অনেকদিন ধরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে আন্দোলন চলছে। একদিকে বর্তমান উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন, অন্যদিকে পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্তে পর্বতের ন্যায় অটল জনাব আনোয়ার হোসেন।
পত্রিকা মারফত জানতে পারি যে, জাবিতে শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন ১২টি দাবি নিয়ে। এর মধ্যে নাকি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত দাবি হলো শিক্ষকদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের জন্য সুষ্ঠু তদন্তের দ্বারা দোষীদের শাস্তি প্রদান। জানা যায় যে, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের হাতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। এর জন্য সেই ছাত্রের শাস্তির দাবিতে শিক্ষকদের একটি অংশ আন্দোলন শুরু করেন।
একজন শিক্ষক ছাত্রদের হাতে লাঞ্চিত হয়েছেন এ ঘটনা কিন্তু শুধু সেই শিক্ষক বা তাঁর সমর্থকদের জন্যই লজ্জার নয়, এটা সকল শিক্ষকদের জন্য বিষম লজ্জার একটি বিষয়। এখানে দোষী ছাত্রের বিচার করাতে শিক্ষকদের মাঝে কেন মতভেদ থাকবে? কেন এভাবে আন্দোলন করতে হবে?
শিক্ষকেরা নিজেদের কলিগের লাঞ্চনার প্রতিবাদে এক হতে পারেন না, বিভক্ত হয়ে পড়েন। কারণ, এখানে শুধু লাঞ্চনাকারী ছাত্র বা তার সংগঠন জড়িত থাকে না, পরোক্ষভাবে ইন্ধন যোগান ওপর একজন বা একাধিক শিক্ষক!! শিক্ষকদের প্রশ্রয়েই একজন ছাত্র শিক্ষককে লাঞ্চনা করার সাহস পায়। এই ক্ষেত্রে দোষী ছাত্রের যেমন বিচার হওয়া দরকার, তেমনি আমাদের শিক্ষকদেরও আত্মশুদ্ধির দরকার।
ছাত্রদের কাছে কখন একজন শিক্ষক মার খেতে পারে, ভাবতে পারেন? তখনই পারে যখন আমরা শিক্ষকেরা তাদের মাঝে বিন্দুমাত্র নৈতিকতার বীজ বপন করতে পারিনা। শ্রদ্ধা নয়, চরম ঘৃণার পাত্র হলেই ছাত্রদের দ্বারা কোনো শিক্ষক লাঞ্চিত হতে পারেন। আমি এখানে ছাত্রদের মধ্যে আসলেই কোনো দোষ দেখিনা। এর দায় সম্পূর্ণই আমাদের শিক্ষকদের।
এক কালের আদর্শবান ব্যক্তি বলতেই যখন শিক্ষকদের নিয়ে ছাত্ররা রচনা লিখত, সেই আদর্শবান শিক্ষকেরা এখন এমন কোনো ঘৃণ্য কাজ নেই যা করছে না। ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি, ছাত্রদের হাতে অস্ত্র-নেশা করার অর্থ তুলে দেয়া, ভর্তি বাণিজ্য, ঘুষ কেলেংকারি এমন কোনো ঘৃণ্য কাজ নেই যা এখন শিক্ষকেরা করছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের সময় মেধার আগেই যাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করতে হয়, সেখানে তো শিক্ষাদান এবং গবেষণার আগে রাজনীতি প্রাধান্য পাবে তা বলাবাহুল্য। আর এর প্রতিফলন আমরা দেখি প্রতি পদে পদে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকটি নিয়োগ পেয়েই দলাদলি শুরু করে দেন।
এই যে আজ আমরা শিক্ষকেরা কয়েকজন মিলে একজন শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রেখেছি, এতে কি ছাত্রদের কাছে আমরা কোনো সম্মান আশা করতে পারি? এই যে, একজন শিক্ষক হয়েও অবরুদ্ধ হয়ে আমি চেয়ার আঁকড়ে পরে আছি, আমি চেয়ারে থাকব, কি থাকব না, এজন্য রাষ্ট্রপতি নামক মুরব্বির সালিশ মানছি, এতে কি আমার সম্মান বাড়ছে?
আসলে শিক্ষক হিসেবে আমাদের দায়িত্বটা কি? শিক্ষাদান ও গবেষণা। এর বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন। কিন্তু যখন শিক্ষাদানের থেকেও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন ধ্যানজ্ঞান হয়ে পরে, তখন তাকে আর শিক্ষক না বলে আমলা বলাই শ্রেয় নয় কি?
এত এত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জনাব আনোয়ার পদ আকঁড়ে আছেন। কারণ এদেশে পদ থেকে টেনে হিঁচড়ে না নামলে কেউ নামতে চায় না। এ দেশে পদত্যাগ করার মানে হলো অভিযোগ মেনে নেয়া। তাই মান যায় যাক, চেয়ার ছাড়ব না নীতিতে সবাই বিশ্বাসী।
অন্যদিকে ওই যে, ভিসির রুমের বাইরে অবরুদ্ধকারী শিক্ষকেরা যারা চেয়ারে বসে আছেন, তারা কি আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গলের জন্য আন্দোলন করছে বলে করছেন? না। তারা আন্দোলন করছেন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। কারণ, তাদেরও লক্ষ্য রুমের ভেতরের ওই চেয়ারটি। এই চেয়ারের লোভ আছে জন্যই আজ আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা আদর্শহীন হয়ে পড়ছি দিন দিন।
শিক্ষার্থীরা যাদেরকে আদর্শ মনে করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখবে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা কি আদৌ তাদের সামনে নিজেদের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছি? কার স্বার্থে আমরা আন্দোলন করছি? এইসব মতভেদ, দলাদলি, আন্দোলন করে পত্রিকার শিরোনাম হয়ে আমরা কি প্রতিষ্ঠিত করছি? কার স্বার্থে করছি? সম্পূর্ণই নিজের স্বার্থে নয় কি? কার স্বার্থে চেয়ার আঁকড়ে পরে আছি? নিজের স্বার্থেই নয় কি? আর কত অধঃপতন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হুঁশ হবে?
জিনিয়া জাহিদ: বাংলাদেশের এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নরওয়ে থেকে "ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ইকনমিক্স" বিষয়ে এমএস শেষ করে অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছেন। সেখানে বাংলাদেশের "খাদ্যনীতি"নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৩, ২০১৩
এনএস/জিসিপি