‘কলুষিত হচ্ছে ভাষা ও সাংবাদিকতা’ শিরোনামে ১০ জুলাই বাংলানিউজ২৪.কম-এ লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর, ফোন ও ই-মেইলে অনেক সহকর্মী, স্বজন, বন্ধু আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সবার একটাই কথা, এ ধরনের লেখা যেন আরো লিখি।
তারপরও ভাষার কথা বিবেচনা করে গতানুগতিক এবং কমন কিছু ভুল নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আর কেন এ ধরনের ভুল হচ্ছে সেটিরও ব্যাখ্যা দিতে চাই।
শুরু করতে চাই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে লেখা এটিএন নিউজের প্রভাষ আমিনের কিছু কথার উদ্ধৃতি দিয়ে।
তিনি লিখেছেন, সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় লেখাটির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অন্তত অন এয়ারে দেওয়ার আগে সবাইকে আরো অনেক বেশি সতর্ক থাকা দরকার। প্রয়োজনে অভিধান দেখে ঠিক করে নিতে হবে। কারণ, আমাদের অ্যাস্টন বা টিকার দেখে হয়তো কত শিশু ভুল বানান শিখছে। তার দায় কে নেবে? সে হয়তো তার স্কুলে বা বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক করবে, এই বানান আমি অমুক টিভি বা পত্রিকায় দেখেছি। আমার সব বানান ঠিক, এমন দাবি করবো না। তবে আমি ছাপা বা অন এয়ারের আগে তা ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা করি। আমি সব ব্যাকরণ জানি না, তবে ভুল বানান দেখলে চোখে লাগে। আপনি যা লিখেছেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে তা করার চেষ্টা করি। অনেক বকাঝকা করি। তাতে কিছু কাজ হয়, কিছু হয় না। যাদের বকা দেই, তারা হয়তো আড়ালে উল্টো আমাকেই বকা দেয়।
বাস্তবতাও তাই। টেলিভিশন যেহেতু দেখার এবং শোনার মাধ্যম, অতএব শোনার মত যা আছে তা অবশ্যই শুদ্ধ ও পরিচ্ছন্নভাবে উপস্থাপন করা উচিত। আর টিকার যেহেতু সারাক্ষণ চলে, সেহেতু এর বানান শতভাগ শুদ্ধ করতে হবে।
অনেক মজার একটি ব্যাপার হচ্ছে, আহ্বান শব্দটির উচ্চারণ বেশিরভাগ প্রেজেন্টার ও রিপোর্টার ভুলভাবে উপস্থাপন করছেন। বলছে আহব্বান। আসলে এর উচ্চারণ আওভান। আহ্বায়ক-কে বলছে আহব্বায়ক। সঠিক উচ্চারণ হবে আওভায়ক। এটি যেসব সাংবাদিক জানেন না, তাদের অন্তত: টেলিভিশন সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিত। কেননা দেশের প্রতিটি রাজনীতিক, একেবারে টপ টু বটম সবাই এ দু’টি শব্দকে বলছেন তাদের জ্ঞানে, “আহব্বান ও আহব্বায়ক”।
একই নিয়মে বিহ্বলকে (বিওভল) বলছে বিহব্বল। জাতির কি দুর্ভাগ্য!
আমার সাত বছরের মেয়ে যে নাকি ক্লাস ওয়ানে পড়ে, তাকেও এই আহ্বান শব্দটি সঠিকভাবে শেখাতে পারি না। ও আমাকে উত্তর দেয়, বাবা তুমি একা বললেই তো হবে না। তুমি যে খবর দ্যাখো, সেখানে তো শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া সব সময় আহব্বান বলেন। অন্য যারা, সবাইও তাই বলে। আমি ওকে বোঝাতে পারি না।
আমি ব্যর্থ হয়ে কেবলই ভাবি, এই হলো বাংলাদেশের বাঙালি (শুধু বাঙালি বললে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদেরও এই দলে টানা হয়। তাই নির্দিষ্ট করে বললাম)। কোনো কিছু না জানাটা অপরাধ নয়। কিন্তু সঠিক জিনিসটি না জেনে নিজের ভুল জানাটা অন্যের মাঝে বিতরণ করাটা অপরাধ। এটি আমার ব্যক্তিগত ধারণা।
অনার্স, মাস্টার্স পাস করা মন্ত্রী, এমপি অথবা আইনজ্ঞ যদি আহ্বান শব্দের সঠিক উচ্চারণ না বলতে পারেন, যদি চ, ছ, শ, স, জ, য-য়ের ব্যবহার না জানেন তবে জাতির বড় দুর্ভাগ্য।
রাজনীতিকদের কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল। তাদের ভুল মেনে নিলাম একটি সান্ত্বনায় যে, তাদের বেশিরভাগই অর্ধশিক্ষিত বা অনেকেই আছেন কেবল নিজের নামটি সাক্ষর করতে পারেন। উচ্চারণের ক্ষেত্রে তাদের যা জ্ঞান, তা নিয়ে জাতি বা সমাজ এতো মাথা ঘামায় না।
কিন্তু যারা সাংবাদিক, যাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের পথ প্রদর্শক বলা হয়, তারা যদি চ, ছ, শ, স, জ, য-য়ের ব্যবহার না বোঝেন, তবে বলতেই হয়, জাতি বড় দুর্ভাগা। তারা যদি নিউজের টপলাইন না বোঝেন তাহলেও তা মেনে নেওয়া যায় না।
ছোট্ট দু’টি উদাহরণ দিই। এ টু জেড সব চ্যানেলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এটি।
বলা হচ্ছে, অমুক জায়গায় ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে অথবা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এটি কোন নিউজের টপ লাইন হতে পারে না। টপলাইন বা ইনট্রো মানে কি? একটি ঘটনার সংক্ষিপ্ত ফলাফল। অর্থাৎ টপ লাইনে আসতে হবে ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে, কখন ঘটেছে, কি ঘটেছে, কেন ঘটেছে এবং কিভাবে ঘটেছে । অর্থাৎ চার ডব্লিউ ও এক এইচ অর্থাৎ হোয়ার, হোয়েন, হোয়াট, হোয়াই এবং হাউ।
অন্য ভাষায় চার স্ত্রী, এক স্বামী মিলে একটি নিউজের টপলাইন হয়। সে হিসেবে উপরোল্লিখিত নিউজটি হবে, অমুক জায়গায় অমুকবার মধ্যরাতে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে লাগা আগুনে …জন নিহত ও …জন আহত হয়েছে। অথবা নিহত/আহত না থাকলে বলতে হবে ক্ষয়ক্ষতি কিছু হয়েছে কি-না সেটি।
কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই এই থিওরি মানছে না কোনো টিভি চ্যানেল। অমুক জায়গায় অমুকের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এমনও খবর পড়ছে টিভিগুলো। কি অদ্ভুত জ্ঞান আমাদের। আরে ভাই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এটি কোনো নিউজ না। হবে অমুকের সঙ্গে সংঘর্ষে তমুক মারা গেছে অথবা অমুকের সঙ্গে সংঘর্ষে তমুক দলের …জন আহত হয়েছে। যে কোনো সংঘর্ষের একটা পরিণতি থাকে না? সেটিই আনতে হবে টপ লাইনে।
একটি বিশেষ চ্যানেলের বিশেষ একজন রিপোর্টার আছেন মাশাল্লাহ। আমার মেয়েটা বলে, বাবা ওই লোক কি গ্রামে থাকে? পড়াশোনা করে নি? আমি বলি কেন বাবা? ও বলে, এত জঘন্য উচ্চারণ? আমি একটু অশুদ্ধ কথা বললে বকা দাও ক্যানো? মেয়েটাকে কিছু বলতে পারি না। তবে ভাবি, এই লোকের কণ্ঠ যদি টেলিভিশনে অন এয়ার হতে পারে, তবে নোয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রাম বা ময়মনসিংহের মানুষ নিজ উচ্চারণে কেন কণ্ঠ দিতে পারবে না? এই লোক মালিকের আত্মীয় বলেই কি টেলিভিশনের এমন অশুদ্ধ উচ্চারণের কণ্ঠ অন এয়ারে যেতে পারে? ওই রিপোর্টারকে তো ডেস্কে কোথাও বসিয়ে দিলেই হয়। মানুষকে অশুদ্ধ, বিরক্তিকর উচ্চারণ শোনাবার মানে কি?
