জীবন ছুটছে, সভ্যতা ছুটছে, সময় ছুটছে- কিছুই থেমে নেই, থামার সুযোগও নেই। থামলেই মৃত্যু, এই সত্য জেনেও যে থেমে যেতে চায় তাকে বোকাই বলতে হবে।
পৃথিবীর সঙ্গে সাইবার যোগাযোগ শুরুর আগেই বাংলাদেশ বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছিল সাবমেরিন কেবল-এ যুক্ত না হয়ে। সে সময়ের শাসককূল বাংলাদেশের গোপন তথ্যাদি পাচার হয়ে যাওয়ার ভয়ে দেশকে পিছিয়ে দিয়েছিল কয়েক দশক। আমরা এখনও সে দূরত্ব অতিক্রম করতে পারিনি। অথচ পাশের দেশ ভারত সে সুযোগ নিয়ে আমাদের ছাড়িয়ে গেছে বহুদূর।
রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের সামান্য ভুল আমাদের কতোখানি ক্ষতির কারণ হতে পারে তার সবচে’ বড় উদাহরণ হতে পারে এটি। কিন্তু আমরা তো ভুল থেকে শিখি না, তাই বার বারই রাষ্ট্রের ভুল এ ভূখণ্ডের মরা জনগণের ওপর খাড়ার ঘা হয়ে ওঠে, আর আমরা ক্রমশঃ আরো মৃত হই।
কিন্তু মৃত হলে কী হবে? আত্মার যে মৃত্যু নেই, আত্মা তো অবিনশ্বর, তাই আমরা ন হন্যতে হয়ে জীবিত হয়ে উঠি, অধিকারের জন্য লড়ি এবং অনেক সময়ই সামান্য হলেও অধিকার ছিনিয়ে আনতে পারি, এনেও থাকি।
যেমন এই সময়ের আলোচনায় আমরা আমাদের জীবনে অনলাইন গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বলতে পারি যে, আমরা এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে আজ এক নতুনতর সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, যে সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের ভয়ঙ্কর চোখও আমাদের এড়িয়ে যেতে সাহসী হয় না, কারণ অসংখ্য জীবিত আত্মা অর্থাৎ জনগণ এই অনলাইন গণমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে প্রতিবাদী হতে পারে এবং বিশ্বের কাছে নিজের অধিকার আদায়ের দাবিটুকু পৌঁছে দিতে পারে।
ইদানিং প্রায়ই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় যে, বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম কতোটুকু এগুলো? বিশেষ করে এতোগুলো টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র এদেশের সংবাদমাধ্যমকে কোন্ মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারলো, সে বিষয়ে বিষদ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বোধ করি। হয়তো হচ্ছেও, হয়তো আমার চোখে সেটা পড়েনি। তাই এই বিশ্লেষণ সম্পূর্ণই আমার নিজস্ব বিবেচনাবোধ দিয়ে তৈরি করা।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম এক স্বাধীন সময় পার করছে, এই সত্য যারা অস্বীকার করেন বা করতে চান তাদেরকে বলার কোনো শব্দ আমার জানা নেই। হয়তো তাদের নিজস্ব কোনো ব্যাখ্যা থেকে থাকবে।
তবে গণমাধ্যমকর্মী মাত্রেরই জানা আছে যে, একদা যে চাপ (সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ও বেসরকারি অপশক্তির) তাদেরকে সইতে হয়েছে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় পত্রিকা অফিসে ফোন করে কী ধরনের লেখা প্রকাশিত হচ্ছে তার খবর নিয়ে সেগুলো জোর করে না ছাপানোর জন্য যে ধকল সম্পাদকদের পেতে হয়েছে তা আজকের দিনে আর হচ্ছে না। এটা এক ধরনের স্বস্তি বটে।
অপরদিকে, রিপোর্ট করতে গিয়ে সহিংসতার শিকার হওয়ার ঘটনাও বিগত সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সাংবাদিক বন্ধুরা বিষয়টি আরো বিস্তারিত বলতে পারবেন। কিন্তু সাদাচোখে দেশের গণমাধ্যমের এই স্বাধীনতা অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগেরই দিকনির্দেশনা দিচ্ছে, সন্দেহ নেই।
এক্ষেত্রে মিডিয়া হাউসগুলোর নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী বা কোনো নেতিবাচক শক্তির কাছে বিবেক বন্ধক রেখে থাকলে তার দায় নিশ্চয়ই গোটা গণমাধ্যমের নয়। সুতরাং, এখন আর প্রশ্নটি এমন নয় যে, গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি না?
বরং এখনকার প্রশ্ন হচ্ছে, গণমাধ্যম সময়মতো সংবাদটি গণ-এর সমানে তুলে ধরতে পারছে কি না? এক্ষেত্রে আমরা সংবাদপত্রের চেয়ে টেলিভিশনকে দ্রুততর বলে ধরেই নিয়েছি এবং তা সত্যও।
কিন্তু টেলিভিশন যেহেতু ছবি-নির্ভর সেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে যাওয়া ঘটনার ছবি তাৎক্ষণিকভাবে ধারণ করা যায় না বলেই তা প্রকাশে টেলিভিশন ব্যর্থ হয় বা বলা ভালো অনীহা প্রকাশ করে থাকে। সংবাদপত্রে ঘটনাটি হয়তো পরের দিন রিপোর্ট আকারে প্রকাশিত হয়।
কিন্তু এক্ষেত্রে যারা আমাদের একেবারে টাট্কা ও গরমাগরম খবরটি দিয়ে বাধিত করে তারা হলো অনলাইন মিডিয়া। অনলাইন মিডিয়ার ব্যপ্তি বিশাল, যার ভেতর অনলাইন ডেইলি থেকে শুরু করে ব্লগ, সোস্যাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদিকে যুক্ত করা যায়। আজকের আলোচনায় কেবল অনলাইন ডেইলিকেই রাখতে চাই।
বাংলাদেশে অনলাইন দৈনিকের বয়স খুব বেশি নয়। যদিও এই শুরুর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বেশ আগেই। কিন্তু অল্প সময়েই অনলাইন দৈনিক যে অবস্থানে নিজেকে টেনে এনেছে তা বিস্ময়কর।
আগেই বলেছি যে, এদেশে শুরুতেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। যেমনটি এদেশের মানুষকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ঠিক তেমনটিই হয়েছিল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও।
কিন্তু ইংরেজি শিক্ষা যেমন থেমে থাকেনি তেমনটি ইন্টারনেটের ব্যাবহারও থেমে থাকেনি। বরং ইংরেজি শিক্ষার চেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা দ্রুততা ও নিষ্ঠা দেখিয়েছে অনেকটাই বেশি। আজকে দেশে কম করে হলেও উল্লেখ করার মতো দশটি অনলাইন ডেইলি রয়েছে এবং সেগুলোর ব্যবহারকারীর সংখ্যা কয়েক কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।
মোবাইল ফোনের সুবাদে এদেশে অনলাইনে সংবাদপত্র পাঠকের সংখ্যাও কোটি ছাড়িয়েছে বলে বিশ্বাস করি। যদিও এ নিয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য সমীক্ষা পাওয়া যায়নি আজ অবধি। সে যা হোক, অনলাইন গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এখন আর কেউ প্রশ্ন তোলে না এটাই এই সময়ের বাস্তবতা। এই বাস্তবতা অর্জনে খুব দীর্ঘ সময় পাড়ি দিতে হয়নি সত্য, কিন্তু তাই বলে এই গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে যে খাটুনি কম গেছে তা বলা যাবে না।
আমার এই বক্তব্যকে যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য আমি আজকের (২৯ জুন ২০১৩) বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.ডট কম থেকে কিছু সংবাদ বিশ্লেষণ করতে চাইছি। যেহেতু আজকে সকালে প্রায় ৭টি জাতীয় দৈনিক (ইংরেজি ও বাংলা) পড়েছি এবং সকালের টেলিভিশন চ্যানেলগুলির প্রচারিত সংবাদও দেখেছি, সেহেতু আজকের অনলাইন ডেইলি’র সংবাদের সঙ্গে সেগুলোর তুলনা আমার জন্য সহজ হবে। যেমন আজকে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে, কি টেলিভিশন, কি সংবাদপত্র, কি অনলাইন মিডিয়া, সর্বত্রই আলোচনার বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা বাতিল।
খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু অস্বীকার করার জো নেই। বাংলানিউজ বিষয়টি শিরোনামে এনেছে। সেই সঙ্গে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান জোসেফ ক্রাউলি, যিনি কিনা বাংলাদেশ ককাসের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও, তার বক্তব্য হাজির করেছে, যা আমি কোনো সংবাদপত্র বা টেলিভিশন সংবাদে দেখিনি।
এই যে তাৎক্ষণিকতা, এটাই অনলাইন মিডিয়ার সবচে বড় সম্পদ, যা সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের পক্ষে চাইলেও দেখানো সম্ভব নয়।
বিগত ৪ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলো যে রকম সোচ্চার ছিল তা এদেশে নির্বাচনী সংবাদ প্রকাশে গণমাধ্যমকে অনেক বেশি সাবালকত্ব এনে দিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও অনলাইন সংবাদপত্রগুলি এগিয়েছিল অনেক, মানুষ প্রথমেই নির্ভর করে এদের ওপর তাৎক্ষণিক সংবাদটি জানার জন্য। যদিও ফল প্রকাশের সময় অনলাইন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন একই সঙ্গে কাজটি করে দেখাতে পেরেছে।
