সালটা সম্ভবতঃ ২০০১। কলেজে পড়ি।
কাজ তো তেমন ছিলো না। আর ইন্টারনেটের যে স্পীড ছিলো, তাতে কয়েকটা পেজ ঘুরতেই সময় শেষের ঘণ্টা বেজে যেতো। এমনই এক কলেজ পালানোর দিনে ইয়াহু চ্যাটে কথা হচ্ছিলো ইসলামাবাদের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীর সঙ্গে।
রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝার মতো বুদ্ধি মাথায় তখনও ঢোকে নি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কি জিনিস, এর ইতিহাসটা তো জানাই ছিলো। তাই একথা ওকথার পর জিজ্ঞেস করে বসলাম, ১৯৭১ সালে তোমাদের পাকসেনারা যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারলো, মা-বোনদের ধর্ষণ করলো, এ বিষয়ে তোমার মন্তব্য কি?
উত্তর যা এলো, তা ছিলো আমার ধারণারও বাইরে।
এক যুগ আগের কথা হলেও পরিষ্কার মনে আছে, মেয়েটি বলেছিলো- তোমরা যা করেছো, তাতে এই শাস্তি তোমাদের প্রাপ্য।
কি এমন অপরাধ করেছিলাম আমরা?
ইসলামের সঙ্গে বেঈমানি করে পাকিস্তান ভেঙেছো।
একটা মেয়ে কিভাবে অন্য মেয়েকে ধর্ষণের ঘটনাকে সমর্থন করতে পারে, তা আমার মাথায় তখনও ঢোকেনি।
‘ধন্যবাদ, তোমার ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটলে বুঝতে’- বলে ক্যাফে থেকে বের হয়ে এসেছিলাম।
তবে পরে অন্য অনেক পাকিস্তানি নাগরিকের সঙ্গে কথা বলে এবং দ্রুতগামী, আধুনিক ইন্টারনেটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে অনেক কিছুই নিজের কাছে পরিষ্কার করতে পেরেছিলাম।
বাংলাদেশে যে ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু করে নয় মাস এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলেছে, এটাও অনেক পাকিস্তানি নাগরিক এখনও জানেন না, জানলেও বিশ্বাস করতে চান না।
তবে এই অবস্থা ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, অনেকেই বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়ার পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন।
এর সর্বশেষ সংযোজন বোধ করি পাকিস্তানি সাংবাদিক ওয়াসির মীরের ছেলে আরেক প্রখ্যাত সাংবাদিক হামিদ মীর, কবি ফাইজ আহমেদের মেয়ে সালিমা হাশমি ও পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট মালিক গোলাম জিলানীর মেয়ে প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীর।
এরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু হিসেবে অবদান রাখায় যার যার বাবার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা নিতে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাতকারে তারা বলেছেন- পাকিস্তানের উচিত গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া।
সম্প্রতি জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক হামিদ মীর অবশ্য নিজের ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু’র সন্তান সম্মানকে অবমাননা করেছেন দৈনিক জং পত্রিকায় একটি লেখায় গোলাম আযমকে পাকিস্তানের বীর বলে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এই আসামির সঙ্গে ‘অন্যায়’ করা হয়েছে এবং এই ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের কিছু না করা’র সমালোচনাও করেছেন তিনি।
এমনকি গোলাম আযমকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো উচিত বলেও মন্তব্য করেন হামিদ মীর।
এদিকে পাকিস্তান সরকার কি করছে? তারা কি তাদের অবস্থান থেকে সরে এসেছে? তারা কি অতীত ঘটনাকে ভুল বলে স্বীকার করে? যে ভুলের কারণে লক্ষ মানুষ মারা গেছে, মা-বোন হারিয়েছে সম্মান, সেই ভুলের ক্ষমা চাইতে মানসিকভাবে প্রস্তুত তারা?
মনে হয় না।
১৯৭১ ও এর আগের কথা বাদই দিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও পাকিস্তানের নেতাদের ধারণা ছিলো, বাংলাদেশ বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। তাই স্বীকৃতি দেওয়া তো দূরের কথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং সৌদি আরবসহ আরো কিছু শক্তিধর বন্ধু রাষ্ট্রকে নিয়ে কিভাবে নবজাতক রাষ্ট্রটিকে পদে পদে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া যায়, সে চেষ্টায় নিশিদিন ব্যস্ত ছিলেন তারা।
কমনওয়েলথ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে সদস্যপদ দিলে তার প্রতিবাদে নিজের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে পাকিস্তান। কমনওয়েলথের বৈঠকে পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার আহবান ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানায় বাংলাদেশ।
ওই বছরই বাংলাদেশ জাতিসংঘে সদস্য পদের আবেদন করলে পাকিস্তানের অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাতে ভেটো দেয়।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হলে পাকিস্তান ২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
ওই বছরেরই জুনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার অন্যতম কারিগর জুলফিকার আলী ভুট্টো আসেন বাংলাদেশ সফরে। সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিতেও যান তিনি। কিন্তু ’৭১ নিয়ে ভুল স্বীকার বা ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, এ নিয়ে কোন বক্তব্যই ছিলো না তার।
এরপর ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক এবং ২০০২ সালে আরেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফও আসেন বাংলাদেশে। তারাও যথারীতি ফুল দেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে। এবার পাওয়া যায় বক্তব্য। তারা বলেন, “তোমাদের বীরেরা আমাদেরও বীর”, এবং “পাকিস্তানের জনগণও ’৭১-এর ঘটনায় সমব্যথী”।
কিন্তু এসব উক্তিকে স্রেফ ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর মতো রাজনৈতিক স্টান্টবাজি বলেই ধরে নিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ।
আবার ফিরে আসি হামিদ মীরের কথায়। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) ২০১২ সালের ডিসেম্বরে তার একটি ই-মেইল সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে।
ওই সাক্ষাৎকারে হামিদ মীর বলেন, পাকিস্তানের কমপক্ষে ১২ জন সংসদ সদস্য আমাকে নিশ্চিত করেছেন যে, বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাবটি তারা সংসদে তুলবেন।
খানিকটা আশার আলো তো জেগেছিলো বটেই।
কিন্তু আবার সেই ভুল ভাঙালেন হামিদ মীরই। ২৬ জুলাই পাকিস্তানের দৈনিক জং পত্রিকায় এক লেখায় তিনি গণমাধ্যমে অপ্রকাশিত এক তথ্য দেন।
তার তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-এর মাঝামাঝি সংসদের এক অধিবেশনে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেন, পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেছেন গোলাম আযম। সুতরাং পাকিস্তান সরকারের উচিত তার সঙ্গে করা অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ জানানো।
অথচ যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গী -‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’- বলেই আমরা জানতাম।
একই সময়ে আমরা গোলাম আযমের রায়ের প্রতিবাদে পাকিস্তান জামায়াতের বিক্ষোভ মিছিলের খবরও পাই। শুধু তাই নয়। ‘রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ’- হাইকোর্টের এমন রায়ের পর এর প্রতিবাদে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ আহবানের দুঃসাহসও দেখিয়েছে।
গণহত্যার মতো ঐতিহাসিক পাপ, এর যথাযথ ক্ষতিপূরণ আর ’৭১ সালে ভাগ না হওয়া সম্পদের হিসাব বুঝিয়ে দেওয়া, পাকিস্তান যে এতো ক্ষতি স্বীকারের জন্য প্রস্তুত নয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনায়।
গত বছর ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ইসলামাবাদে একটি সম্মেলনে দাওয়াত দিতে ঢাকা আসেন পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানী খার।
তার এই ছয় ঘণ্টার সফরে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমণির সঙ্গে দেখা করতে গেলে উঠে আসে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গ।
উত্তরে হিনা রব্বানী বলেন, আমাদের উচিত অতীত ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
১৯৪৫ সালে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আনবিক বোমা মারার ৫৪ বছর পর জাপানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাপানও ১৯৫০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৬০ বছর ধরে বার্মা, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, চীনসহ অনেক দেশের কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে বেশক’টি চিঠি পাঠিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসি নির্যাতন ক্যাম্পে ৮০ হাজার ফরাসি ইহুদিকে বিতাড়ন কাজে স্বীয় ভূমিকা স্বীকার করতে এবং এর জন্য ক্ষমা চাইতে ফরাসি সরকারের ৫০ বছর সময় লেগেছিল। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার তাদের যেসব রীতি যা বহু যুগ আগে সেখানকার আদিবাসীদের নিদারুণ দুর্দশা, দুঃখভোগ ও ক্ষতির কারণ হয়েছে, তার জন্য ক্ষমা চেয়েছে।
১৯৭১ সালের পর ৪২ বছর পার হয়ে গেছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হলে এখন সময় এসেছে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত এই জঘন্য অপরাধের সুরাহা হওয়ার। এতো বড় ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে ‘কিছুই হয় নি’ মনোভাব নিয়ে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা কোন দেশের জন্যই ভালো ফল বয়ে আনবে না।
পাকিস্তানকে এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়ে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ অবশ্যই দিতে হবে।
বাংলাদেশকেও অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা দাবি করার ভদ্রতা ছেড়ে আন্তর্জাতিক মহলে এ নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বলিদান এবং মা-বোনের সম্ভ্রম, সব অতীত কি এতো সহজে ভোলা যায়?
অনুপম দেব কানুনজ্ঞ: ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন, anupamdkan@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১৩
জেডএম/