ছোটখাট আঞ্চলিকতা সব চ্যানেলের সাংবাদিকদের মধ্যেই আছে। তবে এ সংখ্যা খুবই সামান্য। চালিয়ে নেওয়া যায়। তারপরও বলতে হয়, টেলিভিশনে আঞ্চলিকতাদুষ্ট উচ্চারণের কোনো ঠাঁই নেই। শুদ্ধ উচ্চারণ যে পারবে না, তার কণ্ঠে কোনো নিউজ প্রচার হবে না। তবে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয় না নানা কারণে। টেলিভিশনে একাধিক গ্রুপ সক্রিয় থাকে বলে ভাল কিছুই শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা সম্ভব হয় না। গ্রুপিংয়ের কারণেই যা–তা অবস্থা।
প্রিন্ট মিডিয়ায় এক যুগ কাজ করলেও টিভি লাইনে খুব বেশিদিন হয়নি আমার। টেনেটুনে ছয় বছর। কিন্তু এটুকু সময়ের মধ্যে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা বলতে গেলে অবিশ্বাস্য! এতো গ্রুপিং! একটা থাকে সিইও গ্রুপ, একটা হেড অব নিউজ, একটা এইচআর এবং একটা থাকে মালিকপক্ষ। কোন দলে যোগ দিলে চাকরিটা টিকে থাকবে বা বেশি সুবিধা পাওয়া যাবে, তা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে আকামের কিছু লোক। গ্রুপিংয়ের এই খেলায় সবচেয়ে বেশি লাভটা ভোগ করে কাজ না জানা কিছু চামচা শ্রেণির লোক।
এই দলটি কাজ ফেলে সারাক্ষণ তেলবাজিতে ব্যস্ত থাকে। সারাক্ষণ জোঁকের মত লেগে থাকার কারণে ওই ব্যক্তির ভবিষ্যতটাও ঝকমকে হয়ে যায়। ওই চামচামির পুরস্কারস্বরূপ কোনো এক সময় তাদের দেওয়া হয় নিউজ এডিটর বা এ জাতীয় কোনো পদ। যার ফলাফল, বানান আর স্ক্রিপটিংয়ের আগা-মাথা নাই। নিউজ তো নয় যেন ভুলের মুদি দোকান। কন্ঠ, উচ্চারণ ভাল না হলেও নো প্রবলেম। মালিক ভাই বা দুলাভাই হলে তো পোয়াবারো।
এ ধারা থেকে যতদিন না বেরিয়ে আসা যাবে ততদিনই একটু একটু করে কৌমার্য্ হারাবে বাংলা ভাষা। যারা কাজের লোক তাদের মূল্যায়নের জায়গাটা যতদিন না উন্মুক্ত হচ্ছে ততদিন প্রতারিত হবেন দর্শক, প্রতারিত হবেন সাধারণ মানুষ এবং মালিকপক্ষ।
এতো ছিল বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ভেতরকার ট্রেইলর। আরো ভেতরে বোধকরি না যাওয়াই ভাল।
সবশেষে না বললেই নয়, অসংখ্য ফোন এসেছে বন্ধু-বান্ধব এবং পুরনো ও নতুন শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে। সবাই বাহবা দিলেও একটা শঙ্কিত মন্তব্য ছিল সবার, এই যে এভাবে লিখলেন, ভবিষ্যতে কোথাও চাকরি পাবেন বলে মনে হয় না। মুচকি হেসে জবাব দিই, রিজিকের মালিক আল্লাহ।
সবার কাছে একটাই প্রত্যাশা থাকবে, আসুন চেষ্টা করি ভুল শোধরাবার। কাজ করতে গেলে ভুল হবেই। কাজ যারা করেন ভুল তাদেরই হয়। যিনি কাজই করেন না তার ভুল করারও প্রশ্ন আসে না। ভুলটা সংশোধনের জন্য কে কি করলাম সেটিই মোদ্দা কথা। কারণ আমাদের পেছনে দৌড়াচ্ছে কোটি কোটি শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবা। নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে যা-ই করি না কেন, তাদের ভুল শিক্ষা দেওয়ার অধিকার আমাদের কারো নেই।
আব্দুর রউফ: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, মোহনা টেলিভিশন, editorrouf@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭০১ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৩
জেডএম/জেএম