ঢাকা: টেলিভিশন সাংবাদিকতায় একটি মজার বিষয় লক্ষ করছি গত এক দশক ধরে। আর তা হলো- এক টেলিভিশন থেকে আরেক টেলিভিশনে লাফ মারলেই পদোন্নতি! যোগ্যতা-অভিজ্ঞতার দরকার নেই! শুধু একটা লাফ!
বেতন বাড়ে তো পদও বাড়ে! আহ কী আনন্দ! স্টাফ রিপোর্টার হয়ে যাচ্ছেন সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকসহ কত রকমের পদধারী।
কারো কারো আবার টার্গেট থাকে ন্যাশনাল ডেস্ক এডিটর হওয়া। কোনো কোনো জেলা প্রতিনিধি নিয়োগ করলে মোটা অংকের টাকা তো মিলছেই, আবার মাসে মাসে ফ্লেক্সি, হাওলাত, সমস্যা ইত্যাদিরও সমাধান পাওয়া যাচ্ছে।
৬৪ জেলার প্রতিনিধির মধ্য থেকে বাছাই করে ২০ থেকে ২৫ জনের কাছ থেকে পাঁচ হাজার বা ১০ হাজার করে হাওলাত নিলেও তো এক বা দুই লাখ টাকা অনায়াসে হাতে এসে যায়! আর তা না হলে তো ‘নিষ্ক্রিয়’, ‘অযোগ্য’, ‘ভালো নিউজ পাঠাতে পারে না’ ইত্যাদি বাক্য ছুড়ে মারার হুমকি তো দেওয়া যায় সহজেই।
টেলিভিশনে এখন বড় সমস্যা হচ্ছে, ব্রেকিং নিউজ নিয়ে। কোন টেলিভিশন কার আগে ব্রেকিং নিউজ দর্শকদের দিতে পারবে, তারই প্রতিযোগিতা চলছে। যে সব টেলিভিশন এ প্রতিযোগিতার দৌঁড়ে নেই, তারা আছে সুবিধাজনক অবস্থায়। সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে না। কিন্তু, যারা নিজেদের টেলিভিশনকে জনপ্রিয়তার তালিকায় শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তাদের অবস্থা ইঁদুর দৌড়!
সার্বক্ষণিক সংবাদভিত্তিক চ্যানেলগুলোতে প্রায়ই লক্ষ করছি, কোনো একটি ব্রেকিং নিউজ দিয়ে কিছুক্ষণ পরই তা সংশোধন করে ফেলা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরো ব্রেকিং নিউজটিও প্রত্যাহার করে নিতেও দেখেছি।
আবার ঘটনাই ঘটেনি এমন খবর সারাদিন স্ক্রলে ঘুরছে এমনও দেখেছি (একটি নিউজ চ্যানেলে একবার)। এতে করে লাফমারা বার্তা সম্পাদকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে!
