ঢাকা, শনিবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আচরণ

আশরাফ আহমেদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৩
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আচরণ

গেল সপ্তাহে একটি গ্রুপ ই-মেইলে প্রথম জানতে পারলাম যে, অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নিজ অফিসে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। খবরটি দেখে খুব খারাপ লাগলো।

কিন্তু তার চেয়ে বেশি মর্মাহত হলাম সাথের লাইনটি পড়ে। চিঠির প্রেরক লিখেছেন, গ্রাজুয়েট বায়োকেমিস্ট’স অ্যাসোসিয়েশন, সংক্ষেপে জিবিএ-এর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, অধ্যাপক হোসেন এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত জিবিএ-এর সভাপতি ছিলেন। উপাচার্যের অফিসের দরোজা প্রহরারত কয়েকজন শিক্ষককে সাধারণ সম্পাদক নিজের পরিচয় দিয়ে উপাচার্যের সাথে দেখা করতে চান বলাতেই শিক্ষকদের কেউ কেউ তাঁকে “ধর ধর” বলে তাড়া করেছেন। আমার মর্মাহত হওয়ার কারণ এখানেই।

আমি নিজেও বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ছিলাম। সেটি প্রায় চার যুগ আগের কথা।   তারপর আমেরিকায় এসে শিক্ষকতা ও গবেষণায় সফলতা নিয়েও গর্ব করতে পারি।   কিন্তু বাংলাদেশে সেই শিক্ষক হতে পারাটাকেই আমি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন বলে মনে করি। শিক্ষকতাকে শুধু ক্লাশরুমে পাঠ্যদানেই সীমাবদ্ধ রাখিনি, আমার ব্যবহার ও আচরণ যেন ছাত্রদের কাছে অনুকরণীয় হয় তারই চেষ্টা করেছি প্রতিটি দিন। প্রতিদানও পেয়ে এসেছি, এখনও পাচ্ছি। তাই এক লাইনে নিজের পরিচিতির কথা লিখতে হলে ধর্মজ্ঞান করার মতোই আজো আমি “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক”  লিখে থাকি। শিক্ষকদের মাথা উঁচু হয়ে থাকার সবকিছুকেই অত্যন্ত পবিত্র মনে করি এবং সেভাবেই সব যায়গায় নিজেকে পেশ করার চেষ্টা করি। তাই আমার সমগোত্রীয় পেশার কারো আচরণে যদি তার ব্যত্যয় দেখি,তাতে পীড়িত হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের পক্ষে অপরিচিত এবং অতিথি-সম জিবিএ-এর সাধারণ সম্পাদককে “ধর ধর” বলাটা অত্যন্ত গর্হিত, অশিক্ষক-সুলভ আচরণ বলেই আমার মনে হয়েছে।

পত্র-পত্রিকার খবরে আরো জানতে পারলাম, অধ্যাপক আনোয়ারের পদত্যাগ দাবি করার বারোটি প্রধান কারণের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, কয়েক মাস আগে এক ছাত্র কর্তৃক এক শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ করার পরও ছাত্রটিকে কেন সঠিক বিচার করা হলো না। অর্থাৎ অভিযোগকারীদের দাবি অনুযায়ী ছাত্রটিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা কেন হলো না। যতদূর মনে পড়ে উপাচার্যের উদ্যোগে ছাত্রটি লাঞ্ছিত শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চেয়েছিল বলে পত্রিকায় পড়েছিলাম। কিন্তু দৃশ্যতই সেই ক্ষমা চাওয়া শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি! ঘটনা সেদিন কি হয়েছিল তার বিস্তারিত আমি জানি না, আর এখন তা জানার কোনো প্রয়োজনও বোধ করি না। আমার শুধু মনে হচ্ছে শিক্ষক কর্তৃক একজন অতিথিকে “ধর ধর” বলে তাড়া করার সে ই-মেইল-টি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে আমার মত বাংলাদেশের সব শিক্ষকেরই তাতে অপমানিত বোধ করা উচিৎ।  

