কয়েক বছর আগে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ড. এপিজে আবদুল কালাম ঐতিহাসিক মহাবোধি মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বোধিবৃক্ষের সুশীতল ছায়া অবলোকন করে বলেছিলেন- পৃথিবীর শান্তির স্থান এ মহাবোধি মন্দির।
গত ৬-৭-২০১৩ আলো ফোটার আগেই ধারাবাহিকভাবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয় তথাগত বুদ্ধের বোধিপ্রাপ্তির স্থানে- যা সমগ্র বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণের কারণ হয়েছে। রোববার ভোর সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে পরপর মোট নয়টি বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দির চত্বর। আহত হন বুদ্ধের শিষ্য যারা ভোরের আলোয় শান্তির জন্য প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেছিল। এ ঘটনায় কোনো সন্ত্রাসীগোষ্ঠী দায় স্বীকার না করলেও বিস্ফোরণের পেছনে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের হাত রয়েছে বলে বিহার পুলিশের সন্দেহ। অবশ্য দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে- মহাবোধি মন্দিরে মুজাহিদিনের সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে বিহার পুলিশকে আগেই সতর্ক করেছিল তারা। তা সত্ত্বেও কেন পুলিশ এমন একটি মহাজনগুরত্বপূর্ণ স্থানে, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বুদ্ধভক্তের ভিড় সবসময় লেগেই থাকে, সেখানে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা কেন নেয় হলো না? তা নিয়ে নানা প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। অবশ্য ইতিমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেনÑ ‘আমাদের যৌথ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সকল ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। ধর্মীয় স্থানে এ ধরনের আক্রমণ বরদাস্ত করা হবে না। ’
বুদ্ধগয়ার এ মহাবোধি বৃক্ষের নিচে বসে তথাগত বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে এ মন্দিরকে ঘোষণা করেছে। তথাগত বুদ্ধের পরিনির্বাণের তিনশত বছর পরে বৌদ্ধ সম্রাট অশোক এ মহাবোধি মন্দির নির্মাণ করে বুদ্ধের বুদ্ধত্বলাভের স্থানকে স্মরণীয় করে রাখেন। ভারতে বৌদ্ধধর্ম পতনের পর শঙ্করাচার্য মহাবোধি মন্দিরের ক্ষতিসাধন করেছিলেন এবং বোধিবৃক্ষটি ধ্বংস করেন। তিনি এ অপকর্মের পরে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে আমরা ইতিহাসে পেয়ে থাকি। পরবর্তীতে শ্রীলংকার অনুরাধাপুর থেকে শ্রীমহাবোধি শাখা এনে রোপণ করেন। এটি দ্বিতীয় বোধিবৃক্ষ। প্রথম বোধিবৃক্ষের শাখাটি থেকে সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা একটি শাখা নিয়ে শ্রীলংকায় অনুরাধাপুরে রোপণ করেছিলেন, যা এখনো অতি যতেœর সাথে রক্ষিত আছে। বিশ্ববিখ্যাত প্রতœতত্ত্ববিদ আলেকজান্ডার কানিংহাম উক্ত মহাবোধি মন্দির ও বোধিবৃক্ষটি আবিস্কার করেন। এরপর থেকেই বিশ্ববৌদ্ধরা এ স্থানকে পুণ্যতীর্থ হিসেবে দলে দলে ছুটে আসে। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহার, প্যাগোডা ইত্যাদি।
গত রোববারের হামলায় মহাবোধিবৃক্ষের পার্শ্বে এবং মূল মন্দিরে আঘাত হানে বলে জানা গেছে। তবে মহাবোধি বৃক্ষের পাশে রাখা বুদ্ধের পদচিহ্ন বিজড়িত সপ্ত মহাস্থান, প্রথম বোধিপলল্ক, দ্বিতীয় অনিমেষ চৈত্য, তৃতীয় সংক্রমণ চৈত্য, চতুর্থ রতœঘর, পঞ্চম অজয়পাল ন্যগ্রোধ বৃক্ষ, ষষ্ঠ মুচলিন্দ মূল, সপ্তম রাজায়তন বৃক্ষসহ এ সপ্তস্থান বিদ্যমান।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধগয়া মন্দির পরিদর্শনে গিয়েছিলেনÑ সেদিন তিনি মন প্রাণ উজাড় করে বুদ্ধকে প্রণাম নিবেদন করেছিলেন। বুদ্ধগয়ায় গিয়ে বুদ্ধের স্মৃতিপূত গয়াকে দেখে কবির মনে হয়েছিল যেদিন বুদ্ধ সশরীরে গয়াতে ভ্রমণ করেছিলেন, সেদিন যদি তিনি জন্মগ্রহণ করতেন সমস্ত শরীর ও মন দিয়ে যদি বুদ্ধের লাবণ্যপ্রভা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেতেন তাহলে তার জীবন ধন্য হত। তাই তিনি বুদ্ধের শরণ প্রার্থনা করে লিখেছিলেনÑ
‘পাষাণের মৌণতটে যে বাণী রয়েছে চিরস্থির ,
কোলাহল ভেদ করি শত শতাব্দীর
আকাশে উঠিছে অবিরাম
অমেয় প্রেমের মন্ত্র--বুদ্ধের শরণ লইলাম। ’
এখন সবার প্রশ্ন কেন মহামানব তথাগতের স্মৃতিবিজড়িত শান্তির সুমহান আবেদনময় স্থানকে আক্রমণের জন্য বেছে নিলেনÑ কেন এ ন্যক্কারজনক অসভ্য হামলা? এ করে কি লাভ জঙ্গিবাদীদের? পৃথিবীতে শান্তি, মৈত্রী, বোধ ও বোধির টিকে থাকার সম্ভাবনা এতই ক্ষিণ হয়ে আসে কেন? পৃথিবী কি অসভ্যদের অধীনে চলে যাবে? শান্তিকামী মানুষের জিজ্ঞাসাÑ বুদ্ধ মানব সন্তান- তাঁর আবিষ্কৃত ধর্ম মনুষ্যত্বের সুদৃঢ় সজ্জিত অলঙ্কার। মানুষের গুণাবলি নির্ভর কোন সম্পদ যদি থেকে থাকে গৌরবে বরণীয় তবে তা ঐ বোধের স্রোতধারারই যা বুদ্ধের অস্থিমজ্জা নিংড়িয়ে এসেছে মানুষের জন্য মানুষের শ্রেষ্ঠ উপহার হয়ে- তা রোধ করতে চায় যারা তারা এ দুর্লভ মানব জন্ম পেয়েও মানুষ হবে না? তাদের জন্যেই তো প্রবাহিত হয় আজো বুদ্ধের মৈত্রী করুণা বিগলিত হৃদয়- তাতে তারা সিক্ত হবে না?
সবশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলিÑ
হিংসায় উন্মুখ পৃথ্বি, নিত্যনিঠুর দ্বন্দ্ব
ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভ জটিল বন্ধ ।
দেশ দেশ পরিল তিলক রক্ত কলুষ গ্লানি,
তব মঙ্গল শঙ্খ আন, তব দক্ষিণ পাণি-
তব শুভ সংগীতরাগ, তব সুন্দর ছন্দ।
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য
করুণাঘন, ধরণীতল কর কলঙ্কশূন্য॥
ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয়: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন
বাংলাদেশ সময়: ১১২৩ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৩