সুবিধাপ্রাপ্ত ও বঞ্চিতদের মধ্যকার বৈষম্য নিরসনে কোটা প্রথা বিশ্বের দেশে দেশে অনুসৃত একটি স্বীকৃত পন্থা। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এই কোটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক চলমান।
অস্ট্রেলিয়ায় নারীরা যথেষ্ট স্বাবলম্বী। তারপরও সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষের নির্দিষ্ট অনুপাত অনুসরণ করতে হয়।
তদুপরি, বিসিএসে কোটা পদ্ধতি থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু বিসিএসের অপরাপর কোটা রেখে কেবল মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে বিতর্কিত করার চেষ্টাটি আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশে নানান সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করার অপপ্রয়াস আমরা দেখেছি। সেইসব অপচেষ্টটার সঙ্গে এবারের এই কোটা বিরোধী আন্দোলনের যোগসূত্র খোঁজাটা মোটেও অযৌক্তিক নয়।
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি বিরল ঘটনা; সশস্র সংগ্রামে এই রাষ্ট্রের জন্ম। সেই সঙ্গে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে পাকিস্তানি ধর্মতত্ত্ব। আবার অন্য বিচারে, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ শাসক ও সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির গালে এক চরম চপেটাঘাত আর সুবিধাবঞ্চিতদের জয়গানের ঐতিহাসিক ঘটনা।
এই জয়গান দীর্ঘায়িত হলে, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টার সোনার বাংলা বাস্তবে দেখা মিলত হয়ত। কিন্তু সে পথে সারি সারি কাঁটা বিছিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি বাংলাদেশকে বারবার নিয়ে গেছে পেছনে, যার পরতে পরতে পোঁতা আছে পাকিস্তানি শ্রেণি বৈষম্যের তথাকথিত শ্লাঘা(!)।
তাই যে বাংলাদেশে হওয়ার কথা ছিল বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা, সেই বাংলাদেশে আজও শাসক আর শাসিতের বিভাজন স্পষ্ট, সুবিধাপ্রাপ্ত আর বঞ্চিতদের বিভেদ রেখা দুর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে তৈরি।
এই প্রাচীর একদিনে গড়ে উঠেনি। ১৯৭৫ এর পর দীর্ঘ সামরিক শাসন আর পাকিস্তানপন্থিদের অপশাসনে তেলে মাথায় তেল মৈথুনের ঘটনা ঘটেছে, আর বঞ্চিতদের বঞ্চনা বেড়েছে। এ রকম বাস্তবতায় কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা সুষ্ঠু হতে পারে না।
এ কারণেই `লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড` নির্মাণে ’৭২ এর সংবিধানে যেমন অনগ্রসর অংশের জন্য বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তির কথা বলা ছিল, তেমনি আজকের বাস্তবতায় কাউকে কাউকে সুবিধা দেওয়ার যথার্থতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দীর্ঘ ২১ বছর এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধারা ছিল প্রায় অপাঙতেয়। ভুলে গেলে চলবে না, `৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এই দেশের কামার-কুমার-কৃষক নির্বিশেষে গ্রামীণ জনপদের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির মানুষই বেশি অংশ নিয়েছিল। যাদের বঞ্চনার কথা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। সেই শ্রেণির মুক্তির জন্যই এসেছিল মুক্তিযুদ্ধ। শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগের ঝুঁকি নিয়েইতো এরা যুদ্ধ করেছিল।
তাই, বৈষম্যহীন সমাজ গড়াই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শতাব্দীর পর শতাব্দী মার খেয়ে আসা এই মানুষগুলোর পায়ের নীচের মাটি শক্ত করাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। পক্ষান্তরে, অসম প্রতিযোগিতার নামে তেলে মাথায় তেল ঢালার নীতি বাস্তবায়ন কখনোই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না।
আজ অনেক বুদ্ধিজীবী কলম ধরেন, বিসিএসে মেধাবীদের জায়গা করে দিতে। কিন্তু যে দেশে মেধার বিকাশে নেই সুষম ব্যবস্থা, সে দেশে মেধা যাচাইয়ে কি করে এমন প্রতিযোগিতার কথা ভাবেন তারা? উপরন্তু, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগ আর সাহসের বিনিময়ে আজ মুক্ত স্বাধীন দেশে কলম ধরে অবাধ বাকস্বাধীনতা উপভোগ করছেন, সেই খেটে খাওয়া মজুরদের নিজেদের কাতারে তুলে আনার জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদানে কেনো এত দীনতা? বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যাঁরা পরিক্ষীত, তাদের যথাযথ সুযোগ সুবিধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ দেশের ভবিষ্যৎ রচনার দায়িত্বে অংশীদার করে নেওয়াটাই সঙ্গত।
দুই.
এত বছর পর হঠাৎ আজ বিসিএসে কোটা বাতিলের দাবি কেন? তাও আবার কোনো প্রকার আল্টিমেটাম না দিয়ে, সময় না দিয়ে, হুট করে শাহবাগ চত্বর ঘিরে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে? এ দুই প্রশ্নের অন্তরালে লুকিয়ে আছে - মুক্তিযুদ্ধকে, শাহবাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার গভীর ষড়যন্ত্র।
এ বছরই শাহবাগ চত্বর এক নতুন মাত্রায় উচ্চকিত। শাহবাগ চত্বর আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার তীব্র স্লোগানের নাম। সেই শাহবাগে দাঁড়িয়ে বিসিএসে কোটা বাতিলের দাবি তুলে মুক্তিযোদ্ধাদের তিরষ্কার করে ধৃষ্টতামূলক স্লোগান দেওয়ার মধ্যে এই ষড়যন্ত্রটি অনায়াসে আঁচ করা যায়।
বর্তমান পরিস্থিতি আমলে নিলে বিশেষ করে যে মুহূর্তে গোলাম আযমের বিচারের রায় ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে, তার ঠিক আগে আগে এমন একটি আন্দোলনকে গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করতে হচ্ছে। শাহবাগ তথা প্রজন্ম চত্বরকে বিতর্কিত করতেই, শাহবাগের চেতনাকে বিনষ্ট করতেই শাহবাগ ঘিরে এই কোটা বাতিলের প্রহসনের আন্দোলন।
উপরন্তু, গণজাগরণ মঞ্চ যাতে শাহবাগে জমায়েত গড়েতে না পারে তার জন্যই বিশেষ গোষ্ঠীর ইন্ধনে আন্দোলনের নামে শাহবাগ দখলে রাখার অপচেষ্টা ছিল বলেই মনে হচ্ছে।
সরকার কোটার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতেই পারে, কিন্তু বাংলাদেশের চেতনা বিরোধীদের অব্যাহত ষড়যন্ত্রের প্রতি আমাদেরও উচিত সজাগ দৃষ্টি রাখা।
শাহরিয়ার পাভেল: সিডনি প্রবাসী কলামিস্ট ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ- shahriar.pavel@outlook.com
বাংলাদেশ সময়: ২৩০০ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৩
জেডএম/