দুই গ্রামের মানুষ সব বিষয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। সবসময় নিজ নিজ গ্রামের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে চায়।
চলমান কোটা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে দুদিন আগে টক শো করলেও লেখার কথা ভাবিনি। কয়েকজন আমাকে লেখার জন্য অনুরোধ জানালেও লেখার অন্য একাধিক বিষয় মাথায় জট পাকিয়ে থাকায় অত পাত্তা দিইনি। কিন্তু আজ সকালে প্রথম আলো দেখার পর মনে হলো না লেখাটা অন্যায় হবে, মুখ বুজে থাকাটা হবে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া। আমি ভেবেছিলাম প্রথম আলোর ভুল ধরিয়ে দেয়ার কাজটি আর অন্তত প্রকাশ্যে করবো না। এর আগে প্রথম আলোর ভুল ধরিয়ে দিয়ে দুটি লেখার কারণে ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছি। সেই লেখার জন্য অনেক প্রিয় মানুষ এখনও আমার সঙ্গে কথা বলেন না। অনেকেই ভাবছেন, আমি বুঝি প্রথম আলোর বিপক্ষে। তাই যখনই প্রথম আলো কোনো ভুল করে, অনেকে ফোন করে বলেন, ভাই দেখেন কী করেছে, লেখেন। এমনকি শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফফার চৌধুরীসহ প্রথম আলো বিরোধী শিবিরের অনেকেই আমার লেখাকে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সবাইকে বলেছি, ভাই আমি তো প্রথম আলোর বিরুদ্ধে নই। আমি প্রথম আলোর পেছনে লাগতে নয়, সবসময় পাশেই দাঁড়াতে চাই। কিন্তু প্রথম আলো নিয়ে কিছু না লেখার সিদ্ধান্ত বহাল রাখতে পারলাম না। কোটাবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে প্রথম আলো যে অবস্থান নিয়েছে, আমি বিনয়ের সঙ্গে তার বিরোধিতা করতে চাই। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ব্যাপারে প্রথম আলো ছিল দ্বিধান্বিত। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে একটুও দেরি করেনি। আজ প্রথম আলোর মূল শিরোনাম ‘মেধা নয়, কোটার প্রাধান্য’। এটি লিখেছেন শরিফুল হাসান। একই দিনে উপসম্পাদকীয়তে সোহরাব হাসান লিখেছেন ‘মেধা লালন না মেধা দমন?’ ব্যক্তিগতভাবে দুজনই আমার খুব প্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপারে তাদের অবস্থান নিয়ে আমার মধ্যে কোনো সংশয় নেই। বরং দুজনই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নানা তৎপরতায় আমার চেয়ে বেশি সক্রিয়। তবুও তাদের দুজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে কোটার ব্যাপারে তাদের অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা করছি। তারা হয়তো অফিসের এসাইনমেন্টে করেছেন। কিন্তু প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের অবস্থান নিয়েই আমার আপত্তি। এটা ঠিক, এই আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়াটাই সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে জনপ্রিয়, পত্রিকার সার্কুলেশনের জন্যও লোভনীয়। কিন্তু গণমাধ্যম তো সবসময় শুধু জনপ্রিয়তার পক্ষে দাড়াবে না, যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করে তার অবস্থান নির্ধারণ করবে। প্রয়োজনে জনমত গঠন করবে। দৈনিক প্রথম আলো শিক্ষিত মধ্যবিত্তের চিন্তা-চেতনা-মনন-রুচি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই তাদের অনেক বেশি সচেতনভাবে অবস্থান নির্ধারণ করা উচিত। কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলনে প্রথম আলোর অবস্থান মানতে পারছি না। যদি এ অবস্থান স্রেফ হুজুগে হয়, তাহলে প্রথম আলো বেনিফিট অব ডাউট পেতে পারে। তবে প্রথম আলোর গত কয়েকমাসের ধারাবাহিক তৎপরতা দেখলে মনে হয় না, এটা হুজুগে সিদ্ধান্ত। তারা অনেক ভেবেচিন্তেই, জামায়াতকে সুবিধা দেয়ার জন্য এই অবস্থান নিয়েছে বলেই মনে হয়। প্রথম আলো ছাড়া আর শুধু জামায়াতে ইসলামীই এখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ সকল কোটা বাতিলের দাবি জানিয়েছে। এমনকি বিএনপিও এখন পর্যন্ত এই পপুলার আন্দোলনে সরাসরি সমর্থন ঘোষণা করেনি। বিএনপিও প্রথম আলোর মতো হঠকারী নয়। বিএনপি জানে তারা আগামীতে ক্ষমতায় আসছে। আর ক্ষমতায় আসলেও তাদের পক্ষে কোটা বাতিল করা সম্ভব নয়। তাই হয়তো তারা বিবেচনার দাবি জানিয়েই চুপ করে আছে।
বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে এক নজরে দেখে নেয়া যাক, বর্তমানে প্রযোজ্য কোটা ব্যবস্থা। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান বা নাতি-নাতনিদের জন্য, ১০ শতাংশ নারীদের জন্য, ১০ শতাংশ জেলা কোটা এবং ৫ শতাংশ উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। তার মানে মোট ৫৫ শতাংশই সংরক্ষিত। এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা আছে। তবে এই ১ শতাংশ নেয়া হয় ৫৫ শতাংশ থেকেই। আর বাকি ৪৫ শতাংশ উন্মুক্ত। প্রিয় পাঠক সাদা চোখে দেখলে নিশ্চয়ই মনে হয় খুব বৈষম্য করা হচ্ছে। কোটা থাকলে বৈষম্য, নাকি না থাকলে বৈষম্য সে আলোচনায় পরে আসছি। এতদিন বিসিএস’এর প্রিলিমিনারী, লিখিত ও ভাইবার পরে গিয়ে কোটা প্রয়োগ করা হতো। কিন্তু তাতে কোটার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রার্থী পাওয়া যেতো না। বিদ্যমান আইনে যেহেতু কোটার আসন অন্য কোনো ভাবে পূরণ করার সুযোগ নেই, তাই আসনগুলো খালিই থেকে যেতো। এবার তাই প্রিলিমিনারির ফলাফলেই কোটা প্রয়োগ করা হয়। ফলে নন কোটার শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে বঞ্চিত ভেবে রাস্তায় নেমে ক্ষোভ জানায়। বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক আন্দোলনের প্রতি আমাদের পূর্ণ সহানুভূতি আছে। এমনকি পিএসসিও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ঘোষিত ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের ঘোষণা দেয়। সবাই ভেবেছিল, পিএসসির ঘোষণার পর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে যাবে। কিন্তু পিএসসির ঘোষণার পরও যখন শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছাড়লো না; বরং ঘোষণা দিলো কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না; যখন শুনলাম শাহবাগ ‘প্রজন্ম চত্বর’এর নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘মেধা চত্বর’; কোটা বিরোধী আন্দোলনের নামে স্লোগান উঠেছে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে। ’ তখন আমার সন্দেহ হতে থাকে, এ তবে কাদের আন্দোলন? পরদিন সন্দেহটা আরো প্রকট হয়- আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখন চারুকলার ভেতর থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার মোটিফ বের করে রাস্তায় এনে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী স্লোগান দেয়, উপাচার্যের বাসায় হামলা চালায়; তখন আমরা বুঝি অন্য কোনো একটি অশুভ শক্তি এই আন্দোলন থেকে ফায়দা লুটতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কখনোই চারুকলার মোটিফে আগুন দিতে পারে না, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে পারে না, উপাচার্যের বাসায় হামলা চালাতে পারে না। প্রিয় পাঠক, আপনারা ভাববেন না, আমি অন্য অনেকের মতো আন্দোলনকারীদের ঢালাও জামায়াত-শিবির হিসাবে অভিহিত করে তাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলাকে জায়েজ করার চেষ্টা করছি। আমি বিশ্বাস করি তাৎক্ষণিক ক্ষোভ থেকে সাধারণ ছাত্ররাই রাস্তায় নেমেছিল। কিন্তু তাদের সেই ক্ষোভকে পুঁজি করে একটি মহল তরুণ প্রজন্মকে ঠেলে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে। মাস দুয়েক আগেও যে তরুণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে অবস্থান নিয়েছে, সেই তরুণই সেই শাহবাগের ‘মেধা চত্বর’এ দাড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে স্লোগান দিচ্ছে। কারণ তাকে বোঝানো হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা তোমার চাকরির পথে বাধা। ফলে তাদের কোটা বাতিল করতে হবে। আমি যদি ধরে নিই, যারা আন্দোলন করছে, তারা সবাই শিবিরের কর্মী এবং তারা আগুন জ্বালিয়ে, ভাঙচুর করে খুব খারাপ কাজ করেছে, তাহলেও তাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা চালানোর কোনো অধিকার নেই। ছাত্রলীগকে কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে। আগামী নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে, তার জন্য একক সংগঠন হিসাবে সবচেয়ে বেশি দায় ছাত্রলীগের। শুরু থেকেই রীতিমত কুড়াল নিয়ে দিনের পর দিন নৌকায় তলা কাটছে ছাত্রলীগ নামধারীরা। পাঁচ সিটিতে ভরাডুবির পর প্রধানমন্ত্রী যখন ভুল-ত্র“টি শুধরে সামনে এগোনোর কথা বলছেন, তখনও ছাত্রলীগ সর্বশক্তি নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আন্দোলন ভুল না ঠিক, যৌক্তিক না অযৌক্তিক, শিবির না ছাত্রদল সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব নিশ্চয়ই ছাত্রলীগের নয়। ভাঙচুরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেমন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তেমনি তাদের মামলা করা উচিত হামলাকারী ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধেও। একটি ফুলের টব ভাঙ্গার চেয়ে একজনকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা অনেক বড় অপরাধ।
এবার আসি কোটা প্রসঙ্গে। সাধারণভাবে ভাবলে একটি গণতান্ত্রিক দেশে, মুক্তবাজারের এই যুগে কোটা থাকার কোনো মানেই হয় না। সবার জন্য সমান সুযোগ। যে বেশি মেধাবী, সেই চাকরি পাবে। হিসাব বরাবর। কার দাদা মুক্তিযোদ্ধা, কে উপজাতি, কে নারী, কে প্রতিবন্ধী- এই বিবেচনা করার দরকার কি। কোটা দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। সবার জন্য সমান সুযোগ, কোটাহীন, বৈষম্যহীন এমন একটি দেশ, এমন একটি সমাজ বিনির্মাণই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো এমন একটি দেশ এখনও আমাদের কল্পনারও অনেক দূরে। এখনও আমাদের দেশে পদে পদে বৈষম্য। আর বৈষম্য সৃষ্টি করতে নয়, বৈষম্য দূর করতেই প্রচলন হয়েছে কোটা ব্যবস্থার। কোটা ব্যবস্থা নতুন কিছু নয়, বাংলাদেশের প্রায় সমান বয়সী। ১৯৭২ সালে একটি সাম্যের সমাজ গড়তে, অনগ্রসর-পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠিকে মূলধারায় আনতেই কোটা ব্যবস্থার প্রচলন। তাহলে আজ এতদিন পর হঠাৎ কেন কোটা বাতিলের আন্দোলন? আমার ছেলে দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপিঠ সেন্ট যোসেফ স্কুলে পড়ে। গাড়িতে চড়ে দুই মিনিটে স্কুলে পৌছে যায়। স্কুল শেষে কোচিং, বাসায় শিক্ষক, নোটবই, ভালো খাওয়া, উন্নত চিকিৎসা, সুস্থ বিনোদন, হাওয়া বদল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট- গোটা বিশ্ব আসলে তার হাতের মুঠোয়। কিন্তু রাঙামাটির বরকলে আমার কোনো চাকমা বন্ধুর ছেলেকে তো স্কুলেই যেতে হয় ১০ মাইল পাহাড়ি পথ বেয়ে। এত কষ্ট করে যে স্কুলে যায়, সে স্কুলে নিশ্চয়ই ভালো শিক্ষক নেই। হয়তো স্কুলে যায় পান্তা খেয়ে, ফিরে কোনোরকমে পেট পুড়ে খায়। পুষ্টির বালাই নেই, বিনোদনের বালাই নেই, প্রযুক্তির হয়তো চেহারাই দেখেনি। তাকে লড়তে হয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে, দারিদ্রের বিরুদ্ধে। তার ৬০ নাম্বার তো আমার বিবেচনায় আমার ছেলের ৯০ নাম্বারের চেয়ে বেশি মূল্যবান। উপজাতি কোটা না থাকলে তো সারাজীবন আমাদের ছেলেরাই চাকরি পাবে, আমার চাকমা বন্ধুর ছেলেকে পরে থাকতে হবে সেই পাহাড়েই। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, জেলা কোটা তুলে দিলে বাংলাদেশের ৪টি জেলার মানুষ ৯০ ভাগ সুযোগ পেয়ে যাবে। বাকি ৬০ ভাগ জেলার শিক্ষার্থীদের তখন আন্দোলনে নামতে হবে। ৪ জেলাই বা বলি কেন, আসলে তখন ঢাকার সেরা ২০ স্কুলের শিক্ষার্থীরাই দখল করে নেবে অধিকাংশ আসন। ঈশ্বরপ্রদত্ত মেধা থাকুক আর না থাকুক, শহুরে মধ্যবিত্তরা তাদের সন্তানদের স্কুল-কোচিং-নোটবই মুখস্ত করিয়ে একটি রোবোটিক মেধাবী প্রজন্ম তৈরি করছে। কোটা না থাকলে এই রোবোটিক প্রজন্মের কাছে বারবার হেরে যাবে আমার দিনাজপুরের, খাগড়াছড়ির প্রকৃতির সন্তানেরা। একদম নিজের চেষ্টায়, নিজের মেধায় চূড়ায় উঠে যাওয়ার গল্প তো আসলে গল্পই। ড. আতিউর রহমান তো আর আমাদের দেশে ভুরি ভুরি নেই। এইরকম আতিউর রহমানদের তুলে আনতেই প্রয়োজন কোটা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, স্পিকার নারী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারী। তাই বলে কি আর নারী কোটার দরকার নেই? তেমন মনে হতেই পারে। বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা যথেষ্টই ভালো হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। শহরের স্কুলগুলোতে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করছে মেয়েরা। লাখ লাখ নারী গার্মেন্টসে কাজ করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। কিন্তু এসবই আসলে এক ধরনের বিভ্রম। এখনও গ্রামে মেয়েদের স্কুলে যেতে হয় অনেক সংগ্রাম করে। আল্লামা শফীদের পরামর্শে বাবা-মা মেয়েদের ক্লাশ ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়েই বিয়ে দেয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যান। তারপর আছে ইভ টিজিং, আছে দারিদ্র, আছে ধর্ম, পেরুতে হয় কুসংস্কারের পাহাড়। তাই উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা পাওয়া হাসিনা-খালেদা-শিরিন শারমিনদের দেখে আমাদের গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে থাকা সখিনা-আমেনা-জরিনাদের বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। আমরা চাই সখিনা-আমেনা-জরিনারাও ম্যাজিস্ট্রেট হোক, পুলিশ অফিসার হোক। প্রতিবার এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার পর পত্রিকায় ছাপা হয়, অমুক প্রতিবন্ধী পা দিয়ে লিখেও ভালো ফলাফল করেছে। এখন সেই ছেলেটাকে সাধারণ স্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থীটার সমান করতে রাষ্ট্র কি তার পাশে দাঁড়াবে না?
আসলে এত কিছু নয়, এবারের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য রাখা ৩০ শতাংশ কোটা। হেফাজতে ইসলামকে মাঠে নামিয়ে শুধু মাদ্রাসার ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী বানানো গেছে। আর কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ভাবনার শিক্ষার্থীদের অনেককেও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বানিয়ে ফেলা গেছে। বি-শা-ল সাফল্য। আর এই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক প্রথম আলো! অনেকেই বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখা উচিত নয়। এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় লোক পাওয়া যায় না। মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট জোগাড় করে চাকরি পেয়ে যায়... ইত্যাদি ইত্যাদি। এসবই ঠুনকো অজুহাত। মুক্তিযোদ্ধারা নিজের জীবনের মায়া না করে দেশের জন্য লড়েছেন, শহীদ হয়েছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, তাদের রক্তে আজকে আমরা স্বাধীন দেশে বসে কোটার বিপক্ষে আন্দোলন করতে পারছি। দেশ স্বাধীন না হলে এই শিক্ষার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানের কোটার জন্য আন্দোলন করতে হতো। তাই এই দেশটার ওপর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি একটু বেশিই থাকবে। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু তাদের অনেকেই ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমোর, গ্রামের সাধারণ মানুষ। তাদের অনেকই ছিলেন প্রথাগত অর্থে অশিক্ষিত। তাই স্বাথীনতার পর চাইলেও রাষ্ট্র তাদের সবাইকে চাকরি দিতে পারেনি। দেশ স্বাধীন করার মত সাহস থাকলেও, সেই স্বাধীন দেশে কোনো চাকরি করার মতো যোগ্যতা তাদের ছিল না। পরে হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝে নিজের সন্তানকে কষ্টেসৃষ্টে পড়াশোনা করিয়েছেন। এখন সেই সন্তানের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াবে না? অবশ্যই দাঁড়াবে। এটা তো বৈষম্য নয়, এটা ঋণ শোধ। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ভুয়া না আসল সেটা যাচাই করার দায়িত্ব পিএসসির বা রাষ্ট্রের। কিন্তু এই অজুহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা যাবে না, তাদের বিপক্ষে রাজপথে স্লোগান দেয়া যাবে না, তাদের কোটা বাতিলের দাবি করা যাবে না। অবশ্যই যাবে না। অবশ্যই আমার ছেলের চেয়ে শাহরিয়ার কবিরের ছেলে এই দেশে বাড়তি সুবিধা পাবে। যারা দেশের জন্য লড়েছে, দেশের কাছে তাদের চাওয়ার কিছু না থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের উচিত সবসময় তাদের জন্য বাড়তি আসন রাখা। আমি মনে করি আস্তে আস্তে যদি এমন দিন আসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দেয়ার মত আর কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না, তখনও এই কোটা বহাল রাখতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানানোর প্রতীক হিসেবে। শাহবাগে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপক্ষে স্লোগান শুনে নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধারা কষ্ট পেয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু অভিমান করে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের যেন তরুণ প্রজন্মের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়া না হয়। আমরা তার কষ্ট, তার অভিমান বুঝি। আমি বাচ্চু ভাইসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার কাছে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে নতজানু হয়ে ক্শা চাচ্ছি। ওরা ছোট। নিছক ব্যক্তিগত লাভালাভের বিবেচনায় তারা আপনাদের গালি দিয়েছে, আসলে তাদের মুখে স্বাধীনতাবিরোধীরা এই স্লোগান তুলে দিয়েছে। প্লিজ, পারলে আপনাদের ঔদার্য্য দিয়ে তাদের ক্ষমা করে দেবেন। আমরা জানি আপনারা শুধু একটি স্বাধীন দেশের জন্যই লড়েছেন, আর কিছু চাননি। কিন্তু আপনারা চাননি বলেই রাষ্ট্র দেবে না কেন? আপনারা স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়েছেন, এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেই ঋণ শোধের।
তবে হ্যাঁ আমি কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চাই। কোটার আসনগুলো শূন্য না রেখে পরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে তা পূরণ করা হোক। তাহলেই আর বঞ্চনার মানসিকতাটা এত তীব্র হবে না। ধরা যাক কোনো বছর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দেয়ার মত কাউকেই পাওয়া গেল না, তাহলে এই ৩০ শতাংশও তো যোগ হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তখন তো তারা পাবে ৭৫ শতাংশ। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে যারা তারা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, উন্মুক্ত করে দিলে কোটার শিক্ষার্থীদের ফেল করিয়ে পরে অন্যদের নেয়া হয়। এটা তো সিস্টেমের সমস্যা, কোটার সমস্যা নয়। মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা বা দুর্ঘটনার ভয়ে ঘরে বসে থাকা তো কোনো সমাধান নয়। কোটাবিরোধী আন্দোলনের স্পর্শকাতরতা টের পেয়েছি দুদিন আগে এ বিষয়ে টক শো’র অতিথি খুঁজতে গিয়ে। কেউই এই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান না। কোটার পক্ষে বললে শিক্ষার্থীরা ক্ষেপে যাবে, আর বিপক্ষে বললে আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষেই বলতে হবে। ঘরে দেখি আমার ক্লাশ ফাইভে পড়–য়া ছেলেও স্কুল থেকে শুনে এসে কোটার বিপক্ষে তর্ক করে। তবু আমি পুরো ঝূঁকি নিয়েই কোটার পক্ষে আমার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি। সঙ্গে সংখ্যালঘু আর দলিত সম্প্রদায়ের জন্য কোটা সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি। দাবি জানাচ্ছি, স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের সন্তানদের সব ধরনের চাকরির সুযোগ নিষিদ্ধ করা হোক। যারা দেশ চায়নি, তাদের এই দেশে কোনো সুযোগ পাওয়ারও অধিকার নেই।
আরেকটি খুবই জটিল এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্য হলো, কোটা আর মেধাবী। মনে হয় কোটা মানেই অমেধাবী। ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। কোটা সুবিধা পেতে হলেও তো মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের একটি ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন করেই আসতে হবে। কোনো মুক্তিযোদ্ধার এসএসসি পাশ ছেলে বা তৃতীয় শ্রেনী পাওয়া উপজাতি কেউ তো আর ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে যাচ্ছে না। বলা উচিত কোটা আর নন কোটা। সবাই তো মেধাবী। নইলে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ পান কীভাবে? হয়তো উনিশ আর বিশ। শ্রদ্ধেয় সোহরাব হাসান ভাই প্রথম আলোতে তার কলামে লিখেছেন, ৩৪তম বিসিএস’এর প্রিলিমিনারিতে নাকি মেধাবীরা ৮০ নাম্বার পেয়েও উত্তীর্ণ হননি। আর ৫০ পেয়েও নাকি কোটার সুবিধায় কেউ কেউ উত্তীর্ণ হয়েছেন। এটা ডাহা মিথ্যা কথা। কারণ পিএসসি প্রিলিমিনারির ফলাফলে উত্তীর্ণদের শুধু রোল নাম্বার প্রকাশ করেছে, প্রাপ্ত নাম্বার প্রকাশ করা হয়নি। তাহলে ৮০ আর ৫০-এর কাল্পনিক হিসাবটা এলো কোত্থেকে? এই হিসাব হলো সেই অশুভ মহলটির বানানো। তারা যেভাবে চাঁদে সাঈদীকে দেখতে পায়, সেভাবেই ৮০ আর ৫০ এর চমকপ্রদ হিসাবে বিভ্রম তৈরি করতে পারে। এই একটা অঙ্ক দিলেই তো সরলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পাশে পাওয়া যায়।
কোটা তো শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আছে। ভারতে কোটা আমাদের চেয়েও বেশিÑ ৬০ ভাগ। বিশ্বের আরো অনেক দেশেই বাংলাদেশের চেয়ে বেশি কোটা আছে। এমনকি বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও তো কোটা আছে। ভর্তির সময় আপনি কোটা সুবিধা ভোগ করবেন, আর সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর চাকরি ক্ষেত্রে কোটার বিরোধিতা করবেন, এটা তো হওয়া উচিত নয়। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে, যেটা নিয়ে এত হইচই, সেটাও তো কোটাই। উন্নত দেশগুলো আমাদের মত গরীব দেশকে এই ধরনের কোটা সুবিধা দেয় বৈষম্য কমাতে। তাই বৈষম্য কমানোটাই কোটা ব্যবস্থার মূল কথা। খেয়াল রাখতে হবে বৈষম্য কমাতে গিয়ে যেন আবার নতুন কোনো বৈষম্য সৃষ্টি না হয়।
আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি, বঞ্চিত শিক্ষার্থী বেশি, তাই আন্দোলনও হয় দ্রুত। যেমন এবার ৩৪তম বিসিএস’এর প্রিলিমিনারিতে ১ লাখ ৯৫ হাজার পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। পাশ করেছে মাত্র ১২ হাজার ৩৩ জন। তাই বাকি সবাই তো নিজেদের বঞ্চিত ভেবে রাস্তায় নামতে পারেন। আর আমি নিশ্চিত এখন যদি কোটার পক্ষে-বিপক্ষে গণভোট হলে কোটা বাতিলের পক্ষেই ৯৫ ভাগ লোক ভোট দেবেন। কিন্তু রাষ্ট্র তো আর প্রথম আলো নয়, তাদেরকে ৫ ভাগ হলেও যৌক্তিকভাবে বঞ্চিতদের পাশেই দাড়াতে হবে। এটা ঠিক সরকার বিরোধী আন্দোলন সমর্থন করলে পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়ে। কিন্তু সরকার বিরোধিতার সুবিধা যেন স্বাধীনতাবিরোধীরা পেয়ে না যায়, সে বিষয়টি কি মাথায় রাখবে না প্রিয় প্রথম আলো।
প্রভাষ আমিন: এডিটর, নিউজ অ্যান্ড কারেন্ট এফেয়ার্স,এটিএন নিউজ- probhash2000@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১২২৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৩
আরআর