একটি গল্প দিয়েই শুরু করছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের তিন সপ্তাহ পর আমি গ্রামে বাবা-মার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, এ জন্যই শিক্ষকতা পেশা আমার এত পছন্দ। কারণ এ পেশায় কোনো ক্লাসিফিকেশন নেই। এই যেমন আপনি আর আমি দু’জনেই শিক্ষক। কিন্তু পুলিশ ও মাজিস্ট্রেট সমান নয়। যেমন তারা পদে সমান নয়, তেমনি তাদের দায়িত্ববোধ, মূল্যবোধ, মানিবকতা ও আচরণ সমান না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ, মূল্যবোধ, মানিবকতা ও আচরণ সমান না হলে কোনো জাতিই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেনা। বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও দরিদ্র দেশের অর্থনীতির পক্ষে সবাইকে সমান সুযোগ ও উপর্যুক্ত চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করা, রাষ্ট্র তথা সরকারের পক্ষে সত্যিকার অর্থেই কঠিন কাজ। তবে দেখার বিষয় হলো রাষ্ট্র বা সরকার এ বিষয়ে কতটা আন্তরিক। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের সব সরকারই এ বিষয়টিতে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করা যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তেমন তাদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। বিগত দুই দশক ধরে বেসরকারি উদ্দ্যোগে কিছু কর্মসংস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পনার অভাবে তা বিকশিত হতে পারেনি। সরকারিভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বরাবরই অস্বচ্ছতা, স্বজনপ্রীতি, আর্থিক লেনদেন ও দলীয়করণের ব্যাপক অভিযোগ শোনা যায়। এভাবে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ও অদক্ষ ব্যক্তি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ পেয়ে নীতি নির্ধারণী স্থানে চলে যাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে তারা তাদের অদক্ষতা ও অযোগ্যতাকে আড়াল করতে অতিরিক্ত দলীয় আনুগত্য লাভের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এ দলীয়করণের মহড়া দেশটাকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে, যার প্রতিচ্ছবি হিসেবে আমরা দেখি আম রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চরম বিশৃঙ্খলা আর অপব্যবস্থাপনা।
আমি পেশায় একজন শিক্ষক। রাষ্ট্র, রাজনীতি, দলীয়করণ, আমলাতন্ত্র, আইন -আদালত ও বিচার-ব্যবস্থাপনা ভালো না বুঝলেও শিক্ষক হিসেবে আমার করণীয় কী, ছাত্র-ছাত্রীরা আমার কাছ থেকে কি প্রত্যাশা করে এবং রাষ্ট্রের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা কতটুকু তা আমার মাথায় খুব ভালোভাবে থাকা উচিত। কেননা, আমি নিজ জ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। এই পেশা আর দশটি পেশার মতো গতানুগতিক ও চমকপ্রদ নয়। যদি সত্যিই এ বাস্তবতা জেনে আমি শিক্ষকতাকে বেছে নিয়ে থাকি, তাহলে আমার খুব ভালোভাবেই বোঝার কথা আমি কী, আর কি কি আমার করা উচিত নয়। এখন প্রশ্ন হলো- আদৌ কি আমরা ভালোবেসে মনে প্রাণে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি, নাকি রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলার খপ্পরে পড়ে বা নিতান্তই জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে বাধ্য হয়েছি? ইদানিং প্রায়ই শোনা যায়, কেউ কেউ তথাকথিত সুশীল সমাজে নাম লেখানোর জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে কাড়িকাড়ি টাকা ঠেলে দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির বিষাক্ত সিঁড়ি বেয়ে মহান এ পেশাকে কলুষিত করছেন।
গত দুই দশক ধরে জাতীয় রাজনীতির তল্পিবাহক তথাকথিত উচ্ছিষ্টভোগী বুদ্ধিজীবী অথবা ভোট ব্যাংক তৈরির মেকানিজম হিসেবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাইকারি হারে দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগের প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ টিকিয়ে রাখা এখন চ্যালেঞ্জ। দিনদিন এ ধারা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলছে। ইতোমধ্যেই সাদা (সাদা-১, সাদা-২),নীল (নীল-১, নীল-২, নীল-৩), সবুজ, হলুদ ও গোলাপি দলে বিভক্ত হয়ে পদ পদবির ভাগিদার ও হালুয়া-রুটির লড়াইয়ে অনেকদূর অগ্রসর হলেও মৌলিক গবেষণা ও শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে।
শিক্ষকতা পেশায় আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করার দৃশ্যপট পর্যালোচনায় শুধু এটুকু বলতে চাই, শিক্ষকরা দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিপনায় জড়িয়ে পড়ার পেছনে শিক্ষকদের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও প্রায় সব সরকারের পুশ ও পুল ফ্যাক্টর নামক বিষটোপ বেশি দায়ী বলেই মনে হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি স্তরের শুরু থেকেই এ সমস্ত পুশ ও পুল ফ্যাক্টর প্রথা বেশ কার্যকর। কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা, নিয়োগ বাণিজ্য, স্কুল-কলেজের দলীয় গভর্নিং বডির সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান প্রধানের দলীয় সরকারের প্রতি অতিমাত্রায় নগ্ন চাটুকারিতা, ভিন্নমতের শিক্ষকদের প্রাপ্য পদন্নোতি না দেওয়া, যোগ্যদের সঠিক মূল্যায়নের অভাব ইত্যাদি হতাশা থেকেই অনেক শিক্ষকগণ দলীয় গ্রুপ বা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। আমার স্বল্প সময়ের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় অনেক মেধাবী শিক্ষককে এ সমস্ত হতাশার শিকার হয়ে দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে তাদের সৃজনশীল প্রতিভাকে বিসর্জন দিতে দেখেছি। এছাড়া অন্য পেশার সাথে শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধার ব্যাপক ও বিস্তর ব্যবধান অনেকাংশে দায়ী। সম্প্রতি সময়ে শিক্ষকদের অতিমাত্রায় দলীয় মনোভাব শিক্ষার্থীদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টির পেছনে বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
দলীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগের প্রভাব যেন হায়েনায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষকরূপী নরপশুদের লোলুপ দৃষ্টি যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর। পত্রিকার পাতায় যার প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি। দেশের নামকরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন শিক্ষকদের ছাত্রী হয়রানি নিত্য ঘটনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার্যকর যৌন নিপীড়ন নীতিমালার অভাবে ও দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে অপরাধীরা খুব সহজেই এত বড় ধিক্কারজনক অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। যার প্রভাব দিনদিন বেড়েই চলছে। আর এ জঘন্য অপরাধের গ্লানি সমগ্র দেশের শিক্ষক সমাজকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
অপরদিকে, দেখা যাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় শিক্ষার্থী দিয়ে শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন। গুটিকয়েক হায়েনারূপী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে জিম্মি করে রেখেছে। এটা কিসের নমুনা? একটা জাতির অবক্ষয়ের নিদর্শন এর চেয়ে ভয়াবহ আর কি হতে পারে। শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কারও জন্যই এটা শোভনীয় নয়। জাতির প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে ছাত্র-শিক্ষককের সম্মিলিত ঐক্যের বন্ধনের ইতিহাস যেন বিনষ্ট না হয় এ জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে আরও সতর্ক হওয়া জরুরি। মেধা ও যোগ্যতা মূল্যায়নের পাশাপাশি চারিত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। আমরা আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন ও ছাত্রী ধর্ষণের খবর শুনতে চাই না।
সাধুবাদ জনাতেই হয়, প্রায় এক লাখ অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণের মতো যুগান্তকারী ও চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপের। শিক্ষাখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে প্রাথমিক মাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্তরের শিক্ষকদের দাবির প্রতি সন্মান জানিয়ে আলোচনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সীমাবদ্ধ সম্পদের মধ্যেও স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় কিছু কিছু সমস্যার ফলপ্রসূ সমাধান প্রয়োজন। আশা করি জাতির কর্ণধার শিক্ষক সমাজ সম্মিলিতভাবে প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়ে বর্তমান সমস্যার মূলোৎপাটন করে স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবার প্রাণবন্ত করে তুলবেন। জাতির নিউক্লিয়াস শিক্ষকরা মুক্তচিন্তা, সৃজনশীল ভাবনা ও রাজনৈতিক আদর্শ, ব্যক্তিগত দর্শন লালন ও চর্চা করতে করবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে অবশ্যই তাদের খেয়াল রাখা উচিত মুক্তচিন্তা ও রাজনৈতিক দর্শন যেন শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। আমরা যে আদর্শেই বিশ্বাসী হই না কেন, মনে রাখতে হবে ছাত্র-শিক্ষক কোনো ভিন্ন সত্তা নয়, কোনো রাজৈনতিক প্রতিপক্ষ নয়, ঐতিহাসিকভাবেই আমরা একে অপরের ঘনিষ্ট সহযাত্রী, পরিপূরক ও নির্ভরশীল ঐক্যের বন্ধন। শিক্ষার্থীদের আরও সহনশীল ও বিনয় প্রয়োজন। প্রয়োজন সহিষ্ণুতা, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, বিনয় ও আন্তরিকতা।
শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির বাইরে এসে শিক্ষা ও গবেষণা কাজে মনোনিবেশ যেমন জরুরি, তেমন দেশের সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধান মনোনয়নে অতি দলীয় ও বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়োগের পরিবর্তে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্র তথা সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকার প্রয়োজন। তবেই শিক্ষকদের অধিকাংশই দলীয়করণের বিষবাষ্প থেকে বেরিয়ে ‘দলীয় শিক্ষক’ না হয়ে ‘শিক্ষক’ হিসেবে নিজেদের স্বকীয়তা মেলে ধরতে আগ্রহী হয়ে উঠবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: ড. মো. নজরুল ইসলাম প্রান্তিক। সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা, বাংলাদেশ। বর্তমানে জাপান সোসাইটি ফর দি প্রমোশন অব সায়েন্স (জেএসপিএস) পোস্ট ডক্টোরাল ফেলো হিসেবে ইউনিভার্সিটি অব টোকিওতে সমুদ্রের পরিবেশ ও বাস্তব্যবিদ্যার উপর উচ্চতর গবেষণারত।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর