ঢাকা: জাতীয়তাবাদ এমন একটি বিষয় যা আপনি শুধু জন্মসূত্রে অর্জন করতে পারবেন না। এই কনসেপ্টটি মূলত নির্ভর করে আপনি নিজে কোন বিষয়টি ধারণ করছেন তার উপর।
সাধারণত জাতীয়তাবাদের কনসেপ্টটি নির্ভর করে একই রকম কিছু ধারণা ও বিশ্বাসের উপর।
যেমন ধরুন একই ভাষায় কথা বলা, খাদ্যাভ্যাস কাছাকাছি হওয়া, জাতীয় প্রতীক, সংস্কৃতি এবং সর্বপরি আপনার জাতীয় জীবনের যে ইতিহাস সেটি একই হতে হবে। অর্থাৎ যাদের ভাষা, খাওয়া, সংস্কৃতির পাশাপাশি দীর্ঘদিনের ইতিহাসও একই রকম বা একই ইতিহাস সবাই ভাগাভাগি করে তাদেরকে সাধারণত আমরা একই জাতীয়তাবাদে পরিচিত হতে দেখি।
আমাদের বাঙালি জাতীয়বাদের ধারণাটি মূলত উঠে এসেছে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মাধ্যমে। অনেকের মতে, এটি উনিশ শতকে শুরু হলেও এই জাতীয়তাবাদের ধারণাটি শক্ত একটি ভিত্তির উপর এসে দাঁড়ায় বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের সময়।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আমাদের উপর অন্য একটি ভাষা চাপিয়ে দিতে চাচ্ছিল, আর তখনই এদেশের আপামর জনগণ ওই ভিন্ন ভাষা আর সংস্কৃতি মেনে না নিয়ে নিজস্ব জাতিস্বত্তা ও জাতীয়তাবাদে বলীয়ান হয়ে একে প্রতিহত করে। এটি পূর্ণতা পায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। আর এই ইতিহাস যারা ধারণ ও বিশ্বাস করেন তারাই বাঙালি হিসেবে পরিচিত।
অর্থাৎ ভাষার পাশাপাশি সংস্কৃতি ও ইতিহাস একটি বড় নিয়ামক হিসেবে চলে আসে যখন আমরা জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা করি।
এখন ধরুন, কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী যদি আমাদের যে ইতিহাস রয়েছে (ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধের হতে পারে কিংবা অন্য যে কোনো ইতিহাস যেটি সর্বজন স্বীকৃত) সেটিকে বিশ্বাস না করে কিংবা মনে ধারণ না করে তাহলে কি তাকে বা তাদের বাঙালি বলা যাবে?
জাতীয়তাবাদের যে কনসেপ্ট আমরা এতক্ষণ দেখলাম, যেখানে বলা হচ্ছে- ভাষা, সংস্কৃতি ও একই ইতিহাস ধারণ থেকেই মূলত জাতীয়তাবাদের বিষয়টি চলে আসে। এ ক্ষেত্রে এলে অন্তত ইতিহাস বিশ্বাস বা ধারণ করার দিক থেকে এরা কিন্তু বিচ্যুত হয়ে গেলো।
এবার আসা যাক সংস্কৃতির ধারণায়। এ দেশের গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ বাংলা নববর্ষে বিশ্বাস করে, পহেলা বৈশাখে বিশ্বাস করে। আর এ উপলক্ষে যেসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা হালখাতা হয় তার সব কিছুই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য। যুগ যুগ ধরে আমাদের বাপ-দাদারা এসব পালন করে আসছেন। এখন কেউ যদি এই সংস্কৃতি বিশ্বাস বা ধারণ না করে এর বিরোধিতা করে তাহলে তাদেরকে কি আমরা বাঙালি বলবো?
সংস্কৃতির বিষয়ে অবশ্য ইদানিং অনেকেই অনেক কথা বলছেন। কিউ বলছেন- পোশাকের বিষয়ে, কেউবা আবার গান-বাজনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কোন পোশাকটি বা গানটি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হবে, কোনটি নয় এই নিয়ে তুমুল বিতর্ক হচ্ছে।
এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, পোশাক বা গান অথবা সংস্কৃতির অনেক বিষয়ই রয়েছে যেগুলো বহমান। সব সময় একই রকম থাকবে তা কিন্তু নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনি আপনার শিকড় বা আদি যে সংস্কৃতি রয়েছে, যেটি হয়তো কালের প্রবাহে পরিবর্তিত হয়েছে বা হচ্ছে সেটিকে বিশ্বাস বা ধারণ করেন কি না।
অর্থাৎ পালন করতেই হবে তা কিন্তু নয়, কিন্তু সেটিকে বিশ্বাস করেন কি না বা এর বিরোধিতা করেন কি না সেটি হচ্ছে জরুরি। ধরুণ আপনি পেশাগত কিংবা পড়াশুনার জন্য দেশের বাইরে গেলেন, যে দেশে হয়তো লুঙ্গি বা শাড়ি পোশাক হিসেবে সেই অর্থে মানানসই নয়।
ধরে নিচ্ছি এই দুই পোশাকে আমরা বেশি অভ্যস্ত। এমন নয় যে লুঙ্গি-শাড়ি পরলেই বাঙালি হওয়া যাবে, সে ক্ষেত্রে তো অনেক বিদেশিই বাঙালি হয়ে যেতো, কিংবা অনেক বাঙালি ভিনদেশি হয়ে যেতো।
যা হোক হয়তো চাইলে আপনি অন্য দেশে আপনারই দেশের পোশাক পরতে পারেন। কিন্তু যেহেতু মানানসই নয় তাই হয়তো আপনি অন্য কোন পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। তাতে কি আপনার বাঙালিত্ব চলে যাবে? অবশই না। এটি হচ্ছে আপনার বিশ্বাস।
ধরুন এখন যদি আপনি বলে বসেন- শাড়ি-লুঙ্গি বাঙালির পোশাক না। কিংবা ধরে নিলাম ভবিষ্যতে কোন এক সময় শাড়ি-লুঙ্গি হয়তো আমরা আর সেভাবে পরবো না। তাই বলে আপনি যদি বলে বসেন- শাড়ি-লুঙ্গি কখনো আমাদের পোশাক ছিল না, তখনই আসলে আপনার বিশ্বাস ও আপনি কি ধারণ করেন সে জায়গাটিতে প্রশ্ন চলে আসে।
জাতীয়তাবাদের যে ধারণা, সেটি নিয়ে হয়তো অনেক আলোচনা সমালোচনা হতে পারে। তবে শুধু একই ভাষায় কথা বললে কিন্তু একই জাতীয়তাবাদ সবাই ধারণ করবে তা নয়।
ধরুন ল্যাটিন অ্যামেরিকার অনেক দেশের মানুষ স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে কিংবা আফ্রিকার অনেক মানুষ ফ্রেঞ্চ ভাষায় কথা বলে, তাই বলে তো তারা ফ্রেঞ্চ বা স্প্যানিশ হয়ে যাচ্ছে না। তাদের নিজস্ব জাতীয়তাবাদ রয়েছে। একই ভাষার পাশাপাশি তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাস রয়েছে যেটি তারা বিশ্বাস ও ধারণ করে, আর এর ভিত্তিতেই তাদের নিজস্ব জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে।
আমিনুল ইসলাম: শিক্ষক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, tutul_ruk@yahoo.com, aminulislam80@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৩
জেড্এম/জিসিপি