পত্রিকার ছবিতে উপাচার্যের অফিসের সামনে অবস্থানরত যেসব শিক্ষকদের দেখা যাচ্ছে, তাঁদের সাথে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের শিক্ষকদের তুলনা করলে ছবির লোকজনকে বেশ হৃষ্টপুষ্ট বলে মনে হয়েছে। “ধর ধর” বলে তেড়ে আসা “স্বাস্থ্যবান” সেই “শিক্ষক”-দেরকে ভয় পেয়ে একজন বহিরাগত জিবিএ-এর সাধারণ সম্পাদকের ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে আসাটাই স্বাভাবিক। আমার ধারণায় সাধারণ সম্পাদকের বয়স চল্লিশ এর কোঠায়। এই বয়সে মানুষের যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিস্তেজ হয়ে আসে। কিন্তু একজন ছাত্র, যার বয়স সাধারণতঃ আঠারো থেকে আটাশের মধ্যে থাকে, তার রক্ত থাকে টগবগে।   আমি জানি না কি পরিস্থিতিতে ছাত্রটি শিক্ষকের সাথে অছাত্র-সুলভ আচরণ করেছিল। কিন্তু অতিথিকে “ধর ধর” বলতে পারা একজন “শিক্ষক” যদি কোনো রক্ত-টগবগ-করতে-থাকা তরুণকে, একজন ছাত্রকে এই ধরণের “মার মার” বা “ভাগ ভাগ” বলে থাকেন (শিক্ষক কি বলেছিলেন বা করেছিলেন তা আমার জানা নেই)তাহলে? এমনটা হয়ে থাকলে সেই ছাত্র তার ছাত্রত্বের সীমানার কথা ভুলে যেতে পারে বৈকি! (আমি ছাত্রটির আচরণকে কোনো মতেই সমর্থন করছি না। )

অভিযোগের ভিত্তিতে ধরে নেওয়া যায়, ছাত্রটি শিক্ষককে যে লাঞ্ছিত করেছিল তা আসলেই অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব শুধু বিচারকার্য পরিচালনা নয়। আর তিনি তো একা সিদ্ধান্ত নেন না, নিতে পারেন না। সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে উপাচার্যকে তাঁর বিবেচনায় এবং ক্ষমতায় যা বিচার করবার ছিল তাই হয়তো করেছেন। বিচারপ্রার্থী শিক্ষকগণ তাতে সন্তুষ্ট হলেন না। তাঁদের দাবির কথা শুনলে মনে হয় তালগাছের মালিকানা নিয়ে বিচার চাইলেও বিচারের সিদ্ধান্ত হতে হবে “তাল গাছটি আমার”।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তে শিক্ষকগণ সন্তুষ্ট না হলে কোর্টে বিচার চাইতে পারতেন। তাঁরা তা করলেন না। বিভিন্ন সময়ে সুযোগ পেলেই ক্লাশ নেওয়া বন্ধ করে ছাত্রদের পড়াশোনার ক্ষতি করে চললেন। অথচ তাঁরা কাজ করেননি বলে মাস শেষে বেতন নিতে চান নি তেমন কোনো সংবাদ কিন্তু চোখে পড়ে নি। দরজায় তালা মেরে, প্রশাসনিক ভবন অবরুদ্ধ করে রাখলেও কিন্তু মাস শেষে বেতন নেবার জন্যে  আন্দোলনকারী শিক্ষকগণ কয়েক ঘণ্টার জন্য তালা ঠিকই খুলে দিয়েছিলেন বলে পত্রিকায় দেখেছি।

অধ্যাপক আনোয়ার আমার অনেকদিনের পুরনো বন্ধু। এক সাথে পাশ করে একই দিনে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলাম। দু’জনে মিলে আমরা কতগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রথমতঃ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়া কোনোদিন ক্লাশে লেকচার দেব না। দ্বিতীয়তঃ ছেলে হোক মেয়ে হোক, বেশি ভাল ছাত্র হোক বা পড়াশোনায় অমনোযোগী হোক, ছাত্রটি বাকপটু হোক বা নিরীহ-নিশ্চুপ হোক, কারো প্রতি কোনোদিন পক্ষপাতিত্ব করবো না। আমাদের নিজেদের শিক্ষকতার মান ও শিক্ষক-সুলভ আচরণ হচ্ছে কিনা তা যাচাই করার জন্য আমি যখন লেকচার প্র্যাকটিস করতাম, আনোয়ার ভাই তখন ছাত্র হয়ে বসতেন এক ঘণ্টা। একইভাবে তার লেকচার প্র্যাকটিস করতেন আমাকে এক ঘণ্টার জন্য ছাত্র বানিয়ে। ছাত্র এবং অন্য শিক্ষকদের সাথে আমাদের আচরণ-ব্যবহার ঠিক হচ্ছে কিনা নিজেদের মধ্যে তা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের উপদেশ চেয়েছি। সর্বোপরি ছাত্রদের স্বার্থটাই আমরা সবসময় বড় করে দেখবো এই প্রতিজ্ঞা আমাদের ছিল এবং তা পালন করার চেষ্টা করেছি সর্বদা।  

তাই দেখি জেনারেল জিয়ার নিপীড়নের ফলে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করতে পারছিলেন না বলে অধ্যাপক আনোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেছিলেন সেই ১৯৭৫ সনে। অধ্যাপক আনোয়ার ২০০৩ সনে পুলিশের লাঠি থেকে ছাত্রকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে পুলিশের লাঠি ও বুটের আঘাতে জখম হয়ে তিন মাস শয্যাশায়ী থাকলেন। সামরিক বাহিনীর অত্যাচার থেকে ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে অধ্যাপক আনোয়ার অত্যাচারিত হয়েছেন ২০০৮ সনে। দেশের রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্ররাও স্বীকার করে যে, অধ্যাপক আনোয়ার তাঁর প্রাথমিক দায়িত্ব, তথা শিক্ষকতায় কোনো ত্রুটি করেননি। সেই দায়িত্ববোধই অধ্যাপক আনোয়ারের শক্তি হয়ে আছে। এমন সহৃদয় একজন ব্যক্তি একটি অন্যায়ের কারণে একজন ছাত্রের ছাত্রত্ব কেড়ে নিতে দ্বিধা করবেন, তাতে আমি বিস্মিত হইনি।

এখানে লোকমুখে শোনা পুরনো একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করাটা অযৌক্তিক হবে না। ছাত্র-আন্দোলনে অতিষ্ট হয়ে আইয়ুব খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ডেকে পাঠালেন তখনকার গভর্নর ভবনে। তিনি বললেন শিক্ষকরা যেন ছাত্রদের আন্দোলন করা থেকে নিবৃত্ত করেন। অর্থনীতির প্রথিতযশা অধ্যাপক ডঃ আবু মাহমুদ বলেছিলেন, “আমরা ক্লাশে পড়ানোর পর ছাত্ররা বাইরে কখন কি করে তা জানতে পারি না। কাজেই তাদের আন্দোলনে আমরা বাধা দেব কিভাবে”? আইয়ুব খান উত্তর দিয়েছিলেন, “সেক্ষেত্রে আমি উপাচার্যকে বলবো আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করতে”। যারা সে সময়কার ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তাঁরা জানেন যে কিছুদিন পরই ডঃ আবু মাহমুদকে আইয়ুব-মোনেম-এর পোষ্য ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এর “ছাত্র”রা প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় হকি স্টিক দিয়ে পিটিয়ে রক্তাত্ত করে বীরের মত চলে যায়।  

আজকের আন্দোলনরত “শিক্ষকরা” “অপরাধী ছাত্র”-টিকে “সঠিক বিচার” না করায় অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনকে পদত্যাগে বাধ্য করতে মরণপন করছেন। আর এজন্য উপাচার্যকে দীর্ঘ ৮৫ ঘণ্টা ছোট্ট একটি ঘরে বন্দী করে রাখার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন।  

এ দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় পঁয়ষট্টি বছর বয়সী এক শিক্ষাবিদকে একটি ঘরে বন্দী করে রাখায় তাঁর শারীরিক অবস্থার কি হয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে আমি নিজের কথা বলতে পারি। এতোদিন চার দেয়ালের মধ্যে আমাকে স্থবির করে রাখা হলে আমার হাত পায়ের রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে অথবা রক্ত-চাপ বেড়ে হৃদপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে আমার। আন্দোলনরত শিক্ষকরা তেমন একটি মৃত্যুর দায়িত্ব নিতে কি প্রস্তুত ছিলেন? এ লেখা যখন প্রকাশের জন্য পাঠাবো তার আগেই সুসংবাদটি পেলাম। ৮৫ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। ১৫ দিনের জন্য অবরোধ প্রত্যাহার হয়েছে। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা, আবার যেন নতুন করে তাঁকে বন্দী করা না হয়, অবরুদ্ধ করা না হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে, অপমান করা না হয় জাতির বিবেককে।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষক। বর্তমানে যুক্তরাষ্টপ্রবাসী বিজ্ঞানী ।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৩
জেএম/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।