে আরো পোক্ত করে তোলে।

এই রানুই, এর আগেও ২০১১ সালে বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যে কটুক্তি করবে তার জিহ্বা কেটে টুকরো টুকরো করে দেবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তিনি সেসময় সরকার বেসামাল, অর্থমন্ত্রী টাল, বাণিজ্য মন্ত্রী টাল, আইন প্রতিমন্ত্রী টাল, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদকে `চৌকিদার`সহ নানা অসংসদীয়-কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করে সুপার হিট সাংসদে পরিণত হয়েছিলেন।
 
তবে রানু অর্থমন্ত্রী প্রদত্ত বাজেটকে "ছলনাময়ী নারীর" সাথে কেন তুলনা করলেন তা আমাদের নারীবাদী নারীকুলের কাছে মোটেও বোধগম্য নয়। তার মতে এবারের বাজেট ছলনাময়ী কারণ "সুন্দর সুন্দর কথা, সুন্দর সুন্দর প্রস্তাব। সবই ছলনা, ধোঁকাবাজি। "

কথা হলো নারীই কি শুধু ছল করে থাকে? পুরুষকুলও তো ছলনায় পিছিয়ে নেই। আর যদি ছলনায় নারীরা পুরুষদের থেকে এগিয়ে থাকে তবে নিঃসন্দেহে আমাদের নারীরাই অগ্রগামী, দেশে নারী-স্বাধীনতা তাহলে মোটেও হুমকির মুখে নাই।
 
এবারের অধিবেশনে আরেক নারী সাংসদ শাম্মী আক্তার যখন বাজেটের ওপর আলোচনা না করে হেলাল হাফিজের `যার যেখানে জায়গা` কবিতাটি জাতীয় সংসদে আবৃত্তি করেন, তখন তাকে সংস্কৃতিমনা মনে করে আমরা গর্বিত হতেই পারি। কিন্তু এক্ষেত্রে অবশ্যই জাতীয় সংসদের মর্যাদার প্রতি খেয়াল রাখা উচিত সর্বাগ্রে।
 
হেলাল হাফিজ নিঃসন্দেহে একজন জনপ্রিয় কবি। শ্রেণী-বৈষম্যের প্রতি কটাক্ষ করে লেখা তাঁর অসাধারণ কবিতাটি যে বিরোধীদল, সরকার দলকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেবেন এমনটি বোধহয় কবি নিজেও ভেবে দেখেননি। সাংসদদের যা কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে জাতীয় সংসদে কখনো এই কবিতা ব্যবহৃত হতে পারে জানলে কবি হয়ত ওই বিশেষ শব্দটি বদলে আরো খারাপ কোনো গালি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে দিতেন।
 
আরেক সাংসদ নিলোফার চৌধুরী মনি তিনিও বাক-স্বাধীনতায় পিছিয়ে নেই। অর্থমন্ত্রীকে `ক্লাউন` এবং তথ্যমন্ত্রীকে `মস্তিষ্ক বিকৃত ভাড়াটে মন্ত্রী` বলে উল্লেখ করে তিনি নিঃসন্দেহে সাহসিকতার জন্য জাতীয় পুরুস্কার পাবার দাবি রাখেন (!)
 
নিলোফার চৌধুরী মনির বক্তব্যের প্রতিবাদে সরকারি দলও যে কম যায় না তার প্রমাণ দিয়েছেন সাংসদ অপু উকিল। তিনি বলতে গেলে রানু, মনি, শাম্মী সবাইকে  ছাড়িয়ে গেছেন অশ্লীলতা ও কুরুচির দিক দিয়ে। একজন নারী হয়ে তিনি যেভাবে নারীর সম্মান হরণ করেছেন তা সত্যি দুঃখজনক।

খালেদা জিয়ার মা কে নিয়ে তিনি যে বক্তব্য পেশ করেছেন, মায়ের জাত হয়েও তিনি একজন মাকে যেভাবে কলঙ্কিত করেছেন, তার জন্য নারীর মাতৃসত্বা লজ্জা পেতে বাধ্য। সত্য-মিথ্যা যাই হয়ে থাকুক ব্যক্তিগত আক্রমণ যে কত কুরুচিপূর্ণ হতে পারে তা অপু উকিল দেখিয়ে দিয়ে গেলেন।
 
সরকার দলের সাংসদেরা ইচ্ছেমত বিরোধীদল নেত্রীকে নিয়ে অশোভন উক্তি করেন। অথচ তাদের জানা উচিত যে, এতে করে তাদের সম্মান মোটেও বৃদ্ধি হচ্ছে না। আর বিরোধী নেত্রীর বিরুদ্ধে নোংরামি করে খালেদা জিয়ার সম্মানহানি হচ্ছে না বরং তার প্রতি অনেকেরই সমর্থন বাড়ছে।
 
প্রাসঙ্গিকভাবে  উদাহরণ দেয়া যেতে পারে বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও প্রগতিশীল দেশ অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের । রাষ্ট্রীয়  বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে গিলার্ডের জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছিল। সম্প্রতি বিরোধীদলের এক নেতা ও মিডিয়ার এক সঞ্চালক তাকে ও তার বয়ফ্রেন্ডকে  নিয়ে ব্যক্তিগত কটুক্তি ও হেনস্তা করায় বিরোধীদল তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে।

বিরোধীনেতার  ক্ষমা চাওয়া  এবং মিডিয়া সঞ্চালকের চাকরি থেকে বরখাস্ত হওয়ার  মধ্য দিয়ে এ যাত্রা রক্ষা পেলেও জুলিয়া গিলার্ডের জনসমর্থন কিন্তু নিঃসন্দেহে উন্নতি হয়েছে। নারীরাই তার পাশে এগিয়ে এসেছেন সবার আগে।

প্রশ্ন হলো সংসদে বসে আমাদের নারী সাংসদদের দিনের পর দিন এরকম কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে "এক্সপাঞ্জ" করা ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কোনরূপ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার আদৌ কোনো আইন আছে কি না? একের পর এক নোংরামি করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই দিন দিন অশোভনতার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদের এইসব অধিবেশনকে অবিলম্বে ১৮+ ঘোষিত করা উচিত। কারণ, অন্তত সুরুচিপূর্ণ জনগণ রেটিং দেখে তাদের সন্তানদের হিংসা, গালিগালাজ, নোংরামি, কুরুচির হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে সমর্থ হবে।
 
জাতির মানসম্মানের তোয়াক্কা না করে নেত্রীদের গুডবুকে নাম তোলার প্রতিযোগিতায় যারা নেমেছেন তারা নোংরা গালাগালি, একে অপরকে আক্রমণ, মারামারি, অশালীনতা ছাড়া কিছুই কি দিতে পেরেছেন? নিজের সন্তানের সাথেও কি এভাবেই অশালীন ভাষায় তারা কথা বলে থাকেন? নারী স্বাধীনতার পক্ষে বড় বড় ডায়লগবাজি করতে দেখা যায়, এর নামই কি নারী স্বাধীনতা? কুরুচিপূর্ণ ভাষার প্রয়োগের নাম কি বাক-স্বাধীনতা?  

যদি সংসদে দাঁড়িয়ে এইভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে নোংরা কথা বলার নাম নারী-স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতা হয়ে থাকে, তবে বিএনপি ক্ষমতায় এলে হেফাজতে ইসলামীর সাথে মিলে নারীদের স্বাধীনতার ১২টা বাজাবে কিংবা নারীদের ঘরে বন্দি করে কয়েক`শ বছর পিছিয়ে দেবে, এই অভিযোগ মোটেও ধোপে টেকে না।

আমাদের বিরোধীদলের রানু-শাম্মী-মনি এবং সরকারদলের অপুরা কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এলেও আচার-আচরণ বদলাবে না। মুখরা রমনী বশীভূত না হয়ে বরং আরো অশোভনতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাবেন। আর এর  ফলে আমাদের নারী স্বাধিনতা এবং বাক-স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবার যে প্রোপাগাণ্ডা চলছে তা অর্থমন্ত্রীর ভাষায় আসলে "বোগাস"  ও "রাবিশ" বলেই প্রমানিত হবে। কারণ, এইসব  নারী সংসদেরাই হলেন এসব প্রপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে জ্বাজ্বল্যমান উদাহরণ। আর তাই তো “ওনারাই” হলেন বাংলাদেশের সমগ্র নারী জাতির স্বাধীনতা ও বাক-স্বাধীনতার মূর্ত প্রতিক।

জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" বিষয়ে এমএস শেষ করে অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে বাংলাদেশের "খাদ্যনীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১৩
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।