পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সরকারি দলের মন্ত্রী, এমপি, কিম্বা নেতাকর্মীদের হাতে সাংবাদিক নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। সব সরকারের আমলেই কমবেশি সাংবাদিক পিটিয়েছেন দেশের এসব সোনার (!) মানুষ।
তারপরও বিভিন্ন সময়ে তাদের সঙ্গে আপস করে এসেছেন সাংবাকিদরা। সংবাদ সংগ্রহ করতে গেছেন? পুলিশ বা সরকারি দলের ক্যাডাররা অকারণে চড়াও হলো গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর। সাংবাদিকের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিলো, রাস্তায় ফেলে পেটালো ইচ্ছেমত।
তারপর কি হলো? রক্তমাখা শরীরে ক্ষুব্ধ সাংবাদিকরা দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত কাজ না করার সিদ্ধান্তে হাত-পা গুটিয়ে বসে গেলেন রাজপথে। নিমিষে খবর চলে গেল পুলিশ বা সরকারের শীর্ষ মহলে। ছুটে এলেন কর্তাব্যক্তিরা। আশ্বাস দিলেন তদন্তের পর দোষীদের বিচার করা হবে। এক কি দু’বার ‘সরি’ বললেন আর তাতেই মহাখুশি সাংবাদিকরা ফিরে এলেন কাজে।
সংবাদ না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে বেঁচে গেল জাতি।
কাটল কিছুদিন। এবার মারমুখি হলেন গুণধর এক মন্ত্রী। সব সাংবাদিক তাঁর পেছনে ছুটছেন একটি হেডলাইনের আশায়। কথা নেই, বার্তা নেই, হঠাৎ খেঁকিয়ে উঠলেন মন্ত্রীবর—আমি আপনাদের ডেকেছি? কেন আমার পেছনে ছুটছেন? যান এটা আমার আচানক সফর?
সাংবাদিকরা বললেন, আপনি ডাকেননি বললেই তো হবে না। আপনার অফিস থেকে ফ্যাক্স পাঠানো হয়েছে বলেই আমরা এসেছি।
সৎ (!) ও উদ্যমী (!) ওই মন্ত্রীর সঙ্গে চলল কিছুক্ষণ বাক-বিতণ্ডা। এক সময় ঠাণ্ডা হলো পরিস্থিতি। অত:পর এবং তারপরও ওই মন্ত্রী ভদ্রলোকের শুদ্ধ অপমান ভুলে সংবাদ সংগ্রহ করেছেন/করছেন সাংবাদিকরা। কারণ, গণমাধ্যম কর্মীরা একটি তত্ত্বকথা বিশ্বাস করেন। তা হলো- তুমি অধম, তাই বলে আমি উত্তম হবো না কেন? বোধ করি সে কারণেই ওই মন্ত্রী মহোদয়ের একাধিকবার এমন আচরণের পরও তার পেছনে ছুটে গেছেন সাংবাদিকরা।
....বিষয়টি আপাত:দৃষ্টিতে ছোট্ট ঘটনা মনে হলেও একেবারে ফেলে দেওয়ার মত বিষয় নয়। কেননা এসব ঘটনা থেকেই অন্যেরা একই ধরনের ব্যবহার করার অণুপ্রেরণা পায়। আর যখন তখন সাংবাদিকদের অপমান করার সাহস পান সরকারি দলের লোকজন। তারপরও পেশার খাতিরে, দায়িত্ববোধ থেকে কর্তব্যকাজ থেকে পিছপা’ হননি গণমাধ্যম কর্মীরা।
সাংবাদিক পেটানোর তালিকায় সবশেষ সংযোজন হলেন আওয়ামী লীগের আরেক সোনার ছেলে (!) গোলাম মাওলা রনি। সুযোগ পেলেই যিনি সংবাদ মাধ্যমে হাজির হয়ে জাতিকে নীতিকথা শোনান, তিনিও দেখিয়ে দিলেন তার আসল চেহারা। বুঝিয়ে দিলেন, তিনি বাংলাদেশেরই একটি বড় রাজনৈতিক দলের একজন রাজনীতিবিদ। তারপর যথারীতি অন্যদের মতই অস্বীকার করলেন ওই ঘটনায় জড়িত থাকার সত্যতা।
এ প্রসঙ্গে এক লাইনের একটি উদাহরণ দিতে চাই। আমার গ্রামের বাড়িতে এক জেলে এসব ঘটনার ক্ষেত্রে বলত, বাটিভরা গরুর মাংস খেয়ে যদি বলেন খাইনি, তাহলে কার কী করার আছে? এই উদাহরণটি কেবল রনির জন্য না, এ দেশের সেসব সোনার মানুষের জন্য যারা অপকর্ম করেও অস্বীকার করেন।
আসলে এসব সম্ভব হচ্ছে সাংবাদিকদের জন্যই। কারণ আমরা সব ভুলে যাই। সাংবাদিক লাঞ্ছিত হওয়ার একটি ঘটনারও আজ পর্যন্ত বিচার হয়েছে কি? একটিরও বিচারের দাবিতে আমার একদিন, এক ঘণ্টা কলম বন্ধ রাখতে পেরেছি? পারিনি। কেন পারিনি সে উত্তর খোঁজা অবান্তর।
তবে সহজ কথা হচ্ছে- সেসব ঘটনার বিচার করাতে পারিনি বলেই দু:শাসনের এই কুচক্রটি বারবার আমাদের নিগৃহীত করেছে। আমরা সংঘবদ্ধ হতে পারিনি বলে, আমাদের মধ্যেও সরকার ও বিরোধী দল আছে বলেই সাগর-রুনি হত্যার বিচার কেঁদে ফিরছে হিমঘরে।
আমরা নিগৃহীত হই বারবার, কারণ আমরা ঐক্যবদ্ধ নই। সাগর-রুনির বিচার নিয়ে আমরা এক কাতারে দাঁড়াতে পেরেছি? পারিনি। গোলাম মাওলা রনি ইস্যু নিয়ে আমরা সবাই কি শুনেছি সবার কথা? শুনিনি। এই ‘না’র উত্তর কে দেবে? কেন আমাদের মধ্যে এই বিভক্তি? কেউ কি খুজেঁ বের করার চেষ্টা করেছেন?
সাংবাদিকদের মধ্যে বিভক্তি আগেও ছিল, এখনো আছে। বিভক্তি আছে কারণ আমরা কেউ আওয়ামী লীগ করি, কেউ করি বিএনপি, আবার কেউ জামায়াত। বিভিক্তি আছে কারণ একটাই প্রেসক্লাব। সেখানে সদস্য হতে কত যে কাঠখড় পোড়াতে হয়! তারপরও সবার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে না। ফলে অস্তিত্ব টেকাতে বাধ্য হয়েই নতুন নতুন সংগঠন খোলেন সাংবাদিকরা। দশ সংগঠনের দশ মত। কে শুনবে কার কথা? একে অন্যের কথায় প্রাথমিক সায় দিলেও, পরে তা আর কার্যকর হয় না।
কথা, আহ্বান বা অনুরোধ না শোনার এই সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে বেসরকারি টেলিভিশন চালু হওয়ার পর থেকে।
বিষয়টিকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না ধরে নিয়ে বলতে চাই, টিভি চ্যানেলগুলোর টিকে থাকার প্রধান অনুষঙ্গ বিজ্ঞাপন। কোটি টাকা খরচ আছে একেকটা প্রতিষ্ঠানের। সে টাকার যোগানদাতা যারা, তাদের শর্ত থাকে- প্রতিদিন কোন অনুষ্ঠানে কত মিনিট তাদের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে। কিছু কিছু অনুষ্ঠান তো ব্রান্ডিং-ই করা থাকে।
ফলে কি হয়? সব সাংবাদিক আন্দোলনে শরিক হতে পারলেও, টিভি সাংবাদিকরা পারেন না। তাদের নিউজের কাউন্টডাউন থেকে শুরু করে হেডলাইন, কামিং আপ, বিজনেস, আন্তর্জাতিক, খেলার খবর, ব্যবসা-বাণিজ্য…যা আছে সব স্টিং-ই বিক্রি করা।
একদিন কেবল নঙ, একবার যদি কারো বিজ্ঞাপন না যায়, তাহলে শর্তভঙ্গের অযুহাতে হয়ত পুরো মাসের বিজ্ঞাপন বিলই কেটে নেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। সে কারণে সংবাদপত্র বা অনলাইন পত্রিকাগুলো এক/দু’ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করতে পারলেও, কখনো কখনো এক বা দু’টি কলাম ফাঁকা রাখতে পারলেও টিভি সংশ্লিষ্টরা সেটি করতে পারেন না।
