ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বিচিত্র এদেশে সেলুকাসও মূর্চ্ছা যেতেন

অজয় দাশগুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৩
বিচিত্র এদেশে সেলুকাসও মূর্চ্ছা যেতেন

বয়সের বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া গোলাম আযমের ভাগ্য ভালো তিনি কারো পিতা বা স্বামীকে খুন করেননি। তা করলে এবং পাওয়ারফুল পরিবারের কাউকে করলে আজ তার নব্বুই শিকেয় থাকতে হতো না।

এক দড়ি আর আর এক গুলিতেই বিচার হয়ে যেতো। অপরাধপ্রবণ দেশ বা সমাজে ব্যক্তিমানুষ সবসময় সমষ্টির চেয়ে বড়। এখানে পিতা, স্বামী, পুত্র বা কন্যাহত্যার জন্য রেহাই না মিললেও দলে দলে মানুষ মারার জন্য রেহাই মেলে।

রাজনৈতিক ও সামাজিক খুনোখুনি আমাদের দেশে স্বীকৃত। স্বীকৃত বলেই গরীব মানুষের বাঁচার জন্য চাই খোদা ভগবান বা নানা জাতীয় অলৌকিক কাণ্ড কারখানা। অন্যদিকে, মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান বা দোয়াপুষ্ট মানুষ সব সময় নিরাপদে থাকেন। এরা জিন্নাহর মত ধর্মে আস্হাহীন হবার পরও ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িকতার আশির্বাদপুষ্ট নেতা। সেদিক থেকেও তিনি ভাগ্যবান। তার অনুসারী বা কর্মীবাহিনী সংখ্যালঘু বা প্রগতিবাদী মুসলমানের হত্যাকে অন্যায় কিছু মনে করে না। তা ছাড়া ৪০ বছর পর প্রায় তামাদি হয়ে যাওয়া একটি ব্যাপারকে তলোয়ারের ঝাঁ-চকচকে ধারে পরিণত করাও মূলত অসম্ভব একটি কাজ। একথা যে সরকার জানতো না তা কিন্তু নয়। জানতো বলেই একের পর এক নাটক আর সাজানো খেলা, দৃশ্যের মহড়া ও বাস্তবায়ন চলছে।

প্রথমেই যে কথাটি বিনয়ের সাথে জানতে চাই, গোলাম আযমের বিচার না হলে কি অসুবিধা হতো বা হচ্ছিল? জীবনের সোনালী দিনগুলি বহাল তবিয়তে কাটিয়ে মানবিক বাঙলা বাঙালির বারোটা বাজিয়েও তিনি যখন বেঁচেবর্তে ছিলেন, আর ক্রমে কেম যখন প্রায় অকেজো হয়ে উঠেছিলেন সে সময় নিজেদের স্বার্থে নির্বাচন ও ভোটের কারণে তাঁকে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় আনার কি  আদৌ কোনো দরকার ছিল? গোলাম আযম তারুণ্যের জীবন ও বোধে অস্পষ্ট প্রায় মুছে যাওয়া এক চরিত্র। আমরা যারা একাত্তর দেখেছি বা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির স্বাক্ষী আমরা তাকে চিনি ও কীর্তিকলাপ জানি। সে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও গৌরবের কিছু নয়। সেখানে এক দল তাঁর প্রত্যক্ষ দোয়া, আর এক দল নীরব সমর্থনের দায়ে দায়ী।

তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার দায়ও এক মুক্তিযোদ্ধার। দেশে পুর্নবাসন আর বছরের পর বছর লালনের দায় সবার। সে জায়গাটুকু সময়ের বিবর্তনে যখন ধূসর হতে হতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল সে সময়ই আবার বিচারের নামে তিনি ও তাঁর দল চলে এলো লাইম লাইটে। নিন্দুকেরা বলেন, এর পেছনে নাকি দুই চাল, এক. বিরোধী দল বিএনপিকে সাইজে রাখা , দুই. বিচার আর ফাঁসির নামে অতীতের মুলো ঝুলিয়ে তারুণ্যের সমর্থন আদায়।

এর একটিও একশ ভাগ কাজে লাগে নি। কারণ পৃথিবী এখন বদলে যাওয়া বাস্তবতায় প্রকাশ্য আর খোলা বইয়ের মত। সেখানে কোনো কিছু গোপন রাখা যায় না। তাছাড়া দুনিয়ার অনেক দেশ এখনো ধর্মের নামে উন্মাদনা আর জঙ্গিবাদ রপ্তানিতে উৎসাহী।   ধর্মীয় কারণে এজাতীয় দেশগুলি আমাদের দেশে সক্রিয়। তাদের কথা না শুনলে তারা নানা ধরণের শাস্তি দিতে পছন্দ করে। কাউকে খানাপিনায় কষ্ট দেয়া, কাউকে সাহায্য বন্ধ করে বিপদে ফেলা, কাউকে শ্রমিক বা শ্রমের দুনিয়া বন্ধ করার নামে বাধ্য করায় ব্যস্ত এদের হাত বা ভূমিকা ভুললে চলবে না। জামাতের সাথে এক ধরণের সখ্য বা পেয়ার আছে এদের। সরকারও তা জানতো। কিন্তু ম্যানেজ করার টাইম কোথায়? বাইরের দুনিয়ায় তাদের একাজের চেয়ে জরুরি ছিল প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বশান্তি প্রস্তাব নামে অদ্ভুত ও আজগুবি এক তত্ত্ব প্রচার। এ নিয়ে কত রথী মহারথী এলেন আর গেলেন। দুনিয়া চষে বেড়ানোর সুবর্ণ সুযোগ মিস করেননি আওয়ামী নেতা আর তাদের পোষা বুদ্ধিজীবীরা।

আরেকটি কাজকে ফরজ মেনে এখন অব্দি সমানে তার জন্য গলা ফাটানো আর বাদানুবাদ জারি রেখেছে সরকারী দল। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসকে ঘায়েল করার জন্য মরিয়া হাসিনাবাহিনী জামাতের শক্তি বা সাহসের আন্তর্জাতিক সীমানা জানার পরও এ ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপই নিতে পারে নি। তাদের মূল টাগেট যদি জামায়াত হতো তারা ইউনুস ইস্যু এড়িয়ে সেদিকেই মন দিতেন।

বাংলাদেশের তারুণ্যকে আমি এমন বিভ্রান্তিকর বাস্তবতায় পড়তে দেখিনি আগে। তারা একবার শাহবাগে যায় আবার ফিরে আসে। অভিভাবক ও নেতৃত্বশূন্য তারুণ্যকে এই দৌড়ের জন্য বাহবাও দিতে পারছি না। যেকালে তারুণ্য জিতেছিল সেকালে তাদের মাথার ওপর জাতীয় নেতৃত্ব ছাতার মত কাজ করতো। আজ কোনো দলেই তেমন কোনো বিশ্বাসী নেতা বা অভিভাবক দেখি না। আওয়ামী লীগ গোলাম আযমের বিচারপর্ব নিয়ে নব্বুই বছরের যে ধোঁকা খেলো বা দিলো তার বিপরীতে দাঁড়ানো মিছিল বা মিটিং-এর কোনো বিহিত করতে পারবে না। কারণ সরকারি দল ইতোমধ্যে তাদের সন্তোষ প্রকাশ করেছে।

যার মানে এই জাতীয় রাজনীতির প্রধান দু’ধারাই গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মরিয়া কোনো অবস্থানে যেতে রাজী নয়। এক দল তো আজ সংসদেই যায়নি। অন্য দল ফাঁসি না হবার কারণে সন্তুষ্ট। রাজনীতির এই কূটচালেরই প্রতিচ্ছবি নব্বুই বছরের কারাদণ্ড। একনব্বুই বছরের বেশি একজন মানুষের বিরুদ্ধে নব্বুই বছরের শাস্তি জাতির গালে নব্বুইটি চড়ের মত সারাজীবন দগদগে হয়ে জেগে থাকবে।

ভবিষ্যতে এজাতির কোনো নবীন শিশু বা অনাগত সন্তান জানবে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতম ঘটনার মাস্টারমাইন্ডকে আরো একশ বছর আয়ু দিতে চেয়েছিল এদেশের ট্রাইবুনাল। হায়, সেলুকাস!বেঁচে থাকলে মূর্চ্ছা যাবার বিকল্প থাকতো না তোমার। এখানে ব্যক্তি বা পরিবার হত্যার জন্য ফাঁসি হলেও সামষ্টিক বা জাতি  হত্যার দায়ে জামাই আদরে একশ বছর নিরাপদে থাকাটাই ন্যায়বিচার।

বাংলাদেশ সময়: ২০১৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৩
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।