শেষ হয়ে আসছে বর্তমান সরকারের মেয়াদ। সংবিধান অনুযায়ী, অক্টোবর মাসেই বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে।
গতবারের মত এবারও ভোটার তালিকায় যোগ হয়েছে অনেক নতুন ভোটার। তাই কে হবেন নতুন সরকার প্রধান, কোন দল ক্ষমতায় আসলে দেশের ও জনগণের মঙ্গল হবে, কোন দলকে ভোট দেয়া উচিৎ সর্বোপরি নতুন সরকারের কাছে জনগণ কি প্রত্যাশা করে এইসব নানামুখী প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আটর্স বাংলাদেশ এর মিডিয়া স্ট্যাডিজ এ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের একদল শিক্ষার্থী রাজধানীতে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের সাথে কথা বলেছিল। এই গবেষণায় অংশ নেয় চারজন রিক্সাচালক, চারজন চাকুরীজীবী এবং চারজন চাকুরীজীবী।
জরিপে দেখা গেছে, ৪২ ভাগ মানুষ দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত অপরাধ ও দুনীর্তি যা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে এসেছে সেগুলো নিয়ে চিন্তিত। বর্তমান সরকারের সাড়ে চার বছরে সবচেয়ে আলোচিত দুর্নীতিগুলো ছিল শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, পদ্মাসেতু ঋণ কেলেংকারী, হলমার্ক কেলেংকারী, সাবেক রেলপথমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ। জরীপে সাধারণ মানুষ এইসব দুর্নীতির উদাহরণ টেনে এনেছে এবং দীর্ঘ সময় পরও এই দুর্নীতির গুলোর বিরুদ্ধে তেম কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায়, সরকারের প্রতি এক ধরণের অনাস্থা দেখা দিয়েছে এই ৪২ ভাগ মানুষের মাঝে। এমন কি দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের বিদায়ী ভাষনে উঠে এসেছে কাজ করার ক্ষেত্রে দুদকের স্বাধীনতার অভাবের কথা, কেউ কেউ এই উদাহরণ দেখিয়ে মন্তব্য করেছে সরকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আর এই সরকারের আমলে সবচেয়ে আলোচিত হত্যা ছিল সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যা। এই হত্যা রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় কেউ কেউ দেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রীসহ সাবেক ও বর্তমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দেয়া নানা বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে।
এ তো গেল মুদ্রার এক পিঠ, মুদ্রার অন্য পিঠে চারদলীয় সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া নানা রকম দুর্নীতিকে সামনে এনেছেন তারা। যে সরকারের আমলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ছেলেরাই বিদেশে টাকা পাচারের সাথে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ আছে, সেই দলকে নিয়ে অনেকে কোন কথা বলতেই আগ্রহ দেখান নি। এছাড়া আঠারো দল ক্ষমতায় আসলে উদ্ভূত পরিস্থিতি কি হতে পারে তা নিয়েও অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করা এই সরকারের একটি বড় অর্জন এবং বর্তমান সরকারের আমলে দেশে জঙ্গী তৎপরতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আঠারো দল ক্ষমতায় আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে জঙ্গি গোষ্ঠী তৎপর হয়ে উঠতে পারে বলেও আশংকা এদের। বিগত সরকারের সময় ১৭ই আগষ্ট সারাদেশে একযোগে গ্রেনেড হামলা হওয়ার ঘটনাকে অনেকেই সামনে এনেছেন। এদের অনেকেই আবার আঠারো দলীয় জোটের সাথে, জামায়াত এবং হেফাজতের সম্পৃক্ততা ভালো চোখে দেখছেন না, এ কারনে আঠারো দলীয় জোট ক্ষমতায় আসলে ধর্ম ভিত্তিক এই দলগুলোর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ তারা। তাই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমন একটি সরকার প্রত্যাশা করছেন দেশের মানুষ যারা সরকারের ভিতরে ও বাইরে কোন রকম দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেবে না। সেই সাথে ঘুরে ফিরে সেই একই দুর্নীতিগ্রস্ত মুখগুলোকে মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হিসেবে দেখতে চায় না দেশের সাধারণ মানুষ।
জরিপে ২৫ ভাগ মানুষ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। যেহেতু গত নির্বাচনে দেশের এক তৃতীয়াংশ ভোটারই ছিল তরুণ এবং মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল ঘরে ঘরে চাকরি দেবার প্রতিশ্রতি। কুড়িগ্রামের মত দারিদ্রপীড়িত কিছু এলাকা ছাড়া সামগ্রিকভাবে মহাজোটের দেয়া এই প্রতিশ্রতি সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি বলে মনে করেছে জরীপে অংশ নেয়া এক দল তরুণ। তারা মনে করেন নতুন প্রজন্মকে পিছিয়ে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, কেননা দিন শেষে আজকের নতুন প্রজন্মকে আগামীতে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাই তাদের কে সাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন জরীপে অংশ নেয়া এই তরুণরা।
এই জরিপটি করার সময় রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু রিক্সাচালকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, নতুন সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা কি? বেশি ভাগ রিক্সাচালকের কথাতেই ছিল একটি সুর।
সেটি হল সারাদিন রিক্সা চালিয়ে ঘরে ফেরার সময় তাদের বাজার করে নিয়ে যেতে হয়, কিন্ত তারা যা আয় করেন তা দিয়ে পরিবারকে দুবেলা দুমুঠো খাওয়াতে তারা রীতিমত হিমশিম খান। বলা বাহুল্য, শুধু রিক্সাচালক নন, জরিপে অংশ নেয়া ১৭ ভাগ মানুষই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
চালের দামসহ নিত্য প্রয়োজনীয় নানা পন্যের দাম এমনভাবে বেড়ে গেছে যে তা কিনতে গিয়ে রীতিমত নাভিশ্বাস ওঠার মত অবস্থা বলে জানিয়েছেন এই রিক্সাচালকরা। কেউ কেউ অভিযোগের সুরে বলেন, ক্ষমতায় গেলেই তো সবার চোখ ওপরে চলে যায়, আমাদের দিকে তখন কেউ আর ফিরেও তাকায় না, কয় টাকা আয় হয় আর চালের দাম কয় টাকা। এই সবকিছুকে তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছেন। তবে, রিক্সা চালকদের এই অভিযোগ বিশেষ কোন সরকারের প্রতি নয়। তারা বলেন, যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুন না কেন দেশে অনেক উন্নয়ন হয় ঠিকই কিন্তু আমাদের অবস্থার কোন উন্নতি হয় না। তাই নতুন সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা, সরকার যেন শুরু থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন।
বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তির মত খাতগুলোতে উন্নয়নের পাশাপাশি যেমন বেশ কয়েকটি উড়াল সড়ক নির্মাণ করায় সরকারকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অনেতেই, তেমনি ঋণ কেলেংকারীর কারনে পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনো অগ্রগতি না হওয়ার হতাশা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। এই জরীপে অংশ নেয়া ১৬ ভাগ মানুষ দেশের আর্থ- সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছে। নতুন সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা দেশের সবচেয়ে বড় সেতু, পদ্মা সেতু যেন বাস্তবে রুপ নেয়।
এই গবেষণাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল নতুন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা কি তা খুঁজে বের করা। বেশিরভাগ অংশ গ্রহণকারীই আসলে একটি দূর্নীতিমুক্ত শাষণ ব্যবস্থা চেয়েছেন সরকারের কাছে। আর সরকার কাঠামোতে নতুন মুখ দেখতে চান দেশের মানুষ। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের যারা এই জরীপে অংশ নিয়েছিলেন, তারা মন্ত্রীদের আসনে চান শিক্ষিত, বুদ্ধিদীপ্ত আধুনিক নতুন মুখ এবং সেটি যদি হয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নবীন কেউ, সেটিকেও তারা স্বাগত জানিয়েছেন।
লেখক: এমএসএস, মিডিয়া স্ট্যাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ,ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আটর্স বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সময়: ০৫২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৩
এডিএ/জিসিপি