ঢাকা, শনিবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আইন যখন প্রণেতার হাতে!

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৩
আইন যখন প্রণেতার হাতে!

‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’। বিটিভি আর বাংলা সিনেমার কল্যাণে এই বাক্যটুকু ছোটবেলা থেকেই মুখস্থ।

আমরা আরো জানি, ভিলেন যখন নায়ককে পিটিয়ে লাশ বানিয়ে ফেলে, তখন পুলিশের কোন খোঁজ থাকে না। কিন্তু নায়ক যখন প্রাণ বাঁচাতে ‘ইয়া আলী’ বলে লাফিয়ে ওঠে, ঠিক তখনই হাজির হয় পুলিশ।

এমনই এক সিনেমার বাস্তব রূপ দেখা গেলো শনিবার পল্টনের মেহেরবা প্লাজায়। তবে যেহেতু সিনেমার মতো এখানে কোন স্ক্রিপ্ট ছিলো না, ছিলেন না কোন ডিরেক্টর, তাই ঘটনায় কিছুটা এদিক সেদিক হলো।

একজন ক্ষমতাশালী লোক দলবল নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা দুই সংবাদকর্মীকে বেধড়ক পেটালেন। খবর পেয়ে অন্য সাংবাদিক এবং পুলিশ যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছুলো, ততক্ষণে সেই লোক আবার নিপাট ভদ্রলোক।

পুলিশ কিছু করলো না। করবে কিভাবে? ভদ্রলোকটি যে একজন আইন প্রণেতা। আইন কার হাতে থাকবে না থাকবে সেটা আইনশৃংখলা বাহিনী নিশ্চয়ই একজন আইনপ্রণেতাকে শেখাতে পারে না।

পটুয়াখালী-৩ এর সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। জনসাধারণের কাছে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। হবে নাই বা কেন? একে তো বয়সে অন্য নেতাদের চেয়ে অনেক তরুণ, তার ওপর পাঞ্জাবি-মুজিব কোট নয়, বরং শার্ট-প্যান্ট-কোট পরা ড্যাশিং একটা লোক। এমনিতেই সরকারের ব্যর্থতার কথা মানুষ গোগ্রাসে গেলে, আবার সমালোচনাকারী যদি হন সরকার দলেরই সংসদ সদস্য, তাহলে তো পোয়াবারো।

সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের রাস্তা গোলাম মাওলা রনি ছাড়তে চাননি। সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ রনি যেকোন টক শো-তে যে কোন বিষয়ে ডাক পড়লেই ছুটে গেছেন।

এই সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে এমপি সাহেব যে, যে কোন সময় নীতি পরিবর্তন করতে পারেন, তার কিছু উদাহরণ দেখা যাক। যখন এমপি সাহেবের দল আওয়ামী লীগ শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চেয়ে চলমান আন্দোলনের পক্ষে পূর্ণ সমর্থন নিয়ে হাজির, তখন তিনি ছিলেন চুপ। তবে নাস্তিক-আস্তিক বিতর্কে শাহবাগের আন্দোলনের তীব্রতা কমে আসতেই কঠোর সমালোচক বনে গেলেন গোলাম মাওলা রনি।

অথচ, জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের যখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড হলো, তখন ফাঁসির দাবিতে গোলাম ম‍াওলার চেয়ে মুখর আর কেউ নেই। এমনকি একবাক্যে সরকারের আইনমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, এমনকি দলের সভানেত্রী ও সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন রায়ে সন্তুষ্ট, তখন তিনি ফেসবুকে ‘হে প্রিয় আল্লামা সাঈদী, আপনার কাছে মাফ চাই’, টাইপের একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন।

এরও আগে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের মন্ত্রী হওয়ার কাহিনী বলে বেশ আলোচনায় এসেছিলেন এই সংসদ সদস্য। নিশ্চয়ই সবার মনে আছে, আবুল হোসেন যখন ভাঙা রাস্তা আর পদ্মাসেতু দুর্নীতি নিয়ে সমালোচনায় বিপর্যস্ত, তার যখন মন্ত্রিত্ব যায় যায় অবস্থা, তখনই এক টক শো-তে এই এমপি বলেছিলেন, আবুল হোসেন নাকি এক দৌড় প্রতিযোগিতায় জিতে মন্ত্রী হয়েছিলেন।

গল্পটা এতোটাই মজার ছিলো যে, সাধারণ মানুষেরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো- গোলাম মাওলা রনি কোন কৌতুক অনুষ্ঠানে ভাঁড়ের অভিনয় করছেন, নাকি সত্যিই একটি টক শো-তে সিরিয়াসলি কথা বলছেন।

তবে একদিনে এতো প্রচার হয়তো তিনি কখনও পান নি। ২০ জুলাই, সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক ও ভিডিওগ্রাফার নির্মমভাবে আহত হন তার এবং তার পেটোয়া বাহিনীর হাতে।

অথচ, রাতের বেলায়ই তিনি যথারীতি হাজির হন চ্যানেল আইয়ের টক শো-তে। ভাজা মাছ উলটে খাওয়া তো দূরের কথা, তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিলো মাছ যে ভাজা যায়, এই কথাটিই তিনি জানেন না।

ডাঁহা মিথ্যা কথা তিনি টেলিভিশনের দর্শকের সামনে গড়গড় করে বলে গেলেন। বললেন, তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি বললেন, তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করেন নি। নিজের সম্পাদিত ওয়েব পোর্টাল dnewsbd.com-এ তিনি বললেন, তার অসংখ্য গুণগ্রাহী (!) সাধারণ জনগণ সাংবাদিকদের গণধোলাই দিয়েছে।

কিন্তু রনি সাহেব একটা জায়গায় ভুল করেছেন। তিনি বোঝেননি যে, তার হাতে মার খাওয়ার সময়ও নিজের দায়িত্ব অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পালন করে গেছেন সাংবাদিকরা। তাদের ক্যামেরা ঠিকই তুলে এনেছে তার লাথি মারা এবং গুন্ডা লেলিয়ে দেওয়ার ছবি।

এবার ‘সদা অপ্রিয় সত্য কথা বলা’ জনপ্রিয় এই এমপি সাহেবের আসল রূপ জনগণের কাছে প্রকাশ হয়ে গেলো। অন্যের বিরুদ্ধে কথা বলে ঠোঁটকাটা বলে পরিচিত হওয়া এই জনপ্রতিনিধি যে নিজেকে বাঁচাতে কতোটা নিচে নামতে পারেন এবং কতোটা নির্লজ্জভাবে মিথ্যা বলতে পারেন, তা সবাই টেলিভিশনেই দেখেছেন।

যারা দেখেননি, তাদের জন্য কয়েকটা লিংক দিয়ে দিলাম, দেখে নেবেন।

লিংকঃ ১) http://www.youtube.com/watch?v=3RP0ODO2azw
        ২) http://www.youtube.com/watch?v=Oy-08ufPSoI


এমপি রনির কিন্তু এটাই প্রথম সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা নয়। বলতে গেলে মহাজোট সরকারের মেয়াদকালে তিনিই প্রথম সাংবাদিক নির্যাতনকারী সংসদ সদস্য হিসেবে পরিচিত হয়েছেন।

রনি এমপি হওয়ার পরপরই আলোচিত হয়েছিলেন এলাকার প্রাচীনতম রণগোপালদী নদী বক্ষ দখল করে একটি মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে। এই খবর প্রকাশ হলে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনের পর আদালত ওই মার্কেট নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেন।

২০০৯ সালের এ ঘটনায় স্থানীয় দু`জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ভুয়া ধর্ষণের মামলা দায়ের করে রনির ক্যাডাররা একজন সাংবাদিকের বাড়িঘর ভাঙচুর করে। খবর পেয়ে পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে প্রায় সব সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক গলাচিপায় যাওয়ার পথে রনির ক্যাডার বাহিনীর হামলার শিকার হয়।

নিজের নির্বাচনী এলাকা পটুয়াখালীর গলাচিপায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের নামে বরাদ্দ অর্থ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগে রনির বিরুদ্ধে তার নিজের দলের প্রবীণ নেতা অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান ৩টি মামলা দায়ের করেছিলেন।

এর একটি হলো- আবদুল বাকী মিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নামে প্রায় এক কোটি টাকা আত্মসাৎ-এর অভিযোগে। এলাকায় এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। অথচ প্রতিষ্ঠানটির নামে গত তিন বছরে সরকারের কাছ থেকে প্রায় এক কোটি টাকা অনুদান নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন আব্দুল মান্নান।

চার দলীয় জোট নেতাদের মতো মহাজোট নেতাদেরও সাংবাদিক পেটানোর অনেক উদাহরণ আছে। এর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর মিরপুর-এর সরকার দলীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারও সাংবাদিক পিটিয়ে আলোচনায় আসেন।

বিক্ষুব্ধ জনতাকে প্রকাশ্যে বন্দুক দেখিয়ে সংবাদ শীর্ষে এসেছিলেন গফরগাঁওয়ের এমপি গিয়াসউদ্দিন আহমেদও।

তবে রনি মনে হয় এ বিষয়ে সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন। এদিক দিয়েও হয়তো তিনি অন্য সবার চেয়ে জনপ্রিয় হতে চেয়েছেন।

রাজনীতিবিদরা প্রায়শই বলে থাকেন, সংবাদমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু সে স্তম্ভের যে অবস্থা তাদেরই কয়েকজন করছেন, তাতে রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগণের অবস্থা রানা প্লাজায় চাপা পড়া পোষাক শ্রমিকদের চেয়ে ভালো কিছু হবে কি?

ফিরে আসি বাংলা সিনেমা প্রসঙ্গে। আইন বিষয়ে পড়াশোনা না করলেও, বাংলা সিনেমার কল্যাণে আইনের খুব মৌলিক কিছু জিনিস জানা হয়ে গেছে। এর একটি তো শুরুতেই বলেছিলাম। আরেকটি হলো, ‘আইনের চোখে সবাই সমান’।

বড়ো হয়ে দেখলাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও বলা আছে ছোট্ট অথচ শক্তিশালী এই কথাটি।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অতীতে অনেক সাংবাদিক নির্যাতন এমনকি হত্যার ঘটনা ঘটলেও এর বেশীরভাগেরই কোন বিচার হয়নি। এর সর্বশেষ উদাহরণ সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ড। মাত্র গত মাসেই ফরিদপুরের সাংবাদিক গৌতম হত্যার রায়কেই দেশে ইতিহাসে এ ধরনের প্রথম রায় বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে।

আইন যারা প্রণয়ন করেন, তাঁরাই যখন আইন নিজের হাতে তুলে নেন, তখন দেখার বিষয়, সত্যিই কি আইন সবার জন্য সমান, নাকি রনি সাহেব এমপি!!!

অনুপম দেব কানুনজ্ঞ: ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, anupamdkan@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ২২২৭ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০১৩
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।