রাজনীতিরও পাপ-পূণ্য বলে একটা ব্যাপার আছে। খোলা চোখে তা দেখা না গেলেও ফলাফলে তার প্রমাণ মেলে।
যখন দেশ ও জাতির বুকে ঘাতক দালাল চক্রের ঠাঁই ছিল না, মানুষ তাদের সত্যি ঘৃণা করতো, তখন আমরা যুদ্ধের কান্ডারি ও নাবিক তাজউদ্দীনের কথা শুনি নি। নয় মাস যিনি আরাম আয়েশ ছেড়ে খড়ের বিছানায় শুয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁর কাছ থেকে সে কাহিনী জানার আগ্রহ ছিল না আমাদের। তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভা থেকে তাড়িয়ে দেয়া, জাতির জনকের সাথে দূরত্ব আর তার প্রতি অবিশ্বাসের জন্য একক মোশতাককে দায়ী করার ভেতর আত্মসন্তু্ষ্টি থাকলেও পূর্ণাঙ্গ সত্য নেই। আমাদের রাজনীতি গোড়া থেকেই পরিবার ও বংশ-গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। সেখানে ছায়া ও বড় হয়ে উঠতে পারে না। হলেই তাকে কোতল করা জায়েজ। এমন রাজনীতি তাজউদ্দীনের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনার পাশাপাশি আমাদের জাতির জীবনেও বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। আওয়ামী লীগ এর দায় এড়াতে পারে না। দলের নেতা ও ত্যাগী মহিমান্বিত সেকু্লার তাজউদ্দীন আহমেদ রক্ত দিয়ে তাঁর ঋণ শোধ করে গেলেও এদেশের মাটি সে রক্তের দায় ভোলে নি। আমি দৃঢভাবে বিশ্বাস করি, তাজউদ্দীনের প্রতি যে অন্যায় অবিচার হয়েছিল তা এককভাবে শুধু খুনী মোশতাকের অবদান নয়।
মূলত পরিবারতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র, চামচা স্তাবকের রাজনীতি আর দূরদর্শিতার অভাবে জাতির জনকও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। তা ছাড়া ক্ষমতাও বিষয় বটে।
পাশের দেশ ভারতের রাজনীতিতেও পাপ আছে। কিন্তু তা আমাদের মত নয় বলেই তারা এগিয়ে আছেন। চুলচেরা বিশ্লেষণে যাবার লেখা এটি নয়। মূলত মুক্তিযুদ্ধের পর বিজয়ী বীর সেনাপতি তাজউদ্দীনের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তা নিয়ে কিছু অপ্রিয় সত্য বলতে বসেছি। ভারতের কথা বললাম এই কারণে যে, সেদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও দু’জন মানুষ প্রবল প্রতাপে বিরাজমান ছিলেন। একই দলের দুই নেতা গান্ধী ও নেহেরুর সম্পর্ক আর পারস্পরিক মূল্যায়ন আমাদের জন্য জরুরি হলেও আমরা তা থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করি নি। ভারত স্বাধীন হবার পর গান্ধী বাপুজী হয়ে আশ্রমবাসীর জীবন ছেড়েছুড়ে অনায়াসে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। যদি তিনি দলাদলি বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকার জন্য তা না চাইতেন রাষ্ট্রপতির আলংকরিক পদ নিয়েও গণতান্ত্রিক ভারতের প্রথম প্রেসিডেন্ট হওয়াটা কোনো ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু তিনি চলে গিয়েছিলেন সব কিছুর ওপরে আরেক জগতে।
সাম্প্রতিক কালে নেলসন মান্ডেলার জীবনেও এর প্রতিফলন আছে। বঙ্গবন্ধু যদি তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়ে আড়ালে জাতির জনক হয়ে থাকতেন আমার ধারণা আমদের ইতিহাস এত কলংকিত হতে পারতো না। গান্ধীজী নেহেরুর বিদ্যা-মেধা-রুচি ও নেতৃত্বের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁকে পদ ছেড়ে দেয়াতে নিজে যেমন জাতির জনক ‘বাপুজী’র গৌরবে উদ্ভাসিত, তেমনি ভারত ও তার সূচনা লগ্নেই পেয়েছিল সঠিক পথ নির্দেশনা । আমাদের দুর্ভাগ্য তাজউদ্দীনের মেধা ও শ্রমের মূল্যায়ন হয়নি। অধিকন্তু তাঁকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে অপমান করে আত্মতৃপ্তির হাসি হেসেছিলাম আমরা। যে হাসি অনতিবিলম্বে রক্তের দামে তার দায় চুকিয়ে আমাদের জাতির জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। আজো তার মাশুল দিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। কেউ কেউ তাঁকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ‘ট্র্যাজিক হিরো’ বলেন।
তাজউদ্দীনকে আমি বিরহী নায়ক বা সময়ের কাছে পরাজিত বলার কারণ দেখি না। রাজনীতি আবেগের বিষয় নয়। এখানে মেধা ও কৌশল সমান কার্যকর। তাজউদ্দীনের ভেতর দুটোই ছিল। ছিল বলেই ভূট্টো তাঁকে চিনতে ভূল করেন নি। ভূট্টোর নাকি আপত্তি ছিল তাঁকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁকে দেখলেই নাকি চোয়াল শক্ত হয়ে উঠতো তার। বলতেন সাদা শার্ট পরা ছোট খাটো লোকটিকে না আনলেই কি নয়? কারণ তাজউদ্দীনকে ভাবাবেগ বা সস্তা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বশ করা যেতো না। ভারতেও তাই, মিসেস গাঁধী তো নির্দেশই দিয়েছিলেন তিনি তাজউদ্দীন আহমেদ ছাড়া কারো সাথেই গোপন কিছু শেয়ার করবেন না। এ সব কারণে মেধাহীন আওয়ামী লীগাররা তাঁকে শত্রু মনে করতেন। তার মৃত্যুর এত বছর পরও আওয়ামী লীগ তার সন্তান ও প্রতিনিধির সাথে একই আচরণ করে প্রমাণ করেছে কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না। ইতিহাসের দিকে তাকালে দলটি দেখতে পেতো তাজউদ্দীনের পরিবর্তে মোশতাকদের কথা শুনেই জাতির জনক নিহত হয়েছিলেন। কেউ বাঁচেন নি। আজ আবরো পরিবারতন্ত্র আর মাফিয়ারা ঘিরে ধরেছে। যার হাত থেকে এই নেতার পরিবার সন্তান ও রেহাই পায় নি। মাঝে মাঝে মনে হয় এই কি সেই দল যে দলের জন্য এঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন? যে দলের শীর্ষ নেতা ৩রা নভেম্বরেও শোকসভায় যাবার সময় পান না!
তাজউদ্দীন আহমেদ এ দেশের মাটির সন্তান। তাঁর জীবন কথার নয় কাজের। অর্থ-বিত্তের নয় প্রতিভার। এমন মানুষকে নিয়েই লেখা হয়েছিল "আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’’ কাজে বড় এই মানুষটিকে তার দল মূল্যায়ন করুক বা না করুক আমাদের করতে হবে। ডুবুডুবু রাজনীতির সততা আর মেধাহীনতার ঘোর দুর্দিনে তিনি আলোর বাতিঘর। জন্মদিনে তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৩
সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর