নীরদ সি চৌধুরীকে চেনেন না এমন বাঙ্গালি বিরল। যারা লেখালেখি করেন বা সাহিত্য সংস্কৃতির খবরা খবর রাখেন তাদের মনোজগতে নীরদ সি সর্বভূতে বিরাজমান।
প্রবাসী যে আমৃত্যু বিলেতেই থেকে গিয়েছিলেন। যদিও তাঁর শেষ জীবনের স্বপ্ন ছিল কিশোরগঞ্জের বটতলায় শুয়ে থাকা। সে অভিলাষ পূরণ হয়নি তাঁর।
সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। যা বলছিলাম, নীরদ সি যদ্দিন দিল্লিতে ছিলেন, ভারতের এই খরাপীড়িত শহরেও তিনি স্যুট-কোট পরে ঘুরে বেড়াতেন। দর দর করে ঘামলেও তাঁর মাথায় থাকতো বিলেতি হ্যাট। বিলেত যাবার পর পরই সে পোশাক পাল্টে গিয়েছিল। একেবারে উল্টো তখন। প্রচন্ড শীতেও তাঁর পরিচ্ছদ ছিল পাঞ্জাবি আর পাজামা।
অসামান্য প্রতিভাবান এই লেখক ‘স্যার’ উপাধি পেয়ে রানী সন্দশর্নে যাবার কালেও বাঙ্গালি পোশাক ছাড়েন নি।
দেশপ্রেম কিনা জানি না তবে এজাতীয় পোশাক নির্বাচন ও আজীবন তা বজায় রাখার ভেতর তেজ আর স্বদেশপ্রীতির ঔজ্জ্বল্য আছে। কারণ তিনি দেশের বাইরে গিয়ে গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসান নি। একটি বিশেষ কারণে তাঁর এই পোশাক ও বাঙ্গালি চরিত্রের কথা আজ খুব মনে পড়ছে।
আমাদের দেশ রাজনীতিপ্রবণ, সমাজ দলনির্ভর, শাসন প্রায় পরিবারতান্ত্রিক। গণতন্ত্রের সূচনা আর নির্বাচনমুখি গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে আমরা আশা করেছিলাম যোগ্যতা মেধা আর প্রিয়তাই নেতা নির্বাচনের চাবিকাঠি হয়ে উঠবে। এখন মনে হচ্ছে সে আশা আরো বহুবিধ আশার মত চিরকাল মরীচিকা হয়েই থেকে যাবে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। তাঁর অকুতোভয় নেতৃত্ব আর ব্যক্তিত্বের একনিষ্ঠ ভক্ত। তাই তাঁকে যেকোনো ফ্রেমবন্দি হতে দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। বলাবাহুল্য তাঁকে যারা অপছন্দ করেন বা অকারণে গালমন্দ করেন তাদের ত্রিসীমানা মাড়াতে রাজী নই আমি। একইভাবে আজ তাঁর আদর্শের ধারক-বাহক নামে পরিচিত বা দাবিদার দলটির দিকে তাকালেও আমার মন খারাপ হয়ে যায়। বাঘ বা সিংহের ঔরসে বাঘ ও সিংহ জন্মাবে এটাই তো ন্যায্য প্রত্যাশা। তার হাঁকডাকও হবে হুংকারের মত গগনবিদারী। আমার নেতা শেখ মুজিবের তা ছিল ছিল বলেই পাকিস্তানি খান বাহাদুররাও তাঁর সামনে দাঁড়াত ভয় পেতো। বাঘা বাঘা পাকিস্তানি জেনারেল ও সেনাশাসকদের তর্জনী তুলে শাসাতেন তিনি। এই তর্জনী একাত্তরের ৭ই মার্চ হয়ে উঠল ইতিহাস।
যা আমাদের জাতির দুর্দিনে ভরসার প্রতীক। বঙ্গবন্ধুর আর একটি বিশেষত্ব তাঁর পোশাক. পাঞ্জাবি পাজামার পাশাপাশি তিনি যে বিশেষ কোটটি পরিধান করতেন সব নাম ঘুচিয়ে তার নাম আজ মুজিবকোট। এই কোটটিকেও ছাড় দেয়নি তাঁর অনুসারী নামে পরিচিতজনেরা। জীবনের কোনো ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু নেই, তাঁর আদর্শের ছিটেফোঁটা নেই, ধারণা নেই জীবনাচরণে লেশমাত্র তা ছোঁযা পর্যন্ত নেই; শুধু কোটটা গায়ে চাপিয়েই আওয়ামী লীগার! দিন বদলের নামে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়া সেইসব বাম-ডানরাতো বটেই, এমনকি যারা একদা বঙ্গবন্ধুর চামড়া খুলে নিতে দৃঢ় শপথ করেছিল তারাও আজ এই কোটের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে আছেন। এ কারণে এই প্রতীকটিও আজ তোপের মুখে।
গত ক’দিন ধরে দেশের রাজনীতিতে হঠাৎ আগত জয়কে নিয়ে তুলকালাম প্রচার চলছে। এটা মানতেই হবে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার স্বার্থে নতুন মুখের আগমন জরুরি। প্রবাসের বাঙ্গালিরা বিশেষত গণতন্ত্রে অভ্যস্ত বাংলাদেশিরা পরিবর্তনের জন্য মরিয়া হয়ে আছেন। যে নেতৃত্ব বাংলাদেশকে হানাহানি মারামারি বাদ দিয়ে নতুন পথ দেখাবে, সে পথের দিশা আসবে তারুণ্যের হাত ধরেই। আমরা যারা বয়সী বা মধ্য বয়সী তাদের জীবনে রাজনীতি মানেই ভেদাভেদ। যে কোনো কারণে আমরা মানুষ বা বাঙ্গালি হবার পরিবর্তে প্রথমে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি। এই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির জন্য জয়ের মত সুশিক্ষিত মার্জিত সুদর্শন যুবকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু ঢুকতে না ঢুকতেই যে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট আর মুজিব কোট চাপানোর হিড়িক, তা আমাকে নীরদ সি`র কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
নীরদ বাবু বিলেতে স্বদেশী পোশাক পরিধান করে অন্তরে দেশপ্রেমের বহ্নিশিখা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে আমরা সব সময় স্যুট-কোট পরা দেখেছি। এতে আপত্তির কোনো কারেণ থাকা উচিৎ নয় বা নেইও। কিন্তু দেশে এসে আওয়ামী লিগের হাল ধরার আগেই মুজিব কোট চাপানোর প্রয়োজন কোথায়? সে পোশাক বা প্রতীক ধারণ করার আগে কি আদর্শ ও নিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হবে না? এখন কেউ যদি বলেন রক্তের উত্তরাধিকার মানেই আদর্শ ও মেধার ট্রান্সফার নিশ্চিত, তা হলে বলার কিছু নেই। শুধু বুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির পর ছেলে রাহুলকে পিতার কাছে পাঠিয়েছিলেন তার মা। যেন পিতার অর্জন থেকে কিছুটা সে ভাগ নিতে পারে। বুদ্ধ তাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ছুঁয়ে দিলে বা আশির্বাদ করলেই কোনো অর্জন হস্তান্তরিত হয় না। এমনকি রক্তের ধারায়ও নয়। এটা একান্তই সাধনা ও অর্জনের ব্যাপার।
ফলে মুজিব কোট ও তর্জনী উঁচিয়ে বক্তৃতার পাশাপাশি রাজনীতি অর্জনেরও বিষয় বটে। সে কঠিন সাধনায় গত বার ফেল মারা তারেক রহমানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জয়ের আর্বিভাব সময়োপযোগী হলেও সামনের সময় ফুলবিছানো কিছু নয়। গত নভেম্বরে ঢাকায় এক সম্পাদকের সাথে ভ্রমণকালে তিনি আমাকে বলেছিলেন, তারেক খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এমনও আশংকা তার, তারেক ফিরে এলে রাজনীতি বিএনপির প্রতি সুপ্রসন্ন হবার সম্ভাবনাও প্রবল। বলা বাহুল্য, তখন হেফাজত হয় নি, জামাতের তান্ডব দেখা যায় নি। আজ তো পরিস্হিতি আরো প্রতিকূল। এই সময়ে জয়-ম্যাজিক কতটা কাজ করবে বলা মুশকিল।
তার সামনে কঠিন যত কাজম যদি তিনি হাল ধরতে চান তবে কোট আর তর্জনীর সাথে বাংলার জনগণ, বাংলার জনগণের আবেগ অনুভূতিকেও বুঝতে হবে।
তারেক নেতিবাচক রাজনীতির বরপুত্র। ধর্মান্ধ রাজনীতি আর বিএনপির মুসলিম লীগ মার্কা নীতির কারনে অন্ধ, লেখাপড়া না জানা ভোটাররা ভোট দেবেনই। এরা একাট্টা আর সংঘবদ্ধ। অন্যদিকে জয়ের রাজনীতির মানুষজনের প্রব্লেম হলো, তারা সব কিছু দু’লাইন বেশি বোঝেন। হেফাজত বা জামায়াতের মত জান দিতে রাজি না থাকলেও যুক্তিতর্কে পণ্ডিত। সময় বুঝে শাহবাগে আসবেন আবার সময় বুঝে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবেন। এদের সাথে নিয়ে এগুনো মানে মধ্যবিত্ত মানসিকতা আর মধ্যপন্হী জনগণকে নিয়ে রাজনীতির দায়িত্ব নেয়া।
শুধু মুজিব কোট পরিধানে কেউ বঙ্গবন্ধু হয় না। এই আপ্তবাক্যটি জয়ের কানে ঢোকালে আখেরে তার ও দলেরই লাভ। না হলে আখেরে কি হতে পারে সেটা ভাবতেও ভয় হয়।
সিডনি;
৩/৮/১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর