দুঃসংবাদটি দেয় ফেরদৌস, ফোনে। ঋতুদার সঙ্গে ফেরদৌসই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে।
ঋতুদা নেই। ঋতু নেই? আমার কাছে কেমন অবিশ্বাস্য লাগে! ততক্ষণে এসএমএস, ফোনে নানান জায়গা থেকে খবর। অনলাইনে নিউজ। টেলিভিশনে স্ক্রল যাচ্ছে। কোনো কিছুতেই আমার চোখ নেই, মন নেই। কেমন যেন শূন্য এবং ফাকা লাগে। মনে হয়, কে যেন নেই, কি যেন নেই। খালি খালি লাগে।
আর কোনো দিন ফেরা হবে না? কোনো দিন আর ফিরবে না মানুষটা? আবার ভেতরে শূন্যতা ও হাহাকার। ক্রন্দন ও আর্তচিৎকার।
আর কোনো দিন ফিরবে না, মানুষটা!
আর কোনো দিন না?
আর কোনো দিনই না!
মোবাইল বন্ধ ছিল পুরো একদিন। ঢাকার মিডিয়া রীতিমতো পাগল করে আমাকে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, অনলাইন নানা জায়গা থেকে ফোন! উৎকট, অনাকাঙ্ক্ষিত ফোন।
‘ঋতুপর্ণ ঘোষকে নিয়ে একটা স্মৃতিকথা লিখুন। আপনার সঙ্গে শুনেছি সম্পর্ক ছিল। একসঙ্গে ছবি আছে আপনাদের? ছবি থাকলে ছবিও দিয়েন। আর কোথাও লিখছেন না তো? আমরা চাই, শুধু আমাদের এখানেই লিখুন। ’
আমি শুধু শুনি, ছোট্ট করে বলি ‘দেখি’। আর কিছুই বলি না। বলতে ভালো লাগে না, ইচ্ছে করে না। ব্যক্তিগত সবকিছু কি লিখতে হবে, একান্ত ব্যক্তিগত বলে কি কিছুই থাকবে না? সব কি বিকোতে হবে, বাজারে! সবই কী খুলতে হবে? দেখাতে হবে খুলে? নিজের বলে কী কিছু থাকতে নেই? আমি লিখি না। লিখতে চাইও না। লিখবও না ভাবি।
দেশ পত্রিকা খুব সুন্দর প্রচ্ছদ করেছে। সংবাদ প্রতিদিনের রোববার, ঋতুদার সম্পাদনায় প্রতি রোববার বেরুতো, অসাধারণ সংখ্যা করেছে তারা। সংগ্রহে রাখবার মতো। সংগ্রহে আছেও আমার। ইংরেজি পত্রিকাগুলোও তাই।
শ্রদ্ধার কমতি করেনি জানাতে, এই মহান মানুষটিকে। কিন্তু এই শ্রদ্ধাঞ্জলির ফাঁকে ফাঁকে, মাঝে মাঝে, কী কী যেন শুনি। চারপাশে কিসের যেন গুঞ্জন, কানাকানি। কান না পেতেও কানে আসে আমার। ঋতুপর্ণ ঘোষ কী পুরুষ ছিল নাকি নারী। নাকি নারী-পুরুষ দুটোই ছিল। তবে কী হিজড়ে ছিল ঋতুপর্ণ। কেউ কেউ ঋতুকে সমকামীও বলতে শুনেছি। আবার অনেকে বলেছেন, ঋতু ট্রান্সজেন্ডার, পুরুষ থেকে রুপান্তরিত নারী। যার যা খুশী বলছে, মন্তব্য করছে। ঋতুকে নিয়ে রীতিমতো বিতর্ক চলছে, খুব ক্লিষে বিতর্ক, বিতর্ক স্রেফ ঋতুর ‘লিঙ্গ’ নিয়ে!
