কি ভয়ংকর ঘটনা! জন্মাদাতা পিতামাতাকে হত্যা! জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল যারা, তাদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া! এ কোন ঝড়ের পূর্বাভাস? এ কোন রাষ্ট্র ও সমাজে আমরা বাস করছি? যেখানে সন্তান তার প্রিয় মা-বাবাকে শেষ পর্যন্ত হত্যা করল? তাও আবার কিশোরীকন্যা!
যদিও প্রচণ্ড ঘৃণা ঐ কিশোরিটির প্রতি তথাপি আরো বেশি ধিক্কার জানাই এই দেশ ও সমাজকে। যারা এরকম জঘন্য মনোবিকার সৃষ্টি করেছে ঐশী নামের ইয়াবা সেবনকারী কিশোরীর স্নায়ুতে।
আমার তো এখানেই প্রশ্ন কেন সে অনিয়ন্ত্রিত কিশোরীতে পরিণত হল? কে বা কারা তার পবিত্র মনটিকে তছনছ করে পাষণ্ড খুনিতে পরিণত করল? এর জন্য কি আমাদের ভোগবাদী সমাজ আর বিকৃত রুচির পরিবার তথা রাষ্ট্র দায়ী নয়?
বেশ কিছুদিন যাবৎ আমাদের দেশে অনিয়ন্ত্রিত পরিবারের সন্তানদের কাছে ইয়াবা হচ্ছে উপভোগের অন্যতম মাধ্যম। অসদুপায়ে অর্জিত টাকা কোথায় স্ত্রী সন্তান তথা তার অধীনস্থরা ব্যয় করছে তা জানার কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না পরিবারের কর্তা। নামেই পরিবারের কর্তা, তারা শুধু জানে কীভাবে সমাজে উপরে উঠতে হয়। অর্থের পেছনে পাগলের মতো ছুটছে। আর তাদের পরিজনরা সেই অর্থের অপব্যবহার করছে। শুধু তাই নয় আকাশ সংস্কৃতির এই মহাপতনের যুগে ঘরে ঘরে মোবাইলে ইন্টারনেটের বদৌলতে ছেলে মেয়ে কি দেখছে অভিভাবকরা মোটেই দেখেন না। আদৌ কি ইন্টারনেট থেকে কিছু শিখছে? নাকি অশ্লীল দৃশ্য বহন করা অসংখ্য ওয়েবসাইটে ঢুকে আছে সারাদিন।
কিশোর জীবন - কি অসম্ভব সুন্দর একটা সময়। এই কিশোরকালের স্বপ্নই তো পুরো জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ আমাদের এই কিশোর সমাজ তা হয়তো জানে না। যে কিশোর কবিতা পড়বে, যে কিশোর গল্প লিখবে, ছবি আঁকবে, মাকে গৃহস্থালীর কাজে সাহায্য করবে, যে কিশোর মা বাবাকে সাথে নিয়ে সুস্থ বিনোদন চর্চা করবে সে কিশোর কেন এমন অপরাধে জড়াবে? সে কি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতে শেখেনি? হয়তো শেখেনি তাই তো তাদের আনন্দ ফুর্তি করার জন্য ইয়াবা সেবন করতে হচ্ছে।
আমরা যারা এই কিশোরদের মা-বাবা তাদের মধ্যে অনেকেই একটা বয়স পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদের নিয়ে খুব বেশি সচেতন থাকি অথচ যখন সচেতন থাকার প্রয়োজন তখন একেবারেই অসচেতন হয়ে পড়ি। কার সাথে বন্ধুত্ব করছে, কোথায় যায়? কি করে এসব নিয়ে ভাবি না। যার ফলে ছেলেমেয়েরা এই সুযোগ পুরোপুরি আদায় করে নিচ্ছে। যেহেতু আমরা নিজেরাই মূল্যবোধ নৈতিকতা, মানবিকতা বিবর্জিত তাই সন্তানদের শাসন করার ক্ষমতা বহু আগেই হারিয়ে ফেলি।
আমাদের ছেলেবেলায় আমরা দেখতাম বাড়ির অভিভাবক যিনি তার অনুমতি ছাড়া বাড়ির ছেলেমেয়েরা কোথাও যেতে পারতো না, সন্ধ্যোর পর বাড়ির ছেলে বাইরে থাকবে এটা কল্পনা করাটাও রীতিমত অপরাধ বলে বিবেচিত হতো। একটা টাকা খরচ করতে হলেও বাড়ির কর্তার অনুমতি বা মতামত প্রয়োজন হতো। একটা খাত থেকেই সব খরচ করা হতো। আলাদা আলাদাভাবে বাড়ির সকল সদস্যের হাতে টাকা থাকতো না।
ব্যতিক্রম কিছু ঘটনা ঘটতো না তেমনটা নয়। তবে সেটা ব্যতিক্রম। কালক্রমে সব রীতিনীতি পাল্টে গেল। আমরা এখন সবাই ‘স্বাধীন’। কোনো কিছুতে কারো কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
তাছাড়া অতি আধুনিক মা বাবার মধ্যে মতের অমিল, বিবাহ বিচ্ছেদ, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক সকল কিছুই সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যত গঠনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এগুলো নিয়ে কে ভাববে?
আমার একটা বিশ্বাস ছিল প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গে ভোগের যে কোনো সম্পর্ক নেই, তা এই সমাজকে একদিন বুঝিয়ে দেবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। অথচ তা কি কোনদিন সম্ভব হবে? আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি পারবে নষ্ট হয়ে যাওয়া রাষ্ট্র, নষ্ট হয়ে যাওয়া পরিবার তথা সমাজকে পুনর্নির্মাণ করতে?
লতিফা নিলুফার পাপড়ি: কলাম লেখক, কবি, গল্পকার, শিক্ষক। ই-মেইল: lnpapri@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২০০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১৩
আরআর/জিসিপি