অপরদিকে, প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন ভার্সনও জনগণকে আপডেট রাখতে সক্ষম হয়েছে সদ্য-সংবাদ দিয়ে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করা গেছে গণমাধ্যমগুলোর ভেতর। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ও আখেরে জনগণই উপকৃত হয়েছে।
মোটকথা- টেলিভিশন, অনলাইন দৈনিক বা জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন ভার্সন - সবকিছুই আসলে এদেশের গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করে তুলছে নিজেদের মতো করেই এবং সবদিক দিয়েই লাভবান হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের ভোক্তা অর্থাৎ জনগণই।
আমার বিশ্বাস, প্রযুক্তির সঙ্গে সভ্যতার সম্পর্কের এই মেলবন্ধনে গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষই এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। ফিরে আসি বাংলানিউজ২৪ডটকমের আজকের কয়েকটি সংবাদ পর্যালোচনায়।
কেউ যদি গভীরভাবে লক্ষ্য করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে, আজকের এই ভার্সনে একজন সংবাদপত্র পাঠকের জন্য যা যা প্রয়োজন তার প্রতিটি বিষয়ই রয়েছে। সাধারণতঃ সংবাদপত্রে যেব বিষয় প্রাধান্য পেয়ে থাকে যেমন রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সংবাদ, খেলাধুলা ইত্যাদি সবকিছুই এতে গুরুত্ব পেয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রের উপসম্পাদকীয়’র মতো এতে বিশ্লেষণী লেখাও জায়গা করে নিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা বোধ করি বঞ্চিত হচ্ছি সম্পাদকীয় থেকে।
আমার মনে হয় বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম-এর সম্পাদক আলমগীর হোসেন বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন যে, প্রতিদিন কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর সম্পাদকীয় প্রকাশ করা যায় কি না।
এতে অনলাইনটির চরিত্র নির্দিষ্ট হবে এবং তাতে প্রকাশিত সংবাদে পাঠকও বিভ্রান্ত হবে না।
টেলিভিশনগুলোর ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য, তাতে তাদের নিজস্বতাই দর্শকের কাছে প্রতিষ্ঠিত হবে।
যা হোক, শেষ করার আগে যা বলতে চাই তাহলো, বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে যদি আজকের বাস্তবতায় দেখি তাহলে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
এক. অনলাইন ডেইলি, যা থেকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর তাৎক্ষণিক সংবাদ পেয়ে থাকেন এবং সঙ্গে তাদের আগ্রহমতো অন্যান্য বিশ্লেষণও; দুই. টেলিভিশন, সংবাদ ও তার ছবি এবং সেই সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ, যা মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে অনেক বেশি; তিন. জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্র, যেগুলো থেকে ভোক্তা পাঠককূল সংবাদের বিস্তারিত জানতে পারেন।
অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন যে, এই তিনের প্রতিযোগিতায় কে টিকে থাকবে আর কে টিকবে না তাইই হবে আগামী দিনের সংবাদমাধ্যমের যুদ্ধ।
আমি অবশ্য এ বিষয়ে একটু সনাতনপন্থি, সেই প্যাপিরাসের আমল থেকেই মানুষ তথ্যের জন্য বার বারই আধুনিক হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করতে করতে আজ ইন্টারনেটে এসে ঠেকেছে। হয়তো আগামীতে এর চেয়েও কোনো উন্নত প্রযুক্তি যোগ হবে। কিন্তু তাতে কি পত্রিকার (প্যাপিরাস থেকে পেপার) গ্রহণযোগ্যতা খুব বেশি কমেছে?
হ্যাঁ, বাণিজ্যিক লাভ-লোকসানের হিসাবে পিছিয়েছে একটু, কিন্তু মানুষ সে পথ ভোলেনি। আবার ইন্টারনেটের কল্যাণে অনলাইন দৈনিকও জনপ্রিয়তায় সমানতালে ছুটছে টেলিভিশনের সঙ্গে।
যে কারণে আগেই বলেছি যে, সংবাদমাধ্যমে যে কৌশল বা প্রযুক্তিই যোগ হোক না কেন, তা মানুষের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনবে, এর শেষ উদ্দেশ্য মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা, যা আজকের পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়া সমানতালে সমানভাবে করে যাচ্ছে। এই প্রচেষ্টাকেই আমাদের সাধুবাদ জানানো উচিত, এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে নিজেকে ‘আপডেট’রাখাটাই আসলে সভ্যতা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক, masuda.bhatti@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ০০২০, ০১ জুলাই, ২০১৩
এডিএ/জেডএম