২৬ আগস্ট, ২০০৬ সাল। দেশের ক্ষমতায় তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার।
ফুলবাড়ি নামটি যাদের বিস্মৃতির গহবরে হারিয়ে গেছে, তাদের জন্য ঘটনাটার আরো একটি সূত্র ধরিয়ে দিতে চাইলে যে নামটি উঠে আসে, তা হলো এশিয়া এনার্জি। ফুলবাড়ি কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার পরিকল্পনা করেছিলো যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই কোম্পানিটি। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন, বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় অধিবাসীদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যায় সরকার।
অন্য পদ্ধতিতে যেখানে খনির মোট কয়লার মাত্র ১৫%-২০% উত্তোলন করা যাবে, সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে প্রায় ৯০%-৯৫% কয়লা তোলা সম্ভব, যার লোভ সামলানো যে কারো জন্যই খুবই কষ্টকর। ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতির বাস্তবায়ন করলে অল্প খরচ, শ্রম ও সময়ে অনেক বেশি কয়লা উত্তোলন করা যাবে, এই চিন্তা থেকে এশিয়া এনার্জি সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে এই পদ্ধতি অনুমোদন দিতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফুলবাড়ি কয়লা খনিতে উন্মুক্ত পদ্ধতির ব্যবহার আমাদের সর্বনিম্ন যে ক্ষতিগুলো করতে পারতো, সেগুলো হচ্ছেঃ (১) মূল খনি এলাকাসহ আশপাশের আরও প্রায় পাঁচ গুণ এলাকার ভূ-গর্ভস্থ পানি খনির অভ্যন্তরে প্রবাহিত হয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক গতিতে নীচে নামাতো এবং এর সরাসরি প্রভাব পড়তো স্থানীয় টিউব-ওয়েল, অগভীর ও গভীর নলকুপগুলোর ওপর, (২) চিরদিনের জন্যে অকেজো হয়ে পড়তো হাজার হাজার হেক্টর উর্বর আবাদী জমি, (৩) শহর, গ্রামীণ বসত-ভিটা ও বনাঞ্চল ইত্যাদির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তো এবং (৪) স্থানান্তর করতে হতো কয়েক লক্ষ মানুষসহ সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
এতো আপত্তি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকি সত্ত্বেও তৎকালীন বিএনপি সরকারের এই প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে সহযোগিতার সম্ভাব্য কারণ দু’টিই থাকতে পারে। প্রথমতঃ এশিয়া এনার্জি ছিলো একটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, যার একটি বড় শেয়ার ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতেও। এই দুই দুইটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের কোম্পানিকে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা সরকারের ছিলো না। দ্বিতীয়তঃ উন্মুক্ত কয়লাখনি প্রকল্পে কোটি কোটি টাকা বৈধ বা অবৈধভাবে লেনদেন হওয়ার সম্ভাবনাও ছিলো প্রবলভাবে।
ফিরে আসি ২৬ আগস্ট প্রসঙ্গে। সরকারকে যৌক্তিক দাবি কোনভাবেই মানাতে না পেরে ২০০৬ সালের ওইদিনে হাজার হাজার ফুলবাড়িবাসী তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে উচ্ছেদ করতে যায় স্থানীয় এশিয়া এনার্জির অফিস। আইনশৃংখলা বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালালে নিহত হয় কমপক্ষে তিন জন। তবে আন্দোলন তীব্রতর হলে ৩০ আগস্ট সরকার বাধ্য হয় ‘উন্মুক্ত কয়লাখনি হবে না’- মর্মে ফুলবাড়িবাসীর সঙ্গে চুক্তি করতে।
মজার ব্যাপার হলো, ঠিক তার তিনদিনের মাথায় ৪ সেপ্টেম্বর তখনকার উত্তাল ফুলবাড়িতে এক নির্বাচন-পূর্ববর্তী সমাবেশে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, ক্ষমতায় গেলে সব দাবি মেনে নেওয়া হবে।
কিন্তু ফুলবাড়িবাসীর দুর্ভাগ্য (দেশবাসীরও নয় কি?), পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও পাঁচ বছরে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন বক্তব্য দেয়নি। উপরন্তু এশিয়া এনার্জিকেই ভিন্ন নামে (গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট-জিসিএম) ফুলবাড়িতে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত চলছে। এছাড়াও, পাশেই অবস্থিত বড়পুকুরিয়া খনি থেকেও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার ব্যাপারে সোচ্চার হন সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তি ও কমিটি।
১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। ১৪ জুন রাতে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের ইজারাভুক্ত সিলেটের মাগুড়ছড়া গ্যাসফিল্ডে ঘটে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
২০০২ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায়। জানুয়ারি ও জুন মাসে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর অধীনস্থ সিলেটেরই আরেক গ্যাসফিল্ড টেংরাটিলায় ঘটে পরপর দু’টি বিস্ফোরণ। ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করা হয় প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও, এই দু’টি গ্যাসফিল্ডে জ্বালানি সম্পদসহ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে তা আদায় করতে পারেনি কোন সরকারই। উপরন্তু নানাভাবে ছাড় এবং ভর্তুকি দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আরো সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও ঘটছে না? ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ভয়াবহ হুমকির মধ্যে পড়বে’, বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে এমন দাবি প্রতিদিনই বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে আসছে। সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই কেন্দ্রের ফলে শব্দদূষণ, পানিদূষণ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মাটির উর্বরতা হ্রাসসহ আরো নানা দিক থেকে সুন্দরবন ও তার আশপাশের এলাকায় বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলশ্রুতিতে ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের গর্বের সুন্দরবন।
ঠিক অতীতের মতোই কোন ওজর-আপত্তিতে (এমনকি নিজের বন অধিদপ্তরের আপত্তিতেও) কান না দিয়ে সরকার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ। যথারীতি বিরোধী দলে থাকা বিএনপি ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে এই কেন্দ্রের কাজ বাতিল ঘোষণা করবে তারা।
প্রশ্ন হলো, দেশের পরিবেশ-প্রকৃতি নিয়ে আসলে কিছু ভাবছে কিনা আমাদের বড় দুই দল এবং তাদের সহযোগীরা? যদি ভাবতোই, তাহলে ‘ক্ষমতায় এলে বাতিল করবো’, না বলে, কেন এখনই তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছে না? আর ক্ষমতায় এলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপ এবং দেশীয় ভাগবাটোয়ারা যে প্রতিশ্রুতি ভুলিয়ে দেয়, তাও কি দলগুলোর অতীত কর্মকাণ্ডেই প্রমাণিত না?
বাংলাদেশ বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর হয়ে (Less Developed Countries-LDCs) উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ আদায়ের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানা বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরছে বাংলাদেশ। কিন্তু উন্নয়নের নাম করে নিজের দেশের পরিবেশ যদি নিজেরাই ধ্বংসের বন্দোবস্ত করি, তাহলে একই কারণে বিশ্ব দরবারে ক্ষতিপূরণ চাইবো আমরা কোন মুখে?
সংকীর্ণ দলীয়, রাজনৈতিক এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের হুমকির মুখে থাকা আমাদের প্রিয় এই বদ্বীপকে বাঁচানোর সময় এখনও চলে যায়নি। তা না হলে হয়তো একটা মরুভূমি উপহার দিয়ে যাওয়ার জন্য পরবর্তী প্রজন্ম দায়ী করবে আমাদেরকেই।
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ: ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, anupamdkan@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৩
জেডএম/