কেউ কেউ আবার বলেন, তাদের আবার দোষ কী? তারা তো বার্তা সম্পাদক, গ্লাসের দেওয়ালে নিজেকে বন্দি করে রাখতে সচেষ্ট থাকেন তারা।
স্ক্রল নিউজ প্রচারের দায়িত্বে যিনি থাকেন, তাকে ফোন করে প্রতিনিধি বা রিপোর্টার যা বলেন, তিনি তা কম্পোজ করে স্ক্রলে তুলে দেন। যাচাইয়ে দরকার কী! ঘটনা সত্যি না মিথ্যা, তা খতিয়ে দেখার দরকার কী! টেলিভিশন রসাতলে গেলে বা দেশ রসাতলে গেলে তাতে তার কী! লাফ দেওয়ার সুযোগ তো তার হাতে আছেই।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় খুব লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমার কাছের আত্মীয় ইতালিতে আমার সঙ্গে স্কাইপে সংযুক্ত ছিলেন। ওই আত্মীয় আবার বিএনপির সমর্থক। তিনি আমাকে বললেন, টেলিভিশনে নির্বাচনের ফলাফল যখন যা দেখাবে, আমি যেন স্কাইপে তা লিখে জানাই।
রাত ১১টা ১৭ মিনিটে আমি তাকে লিখে জানালাম সময় টিভি বলছে ৩৯২ কেন্দ্রের মধ্যে ২০৩ কেন্দ্রের ফলাফলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট প্রার্থী পেয়েছে ২,৩০,১২৭ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট প্রার্থী পেয়েছেন ১,৮৫,৩৯৪ ভোট।
তার পাঁচ মিনিট পর সময় টিভিতে কোনোরকম দুঃখ প্রকাশ ছাড়াই বলছে ৩৯২ কেন্দ্রের মধ্যে ২০৩ কেন্দ্রের ফলাফলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট প্রার্থী পেয়েছেন ২,৩০,১২৭ এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট প্রার্থী পেয়েছেন ১,২৫,৩৯৪ ভোট। বিএনপির ভোট ঠিক থাকলেও আওয়ামী লীগের কমিয়েছে ৬০ হাজার।
আর একাত্তর টিভি মধ্যরাতে ৩৯২ কেন্দ্রের যে ফলাফলে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ৪,৬৮,০০০ ভোট এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ৩,১২,০০০ ভোট ব্রেকিং নিউজ হিসেবে প্রচার করে।
তাদের এই সংখ্যা দেখে আমার তখনই সন্দেহ হয়। কিন্তু, সত্যি মনে করে ইতালি প্রবাসী আত্মীয়কে পাঠাই। হিসাব মিলিয়ে তিনি বললেন, এ তো প্রদত্ত ভোটের অনেক বেশি।
পরের দিন নিশ্চিত হয়ে তিনি বললেন, এই হলো ‘তোমাদের মিডিয়া’। ‘তোমাদের মিডিয়া’ এ কারণে তিনি বললেন যে, তিনি জানেন আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক।
আমার খুব মনে আছে, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে কুমিল্লা প্রতিনিধি হিসেবে সারাদিন নিউজ কাভার করার পর বিকেলে আমি বেকার হয়ে পড়ি। কারণ, কুমিল্লা টাউন হল মিলনায়তনে নির্বাচন কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে, তা চ্যানেল আইয়ের রিপোর্টার সোমা ইসলাম কাভার করবেন। আর বাইরের খবরাখবর কাভার করবেন সিনিয়র রিপোর্টার মোস্তফা মল্লিক ও পান্থ রহমান।
কিন্তু, একজন রিপোর্টার হিসেবে বেকার হয়ে যাওয়াটা আমার মোটেই ভালো লাগছিল না। কী করা যায় যখন ভাবছিলাম তখন চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুলিশ কন্ট্রোল রুম। যে কোনো নির্বাচনে যে কোনো কেন্দ্রের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ওয়ারলেসের মাধ্যমে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে জানিয়ে থাকেন।
দেরি না করে আমার ল্যাপটপ, ইন্টারনেট মডেম আর বড় ক্যালকুলেটর নিয়ে নির্বাচনের সময় অত্যন্ত গোপনীয় ওই স্থানটির উদ্দেশে রওয়ানা দেই। আমি যে সময়ে সেখানে যাচ্ছিলাম, সে সময়ে কুমিল্লা টাউন হলে ফলাফল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছিল নির্বাচন কমিশন।
পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গিয়ে দেখি, ওয়ারলেস অপারেটর এক এক করে সব ভোট কেন্দ্রের ফলাফল নিচ্ছেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে পরিচিত হওয়ায় তারা আমাকে বাধা না দেওয়ায় আমি ওয়ারলেস অপারেটরের পাশে বসে যাই।
ওয়ারলেস অপারেটর আমার হাতে বড় ক্যালকুলেটর দেখে উৎসাহের সঙ্গে বললেন- ভাই, সংখ্যাটি একটু যোগ করে দেন। তারপর প্রায় সব কেন্দ্রের ফল মুহূর্তের মধ্যেই আমার হাতে চলে এলো।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা হাতে নিয়ে আমি ফোন করি চ্যানেল আইয়ের ডিএনইতে (ডেইলি নিউজ এডিটর)। তারা আমার তথ্য লিখে নিয়ে বার্তা সম্পাদক প্রণবদাকে দিলেন। ফলাফল হাতে পেয়ে প্রণবদা আমার সঙ্গে কথা বলে জানতে চাইলেন, এত তাড়াতাড়ি ফলাফল কীভাবে পেলাম? ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু? কেউ দায়িত্ব নেবে কিনা? ফল ভুল হলে কি হবে? ইত্যাদি। সেই সঙ্গে আরো কিছু তথ্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করেন তিনি।
এরপর তিনি কথা বলেন, কুমিল্লা টাউন হলে নির্বাচন কমিশনের ফল ঘোষণা কেন্দ্রে থাকা সোমা ইসলামের সঙ্গে। প্রণবদা আমাকে আবার ফোন করে জানালেন, নির্বাচন কমিশন মাত্র তিনটি কেন্দ্রের ফল পেয়েছে।
আমি তখন তাকে জানালাম এই ফল সঠিক এবং নির্বাচন কমিশন এ ফলই ঘোষণা করবে। তারপরও তাকে বলি, ক্যালকুলেটরে যোগ করার সময় একশ বা দুইশ ভোট এদিক-সেদিক হয়ে থাকে, সেটা হতে পারে। কিন্তু, এর বেশি কিছু পরিবর্তন হবে না।
তখন প্রণবদা বললেন, আমি শাইখ ভাইয়ের (চ্যানেল আইয়ের পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ) সঙ্গে কথা বলি। কিছু সময়ের মধ্যেই শাইখ স্যার আমাকে ফোন করলেন। জানতে চাইলে কীভাবে আমি এই ফলাফল পেয়েছি?
আমি আবার বিস্তারিত খুলে বললে তিন আশ্বস্ত হন। তারপরই চ্যানেল আইয়ের স্ক্রলে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের প্রায় সব কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল প্রচার শুরু হয়। অথচ একই সময়ে অন্য চ্যানেলগুলোর কোনোটিতে তিনটি কেন্দ্রের ফলাফল কোনোটিতে দুটি কেন্দ্রের ফলাফল প্রচারিত হচ্ছিল এবং সব চ্যানেলের সাংবাদিকরা নির্বাচন কমিশনের ফল ঘোষণা কেন্দ্র থেকে ফলাফল লাইভ প্রচারের জন্য সর্বাত্মক প্রস্ততি নিয়ে রাখছিলেন।
কথাটা বললাম এ কারণে যে, সে দিন চ্যানেল আইয়ের দায়িত্বশীলরা আমার সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন আমার দেওয়া ফলাফলের সত্যতা কতটুকু! কীভাবে সংগ্রহ করলাম, সূত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু, একজন প্রতিনিধি বা রিপোর্টার হিসেবে আমার দক্ষতা বা আমাকে নির্ভর করা যায় কতটুকু ইত্যাদি।
কিন্তু গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ফল প্রকাশের আগে টেলিভিশনের দায়িত্বশীলরা সে দায়িত্বটুকু পালন করেছেন কি? যদি করে থাকেন, তাহলে ফলাফল এমন হলো কেন? কেন আপনার চ্যানেল আজ প্রশ্নের মুখোমুখি?
অতএব সাবধান! ব্রেকিং নিউজ পাওয়ার পর বা প্রতিনিধি ফোনে জানানোর পর পরই তা স্ক্রলে তুলে না দিয়ে একটু যাচাই করে নিন। তাতে আপনার চ্যানেল যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি জাতিও বিভ্রান্তির হাত থেকে বেঁচে যাবে।
আবুল কাশেম হৃদয়- সম্পাদক, দৈনিক কুমিল্লার কাগজ ও কুমিল্লা প্রতিনিধি, চ্যানেল আই, hridoycomilla@yahoo.com
০১৭১১ ১৫২৪৪৩
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৩
সম্পাদনা: আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর