ঢাকা: প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই বা টিভি চ্যানেলের সামনে বসলে বিভিন্ন খাদ্য ও পানীয়ের বিজ্ঞাপন দেখতে হয় আমাদের।
ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যকে ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরবেন, তার গুণাগুণ বর্ণনা করবেন, এতে দোষের কিছু নেই।
বিজ্ঞাপন পণ্যের গুণাগুণ সম্পর্কে নানা তথ্য সরবরাহ করে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে তার মধ্যে চাহিদার সৃষ্টি করে ও শেষে পণ্যটি কেনার প্রতি ক্রেতার ইচ্ছা জাগায়।
কিন্তু, সাম্প্রতিক প্রচারিত খাদ্য ও পানীয়ের বিজ্ঞাপনে আমরা কী দেখছি? অধিকাংশ বিজ্ঞাপনই মিথ্যা তথ্যে ঠাসা। ক্রেতাকে সঠিক তথ্য সরবরাহের বদলে বিভ্রান্ত করে। যে চাহিদা নিয়ে ক্রেতা পণ্যটি কেনেন, পরে তা না পেয়ে প্রতারিত হন। উপরোন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব খাদ্য ও পানীয় স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতিও করে।
‘তাজা আমের রস’, ‘তাজা কমলার রস’, ‘আসল আমের মজা’ ইত্যাদি বলে যে সব বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, সেগুলোর অধিকাংশতেই শুধু ‘তাজা আমের বা কমলার’ ছবিটাই থাকে, আসলে তাজা আম বা কমলার কিছুই থাকে না।
পানির সঙ্গে কিছু সিএমসির দ্রবণ, সরবিটল, ম্যানিটল, কৃত্রিম মিষ্টিকারক, প্রিজারভেটিভ, কৃত্রিম রঙ এবং আমের বা কমলার কৃত্রিম সুগন্ধ মিশিয়ে ‘তাজা’ ও ‘আসল’ রসের ‘স্বাদ’ দেওয়া হয় ক্রেতাকে!
‘কোনো কৃত্রিম রং নেই’ বলে যারা বিজ্ঞাপন দেন, তারা কিন্তু ক্রেতাকে জানাচ্ছেন না যে, তারা আসলে শতকরা কতভাগ আসল আমের বা কমলার রস দিচ্ছেন!
‘হাতের স্পর্শ নেই বলে কোনো প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় না’-কথাটার মানে কী? প্রিজারভেটিভ ব্যবহারে কি হাতের স্পর্শ লাগে? নাকি জীবাণুর গ্রোথ ঠেকানোর জন্য হাত লাগানো হয় না? বিজ্ঞান বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান আছে এমন ক্রেতাও এসব বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হবেন। এসব বিজ্ঞাপন দেখলে মনে হয়, বিজ্ঞানও এখন আবার নতুন করে পড়তে হবে!
বিজ্ঞাপনে উপস্থাপিত ফলের রসে আসল ফলের রস না থাকায় ক্রেতাকে প্রতারণার শিকার হতে হয়। কিন্তু, এসব কৃত্রিম ফলের রসে ওপরে বর্ণিত যেসব উপাদান দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে প্রধান ক্ষতিকারকগুলো হলো- কৃত্রিম রঙ, কৃত্রিম মিষ্টিকারক ও প্রিজারভেটিভ। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে কৃত্রিম রঙ।
স্বাস্থ্যের ওপর কৃত্রিম রংয়ের ক্ষতিকারক দিকগুলো আলোচনা করা যাক। তারপর পাঠক সিদ্ধান্ত নেবেন শিশুকে বিজ্ঞাপনের ‘তাজা’ আর ‘আসল ফলের রস’-এর নামে এ সব কৃত্রিম রং খাওয়াবেন কিনা!
কৃত্রিম মিষ্টিকারক ও প্রিজারভেটিভ উপাদানগুলোর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা যেতে পারে। তবে আপাতত সংক্ষেপে বলা যায়, কৃত্রিম মিষ্টিকারকগুলো খেলে মূত্রথলিতে ক্যান্সার, মায়োকার্ডিয়াল ক্যালসিফিকেশন অর্থাৎ সহজ কথায় হৃদপিণ্ডের মাংসপেশি শক্ত হয়ে যাওয়া, করোনারি ভেসেলসের স্ক্লেরেসিস অর্থাৎ হৃদপিণ্ডের ধমনি-শিরাগুলোর চর্বি জমে শক্ত হয়ে যাওয়া, রিনাল হাইপারপ্লেসিয়া অর্থাৎ কিডনি বড় হয়ে যাওয়া, ফুসফুস, লিভার এবং লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমের টিউমার, ফটোসেনসিটাইজেশন তৈরি অর্থাৎ এটি খেয়ে রোদে বেরুলে গায়ের রঙ কালো হয়ে যাওয়া, কোনো কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের বিশোষণে বাধা দেয় বলে কোনো কোনো জীবাণুজনিত অসুখ জটিল আকার ধারণ করা, ক্রোমোজমের ক্ষতি অর্থাৎ বাবা-মা এটি খেলে বিকলাঙ্গ বা অস্বাভাবিক শিশু জন্ম নেওয়া এবং গর্ভবতী মায়েরা এ সব খেলে বাচ্চা ডাউনস সিন্ড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার বৈজ্ঞানিক অভিযোগ রয়েছে।
দুই.
আজকাল পত্রিকা ও টিভিতে দেশি-বিদেশি হরেক নামের ‘কোলা’ পানীয়ের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। দীর্ঘদিন অভিযোগ করা হচ্ছে, কোলা জাতীয় কোমল পানীয়গুলো শিশুস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। অথচ এগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে শিশু-কিশোররা প্রলুব্ধ হয়। ‘কোলা’ জাতীয় পানীয় শিশুদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি কীভাবে করে, এবার সে বিষয়ে আলোচনা করা যাক।
‘কোলা’ জাতীয় পানীয়তে অন্যান্য ক্ষতিকারক উপাদানের কথা বাদ দিয়ে শুধু ক্যাফেইনের কথাই ধরা যাক। এক কাপ চা-তে প্রায় ২০-২৫ মি.গ্রা. ক্যাফেইন থাকে। এক কাপ/মগ কফিতে থাকতে পারে প্রায় ৫০ মি.গ্রা. পর্যন্ত ক্যাফেইন। অথচ কোনো কোনো কোল্ড ড্রিংকসের এক বোতল/ক্যানে থাকে ১০০ মি.গ্রা. পর্যন্ত ক্যাফেইন।
শিশুদের চা খেতে দেওয়া হয় না তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে বলে। অথচ তার আবদারে বা নিজে থেকেই অনায়াসে একটি কোমল পানীয় কিনে দেওয়া হচ্ছে। তারমানে ক্যাফেইনের হিসেবে শিশুকে একেকবারে প্রায় চার থেকে পাঁচ কাপ চা খেতে দেওয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞাপনগুলো না দেখলে হয়ত শিশু সন্তানকে এ সব কোমল পানীয় কিনে দেওয়ার ইচ্ছে হতো না অথবা শিশুরাও হয়ত এগুলোর জন্য আবদার করে বসতো না। কিন্তু, বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে শিশুর সঙ্গে স্বয়ং অভিভাবকরাও প্রলুব্ধ হচ্ছেন। কারণ, বিজ্ঞাপনে ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে। এসব কোমল পানীয় যে শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর (পরিমাণে বেশি হলে বড়দের ক্ষেত্রেও) বিজ্ঞাপনে তা লুকিয়ে রাখা হচ্ছে।
স্বনামধন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবিশ্বাস্য অভিনয়ের চমকে পানীয়টি সম্পর্কে ক্রেতার মনে এক ধরনের মোহ তৈরি হয়। ফলে, ক্রেতা অবচেতন মনে পণ্যটির দিকে হাত বাড়ান। অবচেতন মনেই সেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতো নিজেকে ভেবে একধরনের তৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞাপনের প্রতারণার বিষয়টিকে আমলে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না তিনি।
বলে রাখা দরকার, অল্প ক্যাফেইন নিমিষে শরীরকে চাঙা করে। নিয়মিত কোলা জাতীয় পানীয় অর্থাৎ বেশি পরিমাণে ক্যাফেইন খেলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, ঘুম কম হওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, প্রাত্যহিক খাবার ভালো না লাগা, কিডনিতে চাপ পড়ার কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, নেশা হওয়ার কারণে বার বার কোলা জাতীয় ড্রিংকস খেতে চাওয়া এ সব বদ-অভ্যাস দেখা দেয়।
তাছাড়া, গণিত ও ইংরেজির মতো বিষয়গুলোতে গভীর মনঃসংযোগ প্রয়োজন হয় বলে কোলা জাতীয় পানীয় পান করলে এগুলোতে অনীহা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
বিজ্ঞাপনের মোহে পড়ে কোলা জাতীয় পানীয় খুব অল্প বয়স থেকেই নিয়মিত ও বেশি বেশি পছন্দ করার কারণে মানসিক যে অবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটি আসলে এক ধরনের নেশাই।
এসবে আসক্তির ফলে আরো বড় ধরনের কোনো নেশা যে ধরবে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ এসব কিছুই হয়ত ঘটতো না, যদি কোলা জাতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন তাকে প্রলুব্ধ না করতো; যদি পানীয়গুলোর বিজ্ঞাপনে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করা হতো।
তাই, আমরা দাবি করছি, কোলা জাতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনে শিশুদের ব্যবহার বা তাদের প্রলুব্ধ করা অবিলম্বে বন্ধ করা হোক।
আমরা বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবি জানাচ্ছি না। শুধু বলছি, যা সত্য নয়, বিজ্ঞাপনে তা বলা বন্ধ হোক। ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করে নয় বরং সঠিক তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হোক। সঠিক তথ্য জানা ভোক্তার আন্তর্জাতিক ও জাতিসংঘ স্বীকৃত অধিকার।
সঠিক তথ্য উপস্থাপন করলে কোনো টিভি-চ্যানেলেরও আয় কমবে না, কোনো সৎ ব্যবসায়ীরও ক্ষতি হবে না। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যা কিছু ক্ষতিকর, তা প্রচারে সরকারের পক্ষ থেকে বাধা দিতে হবে। জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে এবং মানুষকে বিজ্ঞাপনের কোনো অসত্য প্রচারণা থেকে রক্ষা করতে সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে একটি বিজ্ঞাপন নীতিমালা তৈরি করা।
বিজ্ঞাপন নীতিমালা থাকলে কোন বিজ্ঞাপন প্রচার করবে, আর কোনটা করবে না, পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো নিজে থেকেই বাছাই করতে পারবে। বিজ্ঞাপনে নীতিমালা বহির্ভূত কিছু থাকলে বিজ্ঞাপনদাতাকে তা সংশোধনের জন্য বলতে পারবে। প্রতারিত না হলে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল এমনকি পণ্যের প্রতিও ক্রেতার আস্থা বাড়বে।
যে সব দেশে খাদ্যে নকল, ভেজাল মেশানো হয় না, সেসব দেশে খাদ্যপণ্যের অসত্য বিজ্ঞাপন প্রচারের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ থাকে। কারণ, অসত্য বিজ্ঞাপনের ফলে ক্রেতা-ভোক্তা বিভ্রান্ত হয়, অসত্যকে সত্য বলে সরলমনে গ্রহণ করে।
ব্রিটেনে বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের জন্য রয়েছে ‘এডভার্টাইজিং স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি’। বিজ্ঞাপনটি সত্য ও রুচিবোধ সম্পন্ন কিনা এমন সব বিষয় দেখভাল করে প্রতিষ্ঠানটি।
বিজ্ঞাপন তৈরি ও তা প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া সুর্নিদিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে, যা উৎপাদক কোম্পানিগুলোকে মানতে হয়। কেউ তা না মানলে কিংবা ক্রেতা-ভোক্তা প্রতারিত হলে অভিযোগের ভিত্তিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞাপনে অসত্য তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) অত্যন্ত সতর্ক। আমাদের দেশে এ রকম একটি এফডিএ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৮ সাল থেকে দাবি জানানো হচ্ছে। কিন্তু, কোনো সরকারের পক্ষ থেকেই আজ পর্যন্ত ইতিবাচক জবাব পাওয়া যায়নি।
লেখক: অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, abmfaroque@yahoo.com, abmfaroque@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৭১১ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৩
সম্পাদনা: হুসাইন আজাদ, নিউজরুম এডিটর, আশিস বিশ্বাস, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর