শুধু গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনই নয়, আগের মাসে আরো চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ফলাফল প্রচার করতে গিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিযোগিতায় ঘাম ঝরিয়েছে।
সেই প্রতিযোগিতা সুস্থ কি অসুস্থ সে হিসাব মেলাতে গিয়ে আমাদের গণমাধ্যমজগতের বোদ্ধারা সমালোচনা-আত্মসমালোচনারও আর এক প্রতিযোগিতায় সামিল হয়েছেন।
কিন্তু আমাদের উপরমহলের বোদ্ধা ব্যক্তিরা যখন সমাধানের পথটি না চিনিয়ে কাদা ছুঁড়তে নিজের শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করেন তখন মনবল হারাই। বিশেষত গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পর থেকে অনলাইনে মন্তব্য প্রতিবেদন এবং মতামত হিসেবে বেশ কয়েকটি লেখা নজরে এসেছে।
আর সেখানে কোন লেখায় যখন কী ধরনের ভূল, কী কারণে ভুল, ভুলের প্রতিক্রিয়া কী অথবা ভবিষ্যৎ ভুলের হাত থেকে বাঁচতে করণীয় সম্পর্কে না লিখে প্রতিপক্ষকে হিংস্র পশুর মতো আক্রমণের গন্ধ ছড়ানো হয় তখন তা গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না।
খুলনা সিটি করপোরেশন এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচনপূর্ববর্তী সময় থেকে নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচনপরবর্তীকালেও মাঠ পর্যায়ে কাজের সুযোগ হয়েছিলো। একজন রিপোর্টার হিসেবে রাতদিন জেগে মাঠ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সর্বশেষ খবরটি অফিসকে জানানোর চেষ্টা করি। কিন্তু মাঠে থাকতেই যখন টিভি স্ক্রিনের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য সম্পর্কে দর্শকরা বিরক্তি এবং ক্ষোভ জানিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন করেন, তখন ঢাকার এয়ার কন্ডিশনড নিউজরুমের দায়িত্বরত ব্যক্তিটিকে সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। পারি না, দূর্ভাগ্য আমাদের। নানাভাবে দর্শকের প্রশ্ন ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যেতে হয়।
কিন্তু অক্লান্ত পরিশ্রম করে গাজীপুর সিটির নির্বাচন শেষ করে ৭ জুলাই যখন অফিস হয়ে রাতে বাসায় ফিরলাম, তখন নিজেকে ব্যর্থ আর অথর্ব বলে মনে হচ্ছিল। আমি যে বাসায় সাবলেট থাকি, সেই বড় ভাইয়ের সঙ্গে রাতে খাবার টেবিলে বসলে তিনি প্রথমে বললেন, “খুব পরিশ্রম হয়েছে এই ক’দিন তাই না? কিন্তু এটা আপনারা সবাই কী করলেন? ছিঃ ছিঃ Ñ ছিঃ! বিরক্ত হয়ে আমি টিভি দেখাই বন্ধ করে দিচ্ছি। ”
খুব কষ্টে খাবারটা গলা দিয়ে নামানোর পর আমতা আমতা স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে ভাই বলেন তো?”
বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিমায় তিনি বললেন, “সব টিভি চ্যানেল উল্টাপাল্টা রেজাল্ট দেওয়া শুরু করছে। কেউ একবার অনেকক্ষণ কোন আপডেট দেয় না। আবার কেউ একলাফে দেখায় ফাইনাল হিসাব। কিছুই বুঝি না। ”
ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পেরে আর কথা বাড়ালাম না। শুধু মনে মনে ভাবলাম, এই মানুষটি অথবা তার মতো সাধারণ দর্শকরা যদি জানতেন আমরা কোন জায়গা থেকে, কীভাবে এই ফলাফল ঢাকায় জানাই, তাহলে হয়তো এতো রাগ থাকতো না তার। আবার একই সঙ্গে সেই গুমোর ফাঁস হয়ে গেলে মিডিয়াকর্মী বা মিডিয়ার প্রতি এতো আস্থা-বিশ্বাসও কমে যেতে পারে- সেই ভাবনাটাও কাজ করলো। কিন্তু পরদিন থেকে যেসব লেখালিখি হয়েছে, তাতে অনেকেই জেনে গেছেন অসমর্থিত সূত্র আর বেসরকারি সূত্রের আদ্যোপান্ত।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ফলাফল প্রচার নিয়ে একই দিনে দু’টি লেখা প্রকাশ পায় বাংলানিউজে। লেখা দু’টি পড়ে খুবই আশ্বস্ত হই যে, মাঠের বাস্তবতাটা অনেকেই হয়তো এবার গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে শুরু করবেন। হিসাবের তারতম্য থাকলে যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে সে বিষয়টিও লেখাগুলোতে উঠে এসেছে।
ফল প্রকাশের রাতে আজমত উল্লা খানের বাসার নীচে আমরা ক’জন রিপোর্টার অপেক্ষা করছি। এমন সময় আজমত উল্লাহ খানের সমর্থক দু’জন ছাত্রলীগ নেতা এসে জিজ্ঞেস করলেন, ভাই খবর পাইছি, অবস্থা নাকি আরো ভালো হইছে? নতুন ৫টা কেন্দ্রে ভাই নাকি আগায় আছে অনেক ভোটে? খোজ নেন না একটু!
তাদের এমন আগ্রহে আমাদের মুখ যেনো কালো হয়ে যায়। পরে আমরা রিপোর্টাররা সেই আলোচনাটাই শুরু করি। সত্যি সত্যিই যদি এখন টানা আজমতউল্লাহ খান এগিয়ে যেতে থাকেন, তাহলে তো মহাবিপদ। টিভি চ্যানেলগুলো যে হারে এগিয়েছে, তাতে ফলাফল বাস্তবে যদি অন্যরকম হয় তাহলে দর্শককে বিশ্বাস করানো সম্ভব হবে না।
তখনই কিন্তু আমাদের সবার মধ্যে একটি বিষয় অনুভূত হয় যে, ফলাফল জনসমক্ষে প্রচার বা প্রকাশের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য এবং দায়িত্বশীল সূত্রের আশ্রয় নিতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
দর্শককে তো দেওয়া চাই সবার আগে সর্বশেষ খবর। এই মানসিকতায় বিভোর থেকে একটি কথা মনে হয় আমরা ভুলেই যাই, কোন তথ্য প্রকাশে দর্শকের মধ্যে কী প্রভাব-প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে।
খুব খোলাসা করে বলতে চাই, মাঠে কর্মরত অবস্থায় আমাকে যদি যে কোন মূল্যে সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল বের করতে বলা হয়, তবে নানা অসমর্থিত সূত্র থেকে সেই কাজটা আমি বা আমরা যারা মাঠে থাকি করতে পারবো। কিন্তু সেই ফলাফল টিভি পর্দায় দর্শককে জানানো কতোটা দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দেবে সেটি মনে হয় বিবেচনা করা উচিৎ।
কারণ, খুলনার কথা মনে পড়ে। রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে একটি নিউজ চ্যানেলের একজন রিপোর্টার বড় ভাই, খানিকক্ষণ পরপর এসে জিজ্ঞেস করছিলেন, “কয়টা দিয়েছো”? যথারীতি আমি যে কটি কেন্দ্রের হিসাব পেয়েছি তাকে জানাচ্ছিলাম। একই সঙ্গে আশপাশে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা বিভিন্ন সূত্রে সর্বোচ্চ যে ক’টি কেন্দ্রের খবর পাচ্ছিলেন সব বলছিলেন। সেই রিপোর্টার বড় ভাই সর্বোচ্চ যে হিসাবটি পাচ্ছিলেন সেটাই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ঢাকায় জানাচ্ছিলেন।
এখন এ ধরনের তথ্য সরবরাহ শেষ বিচারে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা ভেবে দেখা উচিৎ। বিভিন্ন উৎস এবং সূত্র থেকে তথ্য নেওয়া হলে এক এক টেলিভিশন এক এক রকম হিসাব দিতে থাকবে। কোনভাবেই তা থেকে পরিত্রাণ মিলবে না। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমার মত হলো- যতো দেরিতেই হোক, রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যই একযোগে সব গণমাধ্যমে প্রচার এবং প্রকাশ করা হোক। যে কথাটা চ্যানেল আইয়ের বার্তা সম্পাদক এবং সময় টেলিভিশনের বার্তা প্রধানের লেখায় খুব স্পষ্ট করে এসেছে। তাদের দু’জনের অভিমত-বিশ্লেষণের পরবর্তী আর একটি লেখার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক আক্রমনে ঠাসা সেই রচনা থেকে ভুল শুধরে নিয়ে কোন পথে চলা উচিৎ সেই পথনির্দেশ পাইনি। তবে, দুর্বল সাংবাদিকতার যে সংজ্ঞাটা সেখানে দেওয়া হয়েছে, সেটা সংবাদপত্র না কি টিভি সাংবাদিকদের জন্য জানতে ভীষণ ইচ্ছে হয়। যে কোন রিপোর্ট যখন একাধিক বিশেষজ্ঞ এবং কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে তৈরি করি, তখন কোন একটি লাইনে বা বাক্যে ‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন’ ব্যবহার করে থাকি। সেটা ব্যবহার করলেই কি আমি দুর্বল সাংবাদিক হয়ে যাবো?
সবল সাংবাদিক হওয়ার জন্য কি ভয়েসওভারে জনাব অমুক এবং অধ্যাপক তমুক আরো বলছেন- ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়? যাই হোক সাংবাদিকতা শেখার জন্য কর্মক্ষেত্র, বই, প্রশিক্ষণ আর দর্শকের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাদের অনেকেরই ভাগ্য ভালো যারা নিউজরুমে বসে থেকে দর্শকের প্রতিক্রিয়াগুলো সরাসরি পান না।
তবে, আমাদের বোদ্ধা ব্যক্তিদের কাছ থেকে শুধু এটুকুই আশা করবো, তারা যেনো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে গিয়ে আক্রমনাত্বক হয়ে না ওঠেন। সমালোচনা সমাধানের পথ তৈরির জন্য কিন্তু আক্রমন আর পাল্টা আক্রমনের মধ্যে কোন পথনির্দেশ নেই। সমালোচনাকে যারা কাদা ভাববেন, তারা কিন্তু আরো কাদা ছড়ানোর কাজে লিপ্ত হবেন। তাদের থেকে নিরাপদ দূরে থেকেই আমাদের একটি সর্বসম্মতিতে আসতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনাগুলোকে একত্র করে আমাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা বসে ভোটের ফলাফল প্রকাশের বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌছুলে আমরা রিপোর্টাররা স্বস্তি পাবো। অপেক্ষায় থাকছি সেই সিদ্ধান্তের।
সঞ্জীব রায়, সংবাদকর্মী: royratan.sanjib@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, জুলাই ১০, ২০১৩
জেডএম/