সেদিন ২১ আগস্ট ২০০৪। শনিবার।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হাজারো মানুষের সমাবেশে নেতা-কর্মী সাধারণ মানুষ এসেছেন সারাদেশে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নিতে।
বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে শেখ হাসিনা। পাশে দাঁড়িয়ে জাতীয় নেতারা। নেত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার পরই শুরু হবে গণমিছিল।
কিন্তু মিছিল আর হলো না। আচমকা ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেলো আকাশ। শরতের বিকেল গ্রেনেড হামলায় প্রকম্পিত হয়ে গেল।
শেখ হাসিনা তার বক্তব্য শেষ করে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই যে ট্রাকটিতে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন সেটি লক্ষ্য করে শুরু হলো একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষেপ। চারদিকে ছোটাছুটি, প্রাণভয়ে মানুষজন দিদ্বিদিক দৌড়াচ্ছেন। গ্রেনেডের বিকট আওয়াজ আর বিস্ফোরণের কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে আকাশ।
আক্রান্ত মানুষের আর্তচিৎকার। থোকা থোকা রক্তস্নাত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ যেন মৃত্যুপুরী। মরণের নৃত্য যেন নেমেছিলো আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে। গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েও জাতীয় নেতারা মানববর্ম তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেন।
কিন্তু ট্রাকের আশপাশে গ্রেনেড হামলায় মুহূর্তেই আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়েন আইভী রহমানসহ বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী। একের পর এক জীবিত মানুষ লুটিয়ে পড়লো মৃত্যুর কোলে। আহতদের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠলো আকাশ-বাতাস। গ্রেনেডের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো শরীরের টুকরা। নিহতদের অধিকাংশের শরীরের নানা অঙ্গ বিছিন্ন হয়ে গেলো। আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমানের একটি পা উড়ে গেলো। এভাবেই পরিকল্পিতভাবে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালানো হলো।
নিষ্ঠুর আক্রমণে শহীদ হলেন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভী রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী। আহত হলেন অগণিত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষ। আহতদের অনেকেই আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে আজো মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
এ হামলার কারণেই পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। এখনও দলের কয়েকজন সিনিয়ন নেতা দেহের ভেতর স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন।
নিশ্চিতভাবেই একুশে আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিলেন জাতির পিতার কন্যা, গণমানুষের নেত্রী, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সেদিনের বিরোধীদলীয় নেত্রী, আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর উদ্দেশ্য ছিলো আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়া।
এদেশে আওয়ামী লীগ যারা করেন তাদের কাছে এই বার্তা পৌছে দেওয়া যে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী-সমর্থকদের সবার এই একই পরিণতি।
একুশে আগস্ট একটার পর একটা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়, সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হলে তার গাড়ি লক্ষ্য করে চালানো হয় গুলি। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স কর্পোরাল মাহবুব নিজের জীবনের বিনিময়ে তাকে রক্ষা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করলেও সেদিন দেশের বাইরে থাকার কারণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৫ আগস্ট যারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি সেই পরাজিত শক্তিই শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এ পর্যন্ত ১৯ বার হামলা চালায়।
গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা বিশ্ব নেতাদের উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করে। তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
হামলার জন্য দায়ী ক্ষমতাবানদের রক্ষার জন্য নোয়াখালীর অজ পাড়াগাঁয়ের নিরীহ গরীব জজ মিয়াকে জড়িয়ে নাটক সাজানো হয়।
কিন্তু সত্য কখনো চাপা থাকে না। সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার জোট সরকার ধামাচাপা দিতে চাইলেও নিরপেক্ষ তদন্তের চার্জশীটে বেরিয়ে এসেছে মূল পরিকল্পনার কথা। বেরিয়ে এসেছে কারা গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা দু’টি মামলারই বিচার কাজ চলছে। মামলায় সাক্ষী ৪৯১ জন। গ্রেনেড হামলা মামলায় চার্জশিটভুক্ত ৫২ আসামির মধ্যে বর্তমানে ৩২ জন কারাগারে আছেন। আর ১৯ জন পলাতক রয়েছে এবং এ পলাতক আসামিদের অধিকাংশই বিদেশে অবস্থান করছে। আমরা চাই পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হোক।
রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করছে, অচিরেই এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হবে। আমরাও একই প্রত্যাশা করি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রকৃত অপরাধী এবং হুকুমের আসামিদের যথোপযুক্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
এই নির্মম ভয়াবহ বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত হলে মানুষ আস্থা ফিরে পাবে। আর প্রমাণ হবে- অপরাধী সে যত বড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন, শাস্তি সে পাবেই।
আশরাফ সিদ্দিকী বিটু: পরিচালক, সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন(সিআরআই), রাজনৈতিক কর্মী
বাংলাদেশ সময়: ১৪১২ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি