রাজনীতিতে আবার নতুন করে এরশাদের দোয়া করার সময় এসে গেছে। ’৯০ এর পর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তার দোয়া করতে হয়।
দীর্ঘ প্রায় এক দশক দেশ শাসন করার পর আন্দোলনের মুখে এরশাদ ক্ষমতা ছাড়েন। ক্ষমতা ছাড়ার পরও তিনি প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনেই ব্যক্তিগতভাবে জয়ী হয়েছেন। ক্ষমতা ছাড়ার পরের নির্বাচনেও (২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১) তার দল ৩৫টি আসনে জয়ী হয়েছে। ঐ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোটের হার ছিল প্রায় ১২% যেখানে বিএনপির ছিল ৩০.৮১% ও আওয়ামী লীগের ছিল ৩০.০৮%।
আসনের দিক দিয়ে যতো কমই হোক না কেন, জাতীয় পার্টির নির্দিষ্ট একটি ভোট ব্যাংক দেশে আছে। যদিও পরিসংখ্যান মতে জাতীয় পার্টির চেয়ে জামায়াতের ভোট আরো বেশি ছিল। ‘৯১ থেকে ৯৬তে জাপার ভোট আরো বেড়েছে (১৬.৪০%)। বর্তমানে জামায়াতের ভোটের চেয়ে জাপার ভোট বেশি। তাই জাতীয় রাজনীতিতে এরশাদের দোয়া-ই সবচেয়ে বেশি জরুরি।
দোয়া চাওয়ার বিষয়টি কেবল ভোট বা সংসদে প্রাপ্ত আসনের ওপর নির্ভর করে না। কার জোট কত বড় সেটাও বিবেচ্য। ১৪ দলের বিপক্ষ বিএনপি ১৮ দলীয় জোট খাড়া করিয়েছে। এর বিরুদ্ধে হয়তো আওয়ামী লীগ আবার ২৮ দলীয় জোটও সৃষ্টি করতে পারে। যদিও দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে ৪০টির মতো। তার মানে এই সব জোটের মধ্যে নিবন্ধন করেনি এমন দলও আছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মধ্যে এরশাদের দলও আছে। নামে ১৪ দল হলেও তাদের প্রত্যেকে বাকি ১৩ দলের নাম ঠিকানা জানেন কিনা তা নিয়ে ১৮ দলের সন্দেহ আছে। আবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের ক্ষেত্রেও ১৪ দলের একই সন্দেহ।
১৪ দলের ভেতরে যেমন এক-সদস্যবিশিষ্ট বাম দলের নেতা আছেন, তেমনি ১৮ দলেও সাইনবোর্ড সর্বস্ব ডানপন্থী আছেন।
বড় দলগুলোর কাছে এইসব নামসর্বস্ব দলগুলোর ভোটের গুরুত্ব নাই। তবে এক ধরনের রাজনৈতিক গুরুত্ব তো আছেই। সেকারণেই বড় দলগুলো নির্বাচনের আগে আগে যেসব দলের রাজনৈতিক ও ভোটের গুরুত্ব আছে তাদেরকে তোয়াজ করে। এরশাদের কাছে দোয়া চাওয়ার বিষয়টিও সেরকম।
বলা যায়, তিনি যাকে দোয়া করবেন তিনিই যাবেন ক্ষমতায়। তাঁর আখেরি দোয়া যিনি পাবেন তিনিই পাঁচ বছরের জন্য গদিতে বসে অন্য সবাইকে দোয়া ও আশীর্বাদ করার সুযোগ পাবেন। পাঁচ বছর শেষ হওয়ার আগে আগে আবার দোয়া নেওয়ার জন্য সকাল থেকে শেষ রাত পর্যন্ত তার দরবারে হাজির হবেন বাঘা বাঘা নেতা, আমলা, উকিল, অধ্যাপকসহ নানা শ্রেণি-পেশার সুধিজনরা। তার আখেরী দোয়া-ই ক্ষমতায় যাবার আসল দাওয়াই!
তাই ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে জাতীয় দলের মহাসচিব পর্যন্ত সবাই তার নেক নজর পাবার আশা করেন।
উল্লেখ্য, তিনি নিজে কখনো যেচে দোয়া দিতে যান না, সবাই-ই বরং তার দোয়া নিতে কাতারবদ্ধ হয়।
তাঁর এই দোয়ারও বিভিন্ন রকমফের আছে। আখেরি বা মহাদোয়া দেওয়া হয় জাতীয় নির্বাচনের আগে। নব্বইয়ের পর যারা গদির ছোঁয়া পেয়েছেন তারা তাঁর দোয়া নিয়েই তা পেয়েছেন।
আখেরি দোয়া ছাড়াও তাঁর ভাণ্ডারে আছে উপদোয়া, স্থানীয় দোয়া ইত্যাদি। মূলত দেশে যতো ধরনের নির্বাচন আছে এরশাদকে ততো ধরনের দোয়াই করতে হয়।
জাতীয় নির্বাচন হলে তাকে জাতীয়ভাবে কাউকে না কাউকে আশির্বাদ করতে হয়। আবার উপনির্বাচন হলে উপদোয়া আর স্থানীয় নির্বাচন হলে স্থানীয় দোয়াও আছে।
তাঁর এই দোয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে-একবার নয়, একাধিকবার। অথাৎ তাঁর দোয়ায় কাজ হয় এটা পরীক্ষিত।
এই যেমন, গাজীপুরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে। তাই এক প্রার্থী দোয়াত-কলম নিয়ে ভোরবেলায় আরেক প্রার্থী টেলিভিশন নিয়ে সন্ধাবেলায় তাঁর দরবারে দোয়াপ্রাথী হয়েছেন।
প্রথমেই তার দরবারে হাজির হয়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রপ্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান। খান সাহেব সোমবার সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে মহা-আশা নিয়ে যান মহাশয়ের বাসায়। সকাল সকাল তিনি গেছেন, কারণ মহাশয় কখন আবার বের হয়ে যান। জিসিসির এই প্রার্থী ১৪ দল সমর্থনপুষ্ঠ। এই ১৪ দলের মধ্যে মহাশয়ের দলও আছে।
যাই হোক, জিসিসির খান সাহেব ১৪ দলের সমর্থনপুষ্ঠ হলেও বাস্তবে তিনি নিজেকে অপুষ্ট মনে করেন। খান থেকে গাজিপুরের কিং-খান হতে হলে মহাশয়ের দোয়া চাই। তাই তিনি তার দোয়াত’র (দোয়াত-কলম) জন্য দোয়া নিতে গেছেন মহাশয়ের কাছে।
এরশাদও তাকে শুধু দোয়া দিয়েই বিদায় করে দিয়েছেন। পাশাপাশি আজমত উল্লাহর প্রশংসাও করেছেন। আজমত উল্লাহও এরশাদ যে তাকে দোয়া করেছেন সে বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন।
শুধু বাসা নয়, কোথাও বেড়াতে গেলেও নিস্তার নেই এরশাদের। সবাই তাকে নিয়ে টানাটানি করে। সবাই তাঁর একটু একান্ত সাক্ষাত চায়।
এই তো সেদিন, এরশাদ গেলেন তারই দলের আশীর্বাদপুষ্ট এক নেতা দেশের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী কাজী সাহেবের বাসায় (কাজী জাফর আহমেদ)। কাজী সাহেবের জন্মদিনে তাকে আশীর্বাদ করতে। সেখানে অন্য অনেকে গেছেন দাওয়াত খেতে। দাওয়াতিরা বুঝি আগেই টের পেয়েছিলেন যে এরশাদ সেখানে যাবেন। তাই দাওয়াতের ভুরি ভোজ সেরে একফাঁকে মির্জা (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) সাহেব এরশাদকে নিয়ে উধাও। কামরা বন্ধ করে মির্জা সাহেব একান্তে দোয়া চাইলেন এরশাদের কাছে! মির্জা ফখরুল কি জাতীয় (নির্বাচনের জন্য) দোয়া চাইলেন নাকি স্থানীয় (জিসিসি নির্বাচন) দোয়া চাইলেন সেটা জানা যায়নি।
আইনজীবী আজমত উল্লাহর একদিন পরেই এরশাদের দোয়া নিতে গেলেন অধ্যাপক মান্নান সাহেব। একান্তভাবে দোয়া চাওয়ার পর মান্নান সাহেব মহাশয়ের দরবার থেকে বাইরে এসে দাবি করেছেন, মহাশয় তাকে দোয়া ও দাওয়া (সমর্থন) দুটোই দিয়েছেন। আর আজমতকে দিয়েছেন শুধু দোয়া।
অধ্যাপক সাহেব বুদ্ধিমান। তাই তিনি দোয়া ও দাওয়া দুটোর দাবিই করেছেন। তিনি ভাবলেন, মহাশয় দিল-দরিয়া লোক, আমি যদি দাবি করি তাহলে তিনিতো আর এসে তার বিরোধিতা করবেন না।
এভাবেই দেশের বড় বড় আইনজীবী-অধ্যাপকরা এরশাদের দোয়া নিতে আসেন। গদিনসীন থাকা অবস্থায় এরশাদ মাঝে মধ্যেই বিশেষ কারো দোয়া নেওয়ার জন্য প্রমত্তা পদ্মাও পাড়ি দিয়েছেন। তাই দোয়ার মর্যাদা তিনি বোঝেন।
তবে তিনি যাদেরই দোয়া করেন তাদের কেউ তাদের ওয়াদা রক্ষা করেন না। এরশাদ সেরকমই দাবি করেন। তাই এবার তিনি দোয়াপ্রাপ্ত সরকারের ওপর নাখোশ হয়েছেন। তার দোয়া নিয়ে সবাই গদিতে বসে, কিন্তু গদির ভাগ দেয় না। গদিতো অনেক পরের কথা, খোঁজ খবরও নাকি রাখেন না। তাই তিনি সাফ বলে দিয়েছেন, আমি আর কাউকে দোয়া করবো না। এবার আমি নিজেই দোয়া প্রার্থী হবো। জাতীয় নির্বাচনে তিনি তাঁর দলের ৩০০ দোয়াপ্রার্থী দাঁড় করাবেন। তাদেরকে যেন জনগণ দোয়া করেন এটাই তাঁর প্রার্থনা। তাই তিনি মনস্থির করেছেন আর দোয়া নয়! এবার আমিই সবার দোয়া চাই!
তাই জিসিসি নির্বাচনে তিনি কাকে দোয়া করেন সময়ই বলে দেবে। পাশাপাশি আগামী জাতীয় নির্বাচনে তিনি কি কাউকে দোয়া করবেন নাকি নিজেই সকলের দোয়াপ্রার্থী হবেন সেটাই দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর