বেশ কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি বাতিল নিয়ে সরকারি এবং বিরোধী দলের মধ্যে বেশ বাক্য বিনিময় শুনলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে জিএসপি নিয়ে অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণ পড়লাম।
আমেরিকাতে আসার পর জীবন-জীবিকার তাগিদে, পড়ালেখা, চাকরির ইন্টারভিউ, ভ্রমণ এবং অবশেষে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগে কাজ করার সুবাদে অনেক নামকরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাবার সুযোগ হয়েছে। এই সব প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবটিতে কোনো না কোনো জায়গায় একটি বিশেষ জিনিসের উপস্থিতি লক্ষ্য করছি তা হলো টেলিভিশনের পর্দা। সেটা হতে পারে ভবনের প্রবেশ মুখে, ক্যাফেটেরিয়া কিংবা আলোচনা কক্ষে এবং প্রায় সব টিভিতে সারাদিনই কোনো না কোনো সংবাদভিত্তিক চ্যানেল প্রদর্শিত হয়। যাতে করে আমেরিকানরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন খবরাখবর জানতে পারে। যদিও বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে আমেরিকানরা নিজের দেশের খবর ছাড়া বাইরের খবর তেমন গুরুত্ব দেয় না। সংবাদ চ্যানেলগুলোর মধ্যে আমেরিকানরা অবশ্যই সিএনএনকে বেশি প্রাধান্য দেয়।
কিছুদিন আগে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর সিএনএন চ্যানেলে দিনে কয়েকবার দেখেছি ধংসস্তূপের মধ্যে থেকে বেঁচে থাকার আকুতি। গণমাধমের সুবাদে সেটা শুধু বাংলাদেশের মানুষের নয় সারা বিশ্বের মানুষের বিবেকে নাড়া দিয়েছিল। বিদেশিদের যারা কিনা নিজেদের খবর ছাড়া অন্য দেশের খবর জানতে চায় না তারাও যেন থমকে গিয়েছিল সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে। সে সময় বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে কারা কাজ করে, কাজের পরিবেশ কেমন, বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের অবস্থান, গার্মেন্টস কর্মীদের প্রতি সে দেশের সরকার ও গার্মেন্টস মালিকদের উদাসীনতাসহ অনেক অজানা তথ্য বিশ্ববাসীকে হতবাক করেছিল। বলতে গেলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের প্রতি অনেকটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল। বিশ্ববাসী সেদিন জেনেছিল যে, ভবনের মালিক সোহেল রানা এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী এবং সে সরকারি দলের নেতা।
এরই ভেতর হঠাৎ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার দেখলাম সিএনএন চ্যানেলে। শুধু আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বের লোক দেখেছিল সেই সাক্ষাৎকার। এতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অস্বীকার করে বললেন, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা তার দলের নেতা নয়। কিন্তু পত্রপত্রিকা পড়ে, ফোনের মাধ্যমে স্থানীয় লোকদের মুখে শুনে এবং সাভারের দেয়ালে লাগানো আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মুরাদ জং-এর সঙ্গে ছবিগুলো দেখে মনে হয়েছিল রানাই সাভারের আওয়ামী লীগের ভাবিকালের মহানায়ক। এগুলো কি সবই মিথ্যা নাকি ডিজিটাল কারসাজি? আমার মনে হয় সাভারে খুঁজলে আজও সেই পোস্টারের মাথা ছেড়া দুই একটা টুকরা পাওয়া যাবে। সেদিন সেই সাক্ষাৎকারে টিভির সামনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ক্ষণিকের জন্য সত্যকে আড়াল করলেও দেশের মানুষের কাছে এটা ডাল-ভাতের মতো মনে হয়েছিল। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এমনটি বলা বিশেষ কিছু নয়।
এরপর শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম প্রসঙ্গে আমানপুরের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে প্রশ্ন করা শুরু করেন। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও যেখানে আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছিলেন তখন তিনি নিশ্চয় জানতেন সে কোন সংগঠনের লোক। প্রধানমন্ত্রী আমানপুরকে বললেন যে, তিনি ভুল তথ্য পেয়েছেন। আর এই সব ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, ‘Stop, what I am wrong about`। ইংরেজি ভাষার দুর্বোধ্যতা কিংবা অন্য কোনো কারণে হোক বাংলা ভাষা-ভাষীদের অনেকের কাছে কথাগুলো তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ মনে না হলেও আমেরিকানদের কাছে কিন্তু বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছিল।
সিএনএন-র সেই সাক্ষাৎকারটি দেখে অন্য পাঁচজনের মতো আমারও খুব খারাপ লেগেছিল। ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধি এবং একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকের শিষ্টাচার বহির্ভূত সাক্ষাৎকার সবার কাছে খারাপ লাগার কথা।
২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। যখনই কোনো প্রকার দুর্ঘটনা ঘটেছে, শত শত প্রাণ ঝরে গিয়েছে তখনই দায়সারা কিছু কাজ করে নিজেদের সাফল্য দাবি করেছে। এরপর আর একটা দুর্ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়ছে আর একটু উন্নয়নের জন্য। এমনই চলে আসছে বিগত কয়েক বছর। পোশাকশ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নে ব্যর্থ, তাদের যথাযত সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত না করা, তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে মানুষ মারা যাওয়া, সম্প্রতি রানা প্লাজা ধস এবং সর্বশেষ সিএনএন-র সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নবিদ্ধ সাক্ষাৎকার সবকিছু মিলিয়ে হয়ত জিএসপি স্থগিত হয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রীর সেই সাক্ষাৎকার তেমন আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়নি। অথচ তিনিই তো বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বর্তমান অবস্থার সারসংক্ষেপ বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী মহান সংসদে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেছিলেন যে, বিরোধীদলীয় নেত্রীর একটা কলাম লেখার কারণে জিএসপি স্থগিত হয়েছে। সেই কলামের একটা কপি সাথে করে এনেছিলেন সত্যতা প্রমাণের জন্য। `Washington Times`-এর সেই বিতর্কিত কলামটা কয়েকবার পড়েছিলাম। সেখানে কয়েকটা কথার কারণে ওবামা প্রশাসন এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবে এটা সাধারণ মানুষের কাছে হাসির খোরাক ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। বিরোধীদলীয় নেত্রীও আবলীলায় অস্বীকার করলেন যে, লেখাটা তার নয়। জানি না তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন কিনা কিন্তু লেখাটা পড়ে, লেখার নিচে কয়েকশ মন্তব্য এবং সর্বশেষ বাংলাদেশের ৭১ টেলিভিশনে প্রচারিত `Washington Times` এর নির্বাহী সম্পাদক ডেভিড এস জ্যাকসনের কথা থেকে মিথ্যার কাতার ছেড়ে সত্যের কাতারে আসতে হয়েছিল।
দেশের ছাত্রলীগ নামক সংঘটি প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি এবং জনসম্মুখে কুপিয়ে মানুষ হত্যা এবং হত্যাকারীর রক্তাক্ত ছবি দেখার পরও স্বদলীয় বড় বড় নেতারা বলেন, ছাত্রলীগ এর সাথে যুক্ত নয়। বলবেই বা কি করে, মিথ্যার বাজারে তারাই তো একমাত্র সত্যিকারের হাতিয়ার। মিথ্যাকে পুঁজি করেই তো পেছনে বসা ছাত্ররা কিংবা অছাত্ররাই রাজনৈতিক বিবেচনায় আগামী দিনের কাণ্ডারি। দেশের হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীদের দেশ গঠনের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ডেকে হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রতিহিংসার অস্ত্র। যে অস্ত্রের তেজস্ক্রিয়তা পারমাণবিক অস্ত্রের তুলনায় মোটেও কম নয়।
মিথ্যাকে মিথ্যা দিয়ে জয় করতে করতে অবশেষে দেশের তথা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ধরে টানা শুরু করেছেন, ফেলতে চাইছেন মিথ্যার গ্যাঁড়াকলে, শুধু এখানেই ক্ষান্ত নয়। `নোবেল পুরস্কার` কমিটির সিদ্ধান্তকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার সরকার ড. ইউনূসের অবদানের কথা স্বীকার না করলেও যাদের স্বীকার করার দরকার তারা কিন্তু ঠিকই স্বীকার করেছেন, পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার, কংগ্রেশনাল অ্যাওয়ার্ডসহ আরও অনেক কিছু।
২০১২ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যে কয়েকটি জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল সেখানে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিট রমনি আগামী দিনে আমেরিকার নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির জন্য যে বিশদ কর্মপরিকল্পনার কথা বলেছিলেন, তার মধ্য অন্যতম ছিল `ক্ষুদ্র ব্যবসা`। বড় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় বিনিয়োগের চেয়ে ছোট ব্যবসা সৃষ্টি ও সেখানে বিনিয়োগ করলে বেশি কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। আর এই সব চিন্তার বীজ তো বস্তুতপক্ষে ড. ইউনূস বপন করেছিলেন তার মাইক্রক্রেডিট তত্ত্বের মাধ্যমে।
বর্তমানে ক্ষুদ্র ব্যবসার বদৌলতে আমেরিকার বাজার পুরোটাই দখল করে নিয়েছে চীন। সারা আমেরিকার যে কোনো দোকানে গিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা জিনিস আনলে তাতে ‘Made in China’ লেখার সম্ভাবনা ৮০-৯০ শতাংশ। এটা শুধু আমেরিকাতে নয় উন্নত বিশ্বেও এমনটা দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও মূলনীতি একটাই ক্ষুদ্র ব্যবসা। বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চীন ছাড়া আর একটা দেশের পক্ষে তার কাছাকাছি পৌঁছান সম্ভব তা হলো বাংলাদেশ, যার প্রতিফলন অনেকটা পোশাকশিল্পে পাওয়া যায়। চীনেও এতো সস্তা শ্রম নেই যেমনটা বাংলাদেশে আছে। হলমার্কের হাজার হাজার কোটি টাকার লোপাট করে আবারও ঋণের ব্যবস্থা না করে ছোট ছোট ব্যবসা সৃষ্টিতে বিনিয়োগ করলে আজ হয়ত চাকরির কোটা আন্দলনের জন্য ছাত্রদের রাস্তাই নামতে হতো না। মিথ্যাকে পুঁজি করে একটি দুর্নীতির মাধ্যমে আর পাঁচটা দুর্নীতি সৃষ্টি না করে সততাকে সাথে নিয়ে পদচারণা শুরু করলে হয়ত আগামী দিনগুলোতে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবে।
লেখক: অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার, ইউ.এস. নেভি, মেরিল্যান্ড, আমেরিকা,
ddas1491@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৩
আরআর