এই যুক্তির খাতিরে এটি না হয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু দেশের শীর্ষ সাংবাদিক নেতারা যদি কাউকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তা মেনে চলতে সব টিভি চ্যানেলের প্রতি আহ্বান/অনুরোধ জানান, তবে তা বিনা প্রশ্নে সবারই মেনে নেওয়া উচিত।
যত বড় টক শো’ই হোক না কেন আলোচক বদলানো কোন বড় বিষয় না। এক ঘণ্টার নোটিসে একাধিক গেস্ট বা আলোচক স্টুডিওতে হাজির করা যায়।
প্রশ্নটি হচ্ছে, নিজের জাতভাইদের পেটানোর সঙ্গে জড়িত মান্যবর (!) এমপি মহোদয়কে বয়কট করার সাংবাদিক ভাইদের আহ্বান নির্দিষ্ট চ্যানেলটি কেন শুনলেন না? কি এত খাতির রনির সঙ্গে? তাকে আলোচনার টেবিলে না বসালে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত? রনি কি তাদের বিজ্ঞাপন (!) দিয়ে সেদিন আলোচনায় ঢুকেছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। আজকাল বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেক কিছুই বলা/করা সম্ভব।
যা-ই হোক, সব কথার এক কথা হলো, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কি কোন উপায় নেই? আমরা যে দলই করি না কেন, নীতির স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকাটা খুবই জরুরি। যুগে যুগে একটি অদ্ভূত ব্যাপার দেখেছি, কেউ কোন পুলিশ সদস্যকে লাঞ্ছিত বা অপমান করলে গোটা পুলিশ বাহিনী একাট্টা হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, একটি পুলিশ কাউকে পেটানো শুরু করলে, পাশে এবং দূরে থাকা তার সব সহকর্মীই ছুটে আসেন তাকে সহায়তা (!) করতে। সবাই মিলে যাকে মারছেন তার আদৌ কোন দোষ আছে কি-না তা তারা একবারও ভেবে দেখেন না। ভাই বা সহকর্মীর স্বার্থে সব পুলিশ এক।
অস্বীকার করার জো নেই, বড় পদ ছাড়া পুলিশ বাহিনীর ৮০ শতাংশ সদস্যই খুব বেশি শিক্ষিত নন। এএসসি বড়জোড় এইচএসসি। শিক্ষাগত যোগ্যতার উদাহরণটা এজন্য দিলাম যে, এত কম শিক্ষিত হয়েও একটি শ্রেণির লোকদের মধ্যে যদি পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা বা দরদ থাকতে পারে, তবে এত বেশি পড়াশোনা করেও সাংবাদিকদের মধ্যে এই বোধটা নেই কেন? কেন পরস্পরের প্রতি কাঁদা ছোঁড়াছুড়িঁ?
সবশেষ প্রশ্নটি হচ্ছে, এ থেকে উত্তরণের কি কোন উপায় নেই? উত্তর হচ্ছে- আছে। বেসরকারি টিভিগুলোর জন্য দ্রুত একটি নীতিমালা দরকার। সরকারি নয়, সরকার যেটি দেবে তার বাইরেও, চ্যানেল মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সাংবাদিকরা একটি আলাদা নীতিমালা করবেন। এতে মালিকদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে কিভাবে সাংবাদিকদের মান-ইজ্জত শতভাগ বাঁচিয়ে রেখে করা যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
আব্দুর রউফ: যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, মোহনা টেলিভিশন, editorrouf@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৪২২ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৩
জেডএম/