আমার খুব চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ঋতু সমকামী না, রুপান্তরকামী না, হিজড়ে না, নারী না, পুরুষ না, ঋতু কোনোটিই না। ঋতু মানুষ ছিল। শুধু মানুষ। মানবিক একজন মানুষ। প্রচলিত জীবনের বোধ ও যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করে যে মানুষ দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। দাঁড়াতে পেরেওছিলেন যিনি। তিনিই ঋতুপর্ণ ঘোষ। এই বামন সমাজে ঋতু অতিকায়, যার উচ্চতা আকাশ ছোঁয়া, ফলে ঋতুকে আমাদের কাছে কদাকার লাগার, ভাবার যথেষ্ট কারণ ও সুযোগ রয়েছে।
ঋতু বরাবরই চাপাপড়া, ঢেকে রাখা, না বলা, রাখঢাক করা যৌনতার গোপনীয়তা ভেঙেছেন। ভেতরকার তীব্র যৌন অবদমনকে বাইরে নিয়ে এসেছেন। মনে আছে অন্দরমহলের (২০০৫) কথা? শুরুতেই সঙ্গমদৃশ্য। নপুঃসক জমিদার স্বামীর পুত্রবাসনা পূরণের জন্য তার দ্বিতীয় স্ত্রী যশোমতীকে প্রতিরাতে যন্ত্রণাকাতর সঙ্গমের শিকার হতে হয়। দৃশ্যটি বেদনার, যৌন উত্তেজনার নয়।
যৌনতা ও শরীরকে তিনি প্রয়োগ করেছেন পুরুষতন্ত্র, তার নীতিনৈতিকতা, অবদমন এবং নারী-পুরুষবাচক বাইনারি লিঙ্গীয় পরিচয়ের পাঁচিল ভাঙার অস্ত্র হিসাবে। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ কিংবা ‘আর একটি প্রেমের গল্প’ ছবিগুলোর কথাও নিশ্চয়ই মনে আছে। প্রচলিত আর্ট ফিল্মের বাধা ছাঁচের বাইরে গিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ দেখিয়েছেন ভিন্নমাত্রার এক সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন।
চিত্রাঙ্গদা ঋতুপর্ণ ঘোষের সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছবি। ছবির বহু দৃশ্যে ঋতু আর যিশু সেন গুপ্ত পরস্পরকে আদর করছেন, চুমু খাচ্ছেন। লিঙ্গ পরিবর্তনের অপারেশন টেবিলেও যাচ্ছেন। অপারেশনের মাধ্যমে হয়ে উঠতে চান, পুরুষ থেকে নারী। কিন্তু হন না, শেষাবধি।
যৌনতার আধুনিক তত্ত্ব বলে, দুনিয়ায় আদতে সমকামী-বিসমকামী বলে কোনো মেরু নেই। সকলের মধ্যেই লেসবিয়ান, গে এবং রুপান্তরকামী আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। হোমোসেক্সুয়াল বনাম হেটেরোসেক্সুয়ালের দ্বিমেরু বিভাজন নিতান্তই অর্বাচীন।
১৯২০ সালের আগে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতেও ‘হোমোসেক্সুয়াল’ শব্দটি ঢোকেনি। হোমো গ্রিক শব্দ, সেক্সুয়ালিটি লাতিন। দুয়ে মিলে ওই হাঁসজারু শব্দ। আসলে, প্রত্যেকেই নিজের শরীরকে অদম্য ভালোবাসে, কিন্তু স্বীকার করতে চায় না। নারী কিংবা পুরুষের স্বমৈথুন তার এক অসাধারণ প্রমাণিত উদাহরণ। নিজেকে ভালোবাসার জৈবনিক ইচ্ছে চাপা দিতেই লোকে সমকামিতা, রুপান্তরকামিতা নিয়ে আতঙ্কে ভোগে। ছবিতে ঋতুপর্ণ তাই জরুরি এক প্রশ্ন তোলেন। জন্মগত শরীর নিয়ে আমরা যদি সুখী হই, তা হলে ছেলেরা চুল, নখ কাটে কেন? মেয়েরা কান বেঁধায় বা উল্কি কেন আঁকে?
এই ছবি শুধু হোমোসেক্সুয়ালিটি বা রুপান্তরকামিতা নিয়ে নয়। ছবির শেষে যীশু এবং রাইমার বিয়ে। তারপর মাদকাসক্ত হয়ে ঋতুপর্ণের কাছে টাকা চাইতে আসেন যীশু। ঋতু চেক দেন এবং এক থাপ্পড় মারেন। ভিন্ন যৌনতাকে অকারণ ভিক্টিম বানায়নি ‘চিত্রাঙ্গদা’ বরং তাকে জয়ের মুকুট পরিয়েছে।
বস্তুত শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না। বরং জেন্ডারকে একমাত্র মহান শিল্পীরাই অতিক্রম করে যেতে পারেন। যেটি অতিক্রম করতে যে মহত্ব, মানবিকতা, বিপুল বিস্তারিত যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করা দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন হয়, তা ঋতুর বরাবরই ছিল। যৌনতা, যৌন-অযৌন সম্পর্ক, অবদমন, সমকামিতা, রুপান্তরকামিতা এমন কি মৈথুন, স্বমৈথুন এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে আমার কথা হতো না, আড্ডা হতো না ঋতুর সঙ্গে। ‘সংখ্যালঘু যৌনতা’ নামে একটি খসড়া পান্ডুলিপি তাকে পড়তে দিয়েছিলাম। যেখানে মুক্ত যৌনতা, যৌনতার স্বাধীনতা, যৌন আচরন এবং অধিকারের বিষয়গুলো ছিল। ঋতু মুগ্ধ হয়েছিল, জড়িয়ে ধরেছিল, বলেছিল বইটির মুখবন্ধ নিজেই লিখবেন। ঋতু নিজেই বলেছিলে ‘শিল্পীকে যে তার জেন্ডার অতিক্রম করে যেতে হয় সেটা অনেক আগেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি। সামাজিক লিঙ্গ আমার পরিচয় নয়। শিল্পীর কোনো জেন্ডার হয় না, এটা বাবা-মা, ই আমাকে শিখিয়েছিলেন। ’
