মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলো নিয়ে বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরে যে পরিমাণ তোলপাড় হয়েছে ও হচ্ছে, এতোটা মনে হয় পৃথিবীর আর কোন রায় নিয়ে হয়নি। সেই অর্থে এই মামলাগুলোকে বিশ্বের অন্যতম চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে খুব সহজেই স্বীকৃতি দেওয়া যায়।
এখন পর্যন্ত দেওয়া ৬টি রায়ের মধ্যে চারটিতে অভিযুক্তদের ফাঁসি এবং বাকি ২টিতে ভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। যে ২ জনের ভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়েছে- সেগুলো হলো জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও সাবেক আমীর গোলাম আযম।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী, ফাঁসির রায় হওয়া অন্য মামলাগুলোর মতো এই দু’টিও প্রত্যাখ্যান করে দেশজুড়ে চালিয়েছে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড।
জামায়াতের সব রায়ের ক্ষেত্রেই ‘উনারা সম্পূর্ণ নির্দোষ’ লাইনে আছেন।
অন্যদিকে সব যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর দাবি নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরাও আছে মাঠেই।
কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি হওয়া কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১৫ জুলাই হওয়া গোলাম আযমের ৯০ বছরের জেল- এই দুই রায় আওয়ামী লীগের নেতা, তাদের সরকার এবং তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বয়ে এনেছে ‘একই যাত্রায় ভিন্ন ফল’-এর উদাহরণ। কিভাবে? বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা একটু ঘাঁটাঘাটি করে চলুন একটু দেখে আসি ব্যাপারটা কি!
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ৬ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, “যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার রায়ে জাতির সঙ্গে আমরাও সন্তুষ্ট হতে পারিনি।
তিনি বলেন, বিচারকরা যে রায় দিয়েছেন তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই।
১৫ জুলাই গোলাম আযমের রায় ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হানিফ বলেন, আমরা এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করছি। যদিও গোটা জাতির প্রত্যাশা ছিল কুখ্যাত এ যুদ্ধাপরাধীর রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই দেওয়া হবে। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার কারণেই তাকে ৯০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে।
রায় নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
অথচ, বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ ভালমতোই প্রকাশ হয়েছে যে, বয়সজনিত কিছু সমস্যা ছাড়া বড় ধরনের কোন রোগই নেই সাবেক জামায়াত আমীরের। আওয়ামী লীগ নেতা হানিফেরও তা অজানা থাকার কথা নয়।
৬ ফেব্রুয়ারি আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে দেওয়া রায়ের পর তার ফাঁসির দাবিতে মানুষ যেভাবে মাঠে নেমেছে রায়ের আগে এভাবে নামলে রায় হয়তো অন্যরকম হতে পারতো।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মিলিত আওয়ামী সমর্থক জোটের হরতালবিরোধী মানববন্ধনে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এ রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জনগণ অন্য কিছু আশা করেছিল।
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এ রায়ে আমরা হতাশ।
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ১৫ জুলাই গোলাম আযমের রায় সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের রায়ে তাকে একাত্তরের ঘাতকদের শিরোমণি বলা হয়েছে। তার মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বয়স বিবেচনায় তাকে ৯০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। এতে অসন্তুষ্ট হওয়ার কিছু দেখছি না।
আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না- আইন প্রতিমন্ত্রীর এমন মনোভাব থেকে থাকলে সেটা ৫ ফেব্রুয়ারিতে কোথায় ছিল?
কাদের মোল্লার রায়ে আইনমন্ত্রী ছিলেন হতাশ।
এ রায়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ৫ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ আছে। প্রসিকিউশন টিম যদি মনে করে –এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা প্রয়োজন, তবে তারা সেটা করতে পারবে।
অথচ, ১৫ জুলাই সচিবালয়ে নিজকক্ষে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সমস্ত দিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক মান ও স্বচ্ছতা বজায় রেখে বিচার হয়েছে। আমার মনে হয়, এটা দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল এবং দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। বয়স বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড না দেওয়া আন্তর্জাতিক রীতি বলে মনে করি।
তিনি বলেন, বিজ্ঞ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা সবাইকে মানতে হবে।
গোলাম আযমের বয়স ২০১৩ সালে এসে ৯১ বছর হয়েছে। ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ৪৯। তাহলে ১৯৭২ সালে ৫০ বছর বয়সে কেন তার বিচার করা হলো না? ১৯৯৬ সালে তার বয়স ছিলো ৭৪ বছর। তখন বিচার কেন হয়নি? কম বয়সে বিচার না হওয়ার দায় কি জনগণের? ৪২ বছরের বিচারহীনতার দোষ কি সেই দেশবাসীর যারা নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার অঙ্গীকার দেখে আওয়ামী লীগেকে ভোট দিয়েছিলো?
দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে নাকি হয়নি, যেটা আইনমন্ত্রী কোন জরিপ থেকে পেলেন? সম্ভবতঃ জামায়াতের গোলাম আযমের মুক্তি দাবি আর গণজাগরণ মঞ্চের ফাঁসি দাবি ছাড়া যে বিপুল জনগণ এ বিষয়ে চুপ করে আছে, তাদের ‘মৌনতাই সন্তুষ্ট হওয়ার লক্ষণ’ ধরে নিয়েছেন শফিক আহমেদ। এই সূত্র অনুযায়ী তারেক রহমানের দুর্নীতিতেও (দুর্নীতির বিচার নয়) ‘জনগণ’ ও ‘দেশবাসী’ সন্তুষ্ট।
এবার আসুন দেখি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া। সরকারের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে তার বক্তব্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
লক্ষ্য করুন, ১০ ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন সম্পর্কে শেখ হাসিনা প্রথম তার প্রতিক্রিয়া জানান জাতীয় সংসদে।
তিনি বলেন, আমার মনও শাহবাগের আন্দোলনে ছুটে যেতে চায়। আমি তরুণ প্রজন্মকে বলতে চাই, আমরাও তোমাদের সঙ্গে একমত। তোমাদের শপথ বাস্তবায়নে যা যা করা দরকার, আমরা করব। তরুণ প্রজন্ম জাতীয় সংসদে যে স্মারকলিপি দিয়েছে, তার প্রতিটি কথা যুক্তিসঙ্গত।
ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইন দেখে বিচারের রায় দেবেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের প্রতি অনুরোধ, মানুষের আকাঙ্ক্ষা যেন তারা বিবেচনায় নেন,মানুষ কী চায়- সংসদ থেকে সেটাই তাদের কাছে বিবেচনার আবেদন জানাচ্ছি।
রাজাকার শিরোমণি হিসেবে পরিচিত, প্রসিকিউশনে ‘Lighthouse of Atrocity’ হিসেবে অভিহিত গোলাম আযমের ৯০ বছর কারাদণ্ডের রায়ের পরও প্রধানমন্ত্রী সংসদে তার প্রতিক্রিয়া জানান। তবে এবার তা খুবই সংক্ষিপ্ত।
১৬ জুলাই নবম সংসদের ১৮তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রায় দিয়েছেন। সেখানে গোলাম আযমকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল যে শাস্তি দিয়েছেন, এতে আমরা সন্তুষ্ট হয়েছি। সাজা কী হবে, তা আদালতের বিষয়।
ব্যস, এটুকুই!
এ তো গেলো সরকারের কর্তাব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়ার কথা। চলুন দেখি পুলিশ কি করে।
৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেওয়ার পর গণজাগরণ আন্দোলনের কর্মী-সমর্থকদের বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, রীতিমতো আপ্যায়ন শুরু করে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। শাহবাগে প্রবেশের চার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে মেটাল ডিটেক্টর ডোর বসিয়ে একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড হয় শাহবাগে।
অন্যদিকে পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পায়, ১৬ জুলাই গোলাম আযমের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে অবস্থান তো দূরের কথা, মিছিল করতেও বাধা দেয় পুলিশ। আগে দিনের পর দিন শাহবাগে অবস্থান করতে দিলেও এখন রীতিমতো জনগণের বন্ধু পুলিশ।
আন্দোলনকারীদের বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে পুলিশের সহকারী কমিশনার শিবলী নোমান বলেন, মানুষের ভোগান্তি এড়াতেই এ ব্যবস্থা নিতে হয়েছে।
প্রথম প্রশ্ন হলো, ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ জুলাই- এই সাড়ে পাঁচ মাসে দেশে কি এমন পরিবর্তন এসেছে যে, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া আসে একই ব্যক্তির কাছ থেকে? অনেক উত্তর অবশ্য রেডিই আছে। এই ১৫০ দিনে হেফাজতে ইসলাম এসেছে, অনেক দেশি-বিদেশি মিটিং হয়েছে, রানা প্লাজা ধ্বসে পড়েছে, জিএসপি বাতিল হয়েছে, সর্বপরি, দেশ নির্বাচনের দিকে আরো এগিয়ে গেছে।
৫ ফেব্রুয়ারি গুটিকয়েক মানুষ শাহবাগে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন শুরু করে, এখনও সেই গুটিকয়েক মানুষই আছে। মাঝখানে কয়েক দিনের জন্য লাখো মানুষের ঢল দেখেছিলো শাহবাগ। শাহবাগের গুটিকয়েক মানুষ কাদের মোল্লার মামলার রায়ের যেমন প্রতিবাদ করেছে, যুদ্ধাপরাধের মূল হোতা গোলাম আযমের মামলার রায়ের প্রতিবাদ তার চেয়েও ক্ষুব্ধ কন্ঠে করেছে। তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং নেতাকর্মীরা ‘জনগণ’, ‘দেশবাসী’ বলতে কি বোঝেন, কাদের বোঝান?
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ: ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন- anupamdkan@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৩
জেডএম/