কেরানি শব্দটির সঠিক ইংরেজি প্রতিশব্দ কী? who queen? গুগল ডিকশনারিকে জিজ্ঞেস করলাম- কেরানির ইংরেজি প্রতিশব্দ কী। ‘গুগল’ দু-চার সেকেন্ড ভেবে জবাব দিল- রাইটার।
ক্লার্ক শব্দটির সঙ্গে পরিচয় ছিল। ভয়েল সাহেবের ‘আর্লি ইউরোপিয়ান’ বইতে ক্লার্ক শব্দটির প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ‘ক্রানি’। ক্রানিই হালের কেরানি। কিন্তু রাইটার মানে যে কেরানি, তা জানতাম না। লেখালেখি একটি সৃজনশীল কাজ। কেরানিগিরি একঘেয়ে। সৃজনশীলতা নেই। ব্রিটিশ আমলে ফটোকপি মেশিন না থাকার যুগে কেরানিরা দলিল-দস্তাবেজ দেখে দেখে হুবহু কপি করতেন বলে বোধ হয় এর ইংরেজি প্রতিশব্দে রাইটার শব্দটি ঢুকে গেছে।
এক কেরানি হুবহু কপি করতে বসে বিপদে পড়েছিলেন, একটি শব্দের ওপর মাছি মরে লেপ্টে গিয়েছিল। তিনি কিছুতেই শব্দটি বুঝতে পারছিলেন না। শেষতক বুদ্ধি খাটিয়ে বের করলেন, একটি মাছি মেরে কপিতে লেপ্টে দেবেন। তিন দিন ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে তিনি একটি মাছি মারলেন এবং সেটি জায়গামতো লেপ্টে দিলেন। একেবারে হুবহু কপি যাকে বলে!
কথিত আছে- এ থেকেই বাংলায় ‘মাছি মারা কেরানি’ প্রবাদটির সৃষ্টি। কৃশানু ভট্টাচার্যের একটি লেখা হাতে পেলাম। তাতে দেখলাম কেরানি নিয়ে ব্রিটিশ আমলে জরিপও হয়েছে! স্বয়ং হান্টার সাহেব এই কাজটি করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে ১৮৭০ সালে কেরানির সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৪৭ জন। ১৮৮১ সালে তা পৌঁছায় ১৬ হাজার ৩১৫-তে। তারও ১০ বছর বাদে ১৮ হাজার ৯৫০-এ। এভাবে উত্তরোত্তর কেরানির সংখ্যা বৃদ্ধিই বোধ হয় বাঙালির কেরানি মানসিকতার বদনাম তৈরি করেছিল। হান্টার সাহেব কেরানি গণনা করেছেন, অন্যদিকে হেস্টিংস সাহেব কেরানি সংগ্রহের জন্য রীতিমতো স্কুল খুলে বসেছিলেন।
চট্টগ্রামের সন্দীপে কার্গিল হাই স্কুল নামে যে স্কুলটি আছে, তা খোলা হয়েছিল কেরানী সংগ্রহের জন্য। হান্টার সাহেব ‘আওয়ার ইন্ডিয়ান মুসলিম’ বইতে এ তথ্য উল্লেখ করলেও এ স্কুল থেকে আসলে কতজন কেরানি হতে পেরেছেন, তা উল্লেখ করেন নি।
যত দূর জানা যায়, তখন সন্দ্বীপের মানুষ ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভালো চোখে দেখত না। মোল্লা-মৌলভিরা স্কুলকে বলতেন ‘পিছ কুল’।
কেরানি থেকে বিখ্যাত হওয়ার নজিরও বাঙালির রয়েছে। বাঙালি গণিতবিদ রামানুজান এখনও বিশ্বের বিস্ময়! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশও একসময় কেরানি ছিলেন। বাংলাদেশে বাংলা সংবাদপত্রের অন্যতম প্রবাদপুরুষ তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াও ছিলেন কেরানি। তিনি বরিশালে কালেক্টরেট অফিসের কেরানি ছিলেন।
উদাহরণ যতই মধুর হোক না কেন, কেরানি শব্দটি আমাদের কাছে তুচ্ছ বিষয়ের প্রতীক। কেরানি মানে অধীনস্থ, পরাধীন, চিন্তাহীন একজন মানুষ। তার কোনো অধিকার থাকবে না মতামত দেওয়ার। বোধ থাকবে না। সে শুধুই অপরের আজ্ঞাবহ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি আমেরিকার রাষ্ট্রদূতকে বলতেন আমেরিকার কেরানি। তিনি বলতেন, কেরানির সঙ্গে কিসের আলোচনা! তাকে একবার আলোচনার জন্য ডাকাও হয়েছিল। কিন্তু আলোচনায় বসতে অস্বীকার করেন তিনি।
আমাদের দেশি বিষয়ে আমেরিকার কেরানির কী মত থাকতে পারে, এ নিয়ে তিনি দ্বিধায় ছিলেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের ব্যাপারে কেরানির মত নেওয়ার কথা শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিকের সাহসী উচ্চারণ।
গত কিছু দিন ধরে খবরে দেখছি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আমেরিকার রাষ্ট্রদূতকে বেশ তোয়াজ করছে। খালেদা জিয়া ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘণ্টাব্যাপী আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার ভবিষ্যত সরকার কেমন হবে রুপরেখা পেশ করলেন মজিনা বরাবরে (খবর- মানবজমিন, ১৩/০৮/১৩)। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, একটি স্বাধীন দেশের নেত্রী তার জনগণের কাছে ভবিষ্যত সরকারের রুপরেখা প্রকাশ না করে কেন আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রকাশ করবে? প্রকাশ করবে, কারণ তাদের ধারণা আমেরিকার দূতরাই তাদের ভাগ্য বিধাতা। বিএনপি কেন আওয়ামী লীগ কম কোথায়? খালেদার বৈঠকের সপ্তাহ না ঘুরতেই শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারেক আহমদ সিদ্দিকী বৈঠক করেছেন মজীনার সঙ্গে। খালেদা করেছেন এক ঘণ্টা, পুতুল করেছেন সাড়ে তিন ঘণ্টা। কেউ কারো ছাড়ি নাহি কম যায়। তাদের মুখে না বললেও অন্তরে ঠিকই বিশ্বাস করেন নির্বাচনে জয় লাভের জন্য জনগণ নয়, আমেরিকার দয়া জরুরি। নির্বাচন যতই আসন্ন, ততই পীর-মুর্শিদ আর আমেরিকার ওপর তাদের আস্থা বেড়ে যায়। মজীনার কদরও বাড়ছে। আমাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, তিনিই আমাদের ভাগ্য গড়বেন। তিনি পরবর্তী রানী নির্বাচন করবেন। তিনিই বলে দেবেন- হু কুইন?
মনোয়ার রুবেল: ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট, monowarrubel@yahoo.com
জেডএম/জিসিপি