আমাদের দেশ এক সময় বৃটিশ উপনিবেশ ছিল। আমাদের রক্তে, ধমনীতে এখনো ইংরেজপ্রীতি বহমান।
উইলিয়াম ও তার রাজপুত্রের দেশটি সংসদীয় গণতন্ত্রের পাদপীঠ। তারাই দুনিয়াকে এই সরকার ব্যবস্হা উপহার দিয়েছে। এটা ঠিক সে দেশে রাজতন্ত্র আছে এবং তারা ‘গড সেইভ দ্য কুইন’ বলে যতই গলা ফাটাক না কেন সরকার ও শাসনে রাজা-রানীর হাত নেই। একথা সত্য যে সবাই রানীকে মান্য করেন। তাঁকে তাঁর পরিবারকে নিয়ে কৌতুহলেরও অন্ত নেই; কিন্তু সবই প্রতীকী। বরং জনশ্রুতি আছে উপসাগরীয় যুদ্ধে যাবার বিষয়টি রানীকে সঠিকভাবে জানানো হয়নি বলে তিনি টনি ব্লেয়ারকে ডেকে তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেন নি। নিন্দুকেরা বলে এজন্যে টনি উইলিয়ামের বিয়েতে ও দাওয়াত পাননি। যার মানে এই যুগ যুগ ধরে চলে আসা রানী ভিক্টোরিয়ার রানীতন্ত্র পোশাকি। সেখানে উইলিয়াম বা হ্যারি মিডিয়ার আলোয় উদ্ভাসিত হলেও তাঁরা কখনোই দেশ চালাবেন না। ফলে তাদের জন্য উচ্ছ্বাস বা আবেগের মানেই হলো নেহায়েতই কোনো একটি প্রথা বা কৌলিন্যের জয় জয়াকার।
এই আমরা যারা বাঙালির সে উচ্ছ্বাস নিয়ে বড় বড় কথা বলছি, ঔপনিবেশিক রক্ত বলে লাফাচ্ছি, আমাদের দেশে এখন কি ঘটছে? বঙ্গবন্ধু দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এখন ঢাকায়। তিনি দেখতে সুদর্শন। রুচিবান, উচ্চশিক্ষিতও বটে। দেশে আসবেন দেশে থাকবেন দেশের কাজে লাগবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু আসলে কি তাই? তিনি যদি রাজনীতিতে আসতে চান আসতেই পারেন। আমদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ইন্দিরাদৌহিত্র রাহুল কি আসেন নি? আসার জন্য এখনো কাঠখড় পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছেন। তার যে ঘরানা বা পরিচয় চাইলে তিনি কালই মূল পদে চলে আসতে পারেন। কিন্তু না, বলতে গেলে তৃণমূল পর্যায় থেকেই যাত্রা শুর করেছেন রাহুল। পাকিস্তানের প্রয়াত নেত্রী বেনজিরকেও দেখেছি আমরা। ’৭৩ সালে সিমলা চুক্তির সময় থেকে পিতার সাথে থেকে রাজনীতি শিখেছিলেন। একেই বলে রক্ত থেকে মেধার উত্তরাধিকারে প্রত্যাবর্তন।
সজীব ওয়াজেদ জয় একটি ইফতার পার্টিতে প্রধান অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন। সে তিনি যেতেই পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আমাদের দেশের অন্য কোনো ক্ষেত্রে এমন উদাহরণ দেখি না। কেউ কোনোদিন শামসুর রাহমানের পুত্রকে প্রধান অতিথি করে কবিতা পাঠের আসর করে না। কেউ হুমায়ূন আহমেদের পুত্রকে অতিথি করে উপন্যাসের আলোচনা বা ফিতা কাটাবেন না। যদি না এই সন্তানগুলো মেধায় কবি বা লেখক হয়।
শুধু রাজনীতির বেলায় আমরা একটি অদ্ভুত নিয়ম মানছি। জয় বা তারেক সে নিয়মের যোগসূত্র। একজন সরব হলে আরেক জন নীরব থাকবেন না। আগেই বলেছি, রাজনীতি একটি জটিল বিষয়। তার জন্য উপযুক্ত ট্রেনিং আর জীবনব্যাপী সাধনার প্রয়োজন হয়। জয় যদি তা করে আসেন তা হলে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তার ভেতর রক্তের উত্তরাধিকার ব্যতীত আর কোনো সারাংশ নেই। এই প্রক্রিয়া দেশেজুড়ে লীগ দল বা অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির তারুণ্যের জন্য আশার কিছু নয়। তিনি যাঁর দৌহিত্র সে মানুষটি কোনো পরিচয় বা বংশ গৌরবে দেশের নয়নমণি হয়ে ওঠেন নি।
একান্তই নিজের শক্তি আর মেধার ওপর ভর দিয়ে তিনি বাঙালির জন্য একটি স্বতন্ত্র দেশের জন্ম দিয়ে গেছেন। এর মানে এই নয় যে, তাঁর রক্তের উত্তরাধিকারই সর্বত্র বিপুল প্রতাপে বিরাজ করবে।
তারেকের কথা বলছিলাম। তিনিও একইভাবে দেশ শাসনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলেন। নিজেতো ডুবলেনই, দেশ দল সব ডুবিয়ে এখন মামলার আসামি। এতকিছুর পরও আমাদের দেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ এদের পৃষ্ঠপোষক। এক শ্রেণির নেতা এই যুবকদের ধামা ধরে হলেও মন্ত্রিত্ব বা পদ সামলাতে আগ্রহী। এতে গণতন্ত্রের ‘গ’-ও অবশিষ্ট থাকবে না। আমরা চাই প্রতিযোগিতামূলক নেতৃত্ব। সে জায়গায় যে বিজয়ী তাকেই আগামী দিনের নেতা বানানো হোক।
তা যদি না হয় হাওয়া ভবনের মত ভবনে মাথা কুটে মরবে গণতন্ত্র ও আশা ভরসা। অথবা হঠাৎ এসে কেউ বলবে: আমার কাছে খবর আছে আমরা আগামীবার জিতে গদিতে আসছি। সো নো চিন্তা ডু ফুর্তি!
অথচ আমাদের কাছে খবর আছে সামনে আসলে প্রগতি ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য খারাপ খবর আছে। তাদের ঘর সামলানো না গেলে এদেশে মানুয মানুষের মত থাকতে পারবে কিনা তারও গ্যারান্টি নেই। আর এটা বিলকুল সত্য বাঙালি হিসেবে টিকে থাকাটাই দায় হয়ে পড়বে। অথচ সেটাই জানি না বা জানানো হয় না। সেজন্যই মাটির কাছাকাছি কান পেতে থাকি যদি নতুন কারো পদধ্বনি শোনা যায়!
অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর