ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগে কাজ করার সময় সেখানে পাকিস্তানি এবং ভারতীয় ডিপার্টমেন্ট থাকায় আমার অনেক ভারতীয় এবং পাকিস্তানি সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তাদের সঙ্গে আমার কর্মজীবনে প্রাপ্ত কিছু অভিজ্ঞতা বিষয়ে লিখছি।
ভারতীয়দের মনোভাবটি দেখেছি, তারা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যে সমর্থন ও সাহায্য করেছিল তা মনে করিয়ে দেয়। তারা মুখে ভাই ভাই বললেও আমাদেরকে নীচু জাতি হিসেবে দেখে এবং বাংলাদেশ নিয়ে অহরহ তামাশা করে। তারা শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেট লিডার বললেও বোঝানোর চেষ্টা করে ভারতের সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশ নামে কোন ভুখণ্ডের জন্ম হতো না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ টিকে আছে ভারতের সাহায্য নিয়ে। এমনকি ভারতীয় বাঙ্গালীদের বলতে শুনেছি, বাংলাদেশের বাংলা আসলে বাংলা ভাষার ব্যাঙ্গাত্বক রুপ। অর্থ্যাৎ বাংলাদেশীরা সঠিক ভাবে বাংলা লিখতে বা পড়তে জানেনা।
আমাদের সাহিত্যিকরা তাদের কাছে কোন সাহিত্যিকই নয়, এমনকি ছ্যা.. ছ্যা.. শব্দ উচ্চারণ করে তারা বাংলাদেশের বাংলাকে অপমান করে থাকে । অথচ বাংলাদেশের প্রাপ্য সব জায়গায় তারা ভাগ বসায়, সে গ্যাসই বা নদীর পানিই হোক অথবা বাংলাদেশ বর্ডারের শেষ সীমানাই হোক... আর যদি তা বাংলাদেশের জন্য তৈরি রেডিও, টিভি হয় তাহলেতো কথাই নেই। এক্ষেত্রে তারা বলবে বাংলাদেশে কোন সাংবাদিকই নেই এবং বাংলাদেশে সাংবাদিকতার মান খুব নীচু। বিদেশি বসের ভাষাগত অজ্ঞানতার সুবিধা নেবে আর বসের পিছনে চাটুকারিতা, এমন কি প্রয়োজনে সব কিছু দিয়ে বসকে খুশি করে পদবী দখল করার খেলায় তারা মত্ত্ব। এই খেলা বাংলাদেশীদের বুঝতে অনেক সময় লাগে, আরে তাতেই কেল্লা ফতে।
জার্মান সরকার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জয়ের পরে তখনকার বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর অনুরোধে যে বাংলা ডিপার্টমেন্টটি উপহার স্বরূপ বাংলাদেশকে দেওয়া হয়োছিলো; তার বর্তমান বিভাগীয় প্রধান একজন ভারতীয় বাঙ্গালী। তার পাসপোর্ট ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দেয় বর্তমান বিভাগীয় প্রধান। এর কারন হলো, ডয়েচে ভেলের নিয়মানুযায়ী প্রতিটি বিভাগের প্রধান হতে হবে সেই দেশের একজন নাগরিককে। অর্থ্যাৎ চাইনিজ বিভাগের প্রধান হবে একজন চাইনিজ। এ ক্ষেত্রে নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিলেই এই সুবিধাটি গ্রহণ করা যায়। যদিও ডয়েচে ভেলেতে ভারতীয়দের জন্য একটি আলাদা বিভাগ রয়েছে। সেখানে কিন্তু কোন বাংলাদেশি বিভাগীয় প্রধান নয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পত্তি তারা দেশে বিদেশে সব জায়গায় নিজেদের সম্পত্তি হিসেবে ভোগ ও হজম করে চলছে। এমনকি মুসলিম ধর্ম পরিচয় নিয়েও তারা বিভিন্নভাবে অশ্রদ্ধার কথা বলে।
পাকিস্তানিরা প্রথমেই বলবে আরে, তোমরাতো পাকিস্তানীই ছিলে, আমরা তো ভাই ভাই। আরো বলবে, ১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানে যে হামলা হয়েছিলো, তা ছিলো সামরিক সিদ্ধান্ত, পাকিস্তানী জনগণ এ ব্যাপারে অবগত ছিলো না, আসলে ১৯৭১ সালে কি হয়েছিলো তারা তা জানেই না, যদি একটু বুঝিয়ে বলি!!
ধরুন, আপনি এই ফাঁদে ধরা দিলেন এবং বললেন, কি হয়ছিলো; তখন সে বলবে, লেকিন হাম লোগ তো দোস্ত হে না, পুরানি বাতো কো ভুল জানাহি আচ্ছা হে। এখানে আমার প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অংশ কি পাকিস্তানী জনগণের বাইরে? তারা কি অন্য কোন গ্রহ থেকে পাকিস্তানে এসেছে? এখন পর্যন্ত পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে অফিসিয়ালী ১৯৭১ সালে তাদের অতর্কিতে বর্বরোচিত হামলা, হত্যা, ধর্ষণের জন্য এসবের ক্ষমা তো চাইনি সঙ্গে ১৯৪৭-১৯৭১ এর দেনা -পাওনা, যে টাকা আমরা পাকিস্তানের কাছে পাই তা বুঝিয়েও দেয়নি। তারপর, আপনাকে বাংলা বোঝেনা বলে, ইংরেজিতে কথা না বলে উর্দু বা হিন্দীতে কথা বলাতে উৎসাহিত করবে। আর আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে তারা কত উদার, কিন্তু আপনি পিছন ফিরলেই আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করবে, বলবে : আয়া বাংলাদেশসে.. হামারে বিনা ইয়ে আধুরী হে !! তারপর বিহারী প্রসঙ্গে কথা উঠলে বলবে, বিহারী লোগ কো হামে নেহি চাহিয়ে, তুমহি কো মুবারক হো। অথচ বাংলাদেশে অবস্থানরত বেশির ভাগ বিহারীরা এখন পর্যন্ত পাকিস্তানকে তাদের রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে।
আরো, ভয়ঙ্কর কিন্তু বাস্তব তথ্য হলো, পাকিস্তানীরা বলে তারা ১৯৭১ সমন্ধে কিছু জানে না, অথচ ১৯৭১ সালে নরওয়েতে এসে নরওয়ে সরকারকে জানিয়েছে, পাকিস্তানে বর্তমানে গৃহযুদ্ধ চলছে, তাদের জীবন বিপদগ্রস্ত, তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রয়োজন। এই ইস্যুকে সামনে রেখে ১৯৭১ সালে হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী নরওয়েতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলো। অথচ যুদ্ধ হয়েছিলো শুধু পূর্ব পাকিস্তানে অর্থ্যাৎ আজকের বাংলাদেশে।
সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হলো, ভারত এবং পাকিস্তান নিজের দেশে একে অপরের জন্মশত্রু হলেও বিদেশে আসলে তারা তাদের পরম বন্ধু। আর তাদের বন্ধুত্বের যাতাকলে আপনাকে পিষতে থাকবে অনবরত, আপনার পেছন থেকে আপনার উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্গাত্বক হাসি হাসতে থাকবে তারা। আর সামনা সামনি আপনি হলেন, তাদের ভাই!!!
শেষ কথায় স্যার হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলতে চাই, “পাকিস্তানীদের আমি বিশ্বাস করি না, তারা হাতে ফুল নিয়ে এগিয়ে আসলেও না। ”
আর আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, বেশির ভাগ সুবিধাবাদী ভারতীয়কেও আমি বিশ্বাস করি না।
লেখক: ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগের সাবেক কর্মী।
বাংলাদেশ সময় ০০১৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৩
এমএমকে