জেন্ডার চেঞ্জ, ট্রান্সজেন্ডারশিপ নিয়েও কথা হয়েছিল ঋতুর সঙ্গে। ঋতু নিজেই বলেছেন, ‘আমি কোনো দিনই নিজেকে পুরোপুরি নারী মনে করতে চাইনি। হতেও চাইনি। ছোটবেলা থেকেই তো প্রচুর টাকা রোজগার করেছি রে বাবা! অনেকে সেক্স চেঞ্জ করাতে চেয়েও পারে না টাকার কারণে। আমার তো, তা হয়নি কখনো। বিজ্ঞাপনে যখন কাজ করতাম, এখন যা করি তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা রোজগার করতাম। কিন্তু সচেতনভাবে সেক্স চেঞ্জ করা থেকে দূরে থেকেছি। প্রচলিত জেন্ডার আইডেনটিটি থেকে বের হয়ে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেও পেরেছি আমি। ’
আসলেই তাই, ঋতু নিজেকে প্রচলিত যৌনতার, নারী-পুরুষের সীমাবদ্ধ সীমারেখার ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। কিছু নির্দিষ্ট শব্দের মধ্যে আমরা নিজেদের বন্দী করি ‘নারী’, ‘পুরুষ’, ‘সমকামিতা’, ‘অসমকামিতা’ এর বাইরেও জগত ও জীবন আছে। সেই জীবনেও ইচ্ছা, বাসনার ওড়াওড়ি, উৎযাপন থাকে। থাকুন না তা, তার মতো করে।
ঋতুর আবরণ ও আভরণ নিয়েও কথা উঠেছে। নিতান্ত মূর্খ না হলে বোঝা উচিত, ঋতু বেশ বছর কয়েক ধরেই ‘ইউনিসেক্স’ পোশাক পড়তেন। যেটি কামিজ, সালোয়ার নয় প্যান্ট শার্ট নয়, আবার পাঞ্জাবি, পাজামাও বলা যাবে না তাকে। যেটি একান্তভাবেই ‘ঋতুর পোশাক’, যা কেবল মানায় ঋতুকেই। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মেয়েরা ছেলেদের শার্ট-প্যান্ট কিংবা যে কোন উপাদান গ্রহণ করলে সেটি ততটা নিন্দনীয় নয়, যতটা ভয়ংকর নিন্দনীয় কোন ছেলে যদি মেয়েদের কিছু গ্রহণ করে।
প্রচলিত রীতি ও সংস্কার ভাঙা, যৌনতার কৃত্রিম সীমারেখা অতিক্রম করা মানুষ নিয়ে চিরকালই কুতর্ক হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখবেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ সমাজ বদলায় না, দু’চার জনই বদলায়, ধাক্কা দেয়, থাপ্পর দেয় সমাজকে। রীতিমতো ভিত নাড়িয়ে দেয়।
যত অশ্রাব্য, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যই শুনি, এখন আর আমি মন খারাপ করি না। করি না এই ভেবে যে, সমাজে আমরা বাস করি তা নিতান্ত ইতর, অসভ্য ও অমানবিক। এখানে মানুষের মূল্য নেই, নেই মানবিকতার মূল্য। এখানে মানুষের চেয়ে ‘লিঙ্গ’ বড় ও প্রধান হয়ে উঠে। একটি মানবশিশু জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই, বেরিয়ে আসতে না আসতেই, অস্থির চোখের দৃষ্টি উপুড় হয়ে পড়ে, রীতিমতো হামলা করে দেখতে, শিশুটি নারী নাকি পুরুষ! শিশুটির ‘লিঙ্গ’ কী? পুরুষ হলে উৎসব, নারী হলে বিষাদ! এ তো অনিবার্য!
যে সমাজ এমন, অসম্ভবরকমভাবে লিঙ্গ শাসিত, সেখানে নারী-পুরুষ যৌনতার সীমারেখা অতিক্রম করে যাওয়া মানুষকে নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য হবে, গুঞ্জন হবে, কানাকানি হবে, ঠাট্টা-তামাশা হবে, ইতরামি-ফাতরামি হবে, ঢিঢি করবে লোকে- স্বাভাবিক।
শুধু তাই নয়, যারা আমার মতো উদারতার কথা বলবে, প্রচলিত নারী-পুরুষের যৌনতার সীমারেখা ভাঙার সমর্থনে কলম ধরবে, তাদেরও মন্দ বলবে, ধিক্কার দেবে লোকে!
লেখক : জব্বার হোসেন
সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ- jabberhossain@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৩
সম্পাদনা: এসএএস