১৯৫২ এর একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে `৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) জনগণ যে চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বিজয় অর্জন করেছে, সেটা নিঃসন্দেহে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চৈতন্যের উন্মেষের ফলস্বরূপ।
সে সময়ের এই বাংলার পুরো বাঙালি জনগণকে বাঙালির জাতীয়বাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ করেছিলো, তা সত্য।
একাত্তর টিভিতে মিতা হকের আলোচনা শুনে আমার মনে হয়েছে, তিনি সেই ঐতিহাসিক বাঙালি চেতনাটাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে, বোরকা ইসলামের পরিচয়বাহী একটা পোশাক, যা অনস্বীকার্য। নারীদের বোরকার মতই হেফাজতি পুরুষদের লম্বা জোব্বা মুখে লম্বা দাঁড়ি, এবং মাথায় টুপি/পাগড়ি অবশ্যই আমাদের ইসলামী পরিচয়টাকে প্রধান করে তুলে বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে। মিতা হক নিঃসন্দেহে তাকেই ইঙ্গিত করেছেন। সমাজে, রাষ্ট্রে, রাজনীতিতে বিরাজমান দ্বন্দ্বটাই মিতা হকের কথায় উঠে এসেছে। স্বাধীনতার `৪২ বছর পরও যখন এই ব্যাপারটার কোন সমাধান এখনো আসেনি, এসব নিয়ে আরো বহুদিনই ফাটাফাটি, কাটাকাটি, মারামারি, ঝগড়া-ঝাটি, যুদ্ধাযুদ্ধি যে চলবে তা বলাই বাহুল্য।
তসলিমা নাসরিনের লেখার পর, বোরকা নিয়ে যে বিতর্কটা উঠেছে, সেখানে কিছু কথা না বললেই নয়। বাংলাদেশের এই বিশাল মুসলিম জনসংখ্যার শতকরা কতজন নারী বোরকা পরেন? বা সোজা কথায়, যাকে বলে শুধু চোখ ছাড়া শরীরের সর্বত্র ঢাকেন? আর চোখ যতটুকু খোলা থাকে, তাতে চোখের ভাষা পড়া সহজ নয়। চোখের ভাষা পড়তে হলে শুধু চোখ নয়, সে সঙ্গে চোখের আশপাশ খোলা থাকা উচিত।
বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মুসলিম নারী বোরকা পরেন না, তবে কি বলা উচিত, তারা কম মুসলিম? তা অবশ্যই নয়। এই বিপুল সংখ্যক নারী ধর্মীয় অনুশাসন জানা সত্ত্বেও যখন বোরকা পরছেন না, তার পেছনে নিশ্চয়ই কোন গূঢ় কারণ রয়েছে। কারণটা নিয়ে একটা গবেষণামূলক লেখা আজ পর্যন্ত হয়নি।
এই বিষয়ে যারা নিজেদের বেশি মুসলিম মনে করছেন, তাদেরই এগিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। কারণ, আজ যারা বোরকার পক্ষে সরব হচ্ছেন- তাদের স্ত্রী, মাতা, কন্যা, বোন, বা বান্ধবীদের বেশিরভাগই বোরকা ব্যবহার করছেন না। কিন্তু এমন কথা বোরকার বিরুদ্ধে তসলিমা নাসরিন-মিতা হকদের বলার সুযোগ করে দিচ্ছে। বোরকা সম্পর্কে আরো গভীর বিশ্লেষণে গেলে আরো অনেক সত্য বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে। তবে এখানে আমাদের চোখটা হতে হবে সহজ-সরল-সাদাসিদা। দেখা যাবে আমরা কিভাবে আমাদের চিন্তা-চেতনে স্ববিরোধিতায় লিপ্ত হচ্ছি।
আমি ব্যক্তিগতভবে মানুষের মুখ ঢাকার বিরোধিতা করি, সেটা পুরুষ বা নারীর মুখই হোক। পুরুষ যদি এমন পোশাক পরে, যার ফলে তার মুখাবয়ব দেখার সুযোগ নেই, সেটাতে আমি যেমন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না, তেমন নারী তার মুখাবয়ব ঢেকে ফেললেও আমি তাতে স্বস্তি বোধ করি না।
কেননা, আমরা এখন এমন এক বাস্তবতায় বসবাস করছি, যেখানে নারী-পুরুষকে পাশাপাশি কাজ করতে যেতে হচ্ছে। পড়াশুনা থেকে শুরু করে চাকরি জীবন অবধি। সেখানে আমার সহপাঠিনী, বা সহকর্মী তার মুখাবয়ব ঢেকে রাখলে তার সঙ্গে আমার কমিউনিকেশনটা সঠিক না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমরা একধরনের কমিউনিকেশন গ্যাপের মধ্যে থেকে একপ্রকার কষ্টকর প্রক্রিয়ায় যোগাযোগটা চালিয়ে যাবো, যাতে ভুল বুঝাবুঝির সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
এ কথা বলার প্রধান কারণ, মানুষের চোখ এবং মুখের ভাব মুখের কথার চেয়ে অনেক বেশি অর্থবোধক। শুধু কথা দিয়েই যদি ভাব প্রকাশ যথেষ্ট হতো, তবে যাত্রা-নাটক-অভিনয়-চিত্রকলা-ফটোগ্রাফির প্রয়োজন হতো না। মুখের ভাব এবং চোখের ভাষাকে তুলে ধরে এত এত অর্থপূর্ণ গল্প-কবিতা-গান তৈরি হতো না। মানুষের অভিব্যক্তির প্রকাশটাই মানুষের কমিউনিকেশনের এক বিরাট বড় অনুসঙ্গ। ভাব-প্রকাশের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিকই হচ্ছে মানুষের চোখ মুখের অভিব্যক্তি। অভিব্যক্তিহীন মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা জমে উঠে কি? টিভি আসার পর রেডিও-নাটক আগের মত তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছে কি?
আজ যারা বোরকার পক্ষে বলছে, তারা কি বলিউডি নায়িকাদের সুন্দর মুখশ্রী দেখা থেকে দূরে রয়েছে? এমনকি হলিউডি নায়িকাদের? পর্ণো-ছবির কথা এখানে বাদই দিলাম, যদিও বলিউডি বিনোদনী চলচ্চিত্রগুলোতে সফ্ট-পর্ণের মাল-মসলা ঠিকই বর্তমান । এ ধরনের বলিউডি জনপ্রিয় বিনোদনী চলচ্চিত্রগুলোকে আমরা আবার পারিবারিকভাবেও উপভোগ করছি।
একজন গায়িকা যদি টিভিতে, স্টেজে বোরখা পরে গান গায়, আমরা কি তা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করছি? এসবকি আদৌ ঘটছে এই বাংলাদেশ নামক ভূ-খণ্ডে? তবে বোরকার পক্ষে বলার আগে আমাদের ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে প্রথম দাঁড়াতে হবে। আমাদের দাঁড়াতে হবে, আমাদের থিয়েটার, টিভির বিরুদ্ধে। কেননা, থিয়েটারে বা টিভির পর্দায় একজনও মুখ ঢাকা নারীর সন্ধান পাই না। যদি বোরকা পরা নারী আমরা টিভি-থিয়েটার-চলচ্চিত্রে না দেখি, তবে সেটা আমাদের সুস্পষ্ট একটা ম্যাসেজ দিচ্ছে, এখনকার পৃথিবীতে বোরকা একটা যথেষ্ট অচল পোশাক। আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, আর্মি-বিজেবি-পুলিশ, অফিস-আদালত-ব্যবসা-বাণিজ্য-কলকারখানা এবং গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে শতকরা কতভাগ কর্মজীবী নারী বোরকা পরছে? এমনকি গ্রামাঞ্চলে বাড়ির ভেতরের অপরিচিত পুরুষ বা চাচাতো-ফুপাতো-মামাতো-খালাতো ভাইদের সামনে কত পার্সেন্ট মেয়ে বোরকা বা মুখাবয়ব ঢেকে পর্দা করছে, তার পরিসংখ্যানটা নিশ্চয়ই সবার জানা।
সুতরাং এটা বলতে দ্বিধা নেই, এরকম একটা বাস্তবতায় আমরা বাস করছি যেখানে স্বল্পসংখ্যক নারীই বোরখা-রুপ পর্দা করছেন। এর বিপরীতে যে অল্পসংখ্যক নারী পর্দায় নিজেদের আবদ্ধ করছেন, তারা কি সবাই ধর্মীয় বিধি-নিষেধের কারণেই পর্দা করছেন? এমন একটা পরিসংখ্যানের কথাও শুনেছি, যেখানে বলা হয়েছে- শহর-মফস্বল অঞ্চলের মেয়েদের বোরকা করার আর একটা বড় কারণ হলো, ইভটিজারদের থেকে রক্ষা পাওয়া বা সামাজিক নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণ।
বোরকা সম্পর্কে আমার এতকথা বলার কারণ, আমি জোর দিয়ে বলতে চাচ্ছি- বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডের বাস্তবতায় (যেটা গরম আবহাওয়াজনিত কারণেই হোক, আমাদের ঐতিহ্যগত বা অন্যবিধ কারণেই হোক) বোরকাকে বিশাল মুসলিম নারী জনগোষ্ঠী স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করতে পারেনি। এই সত্যটাকে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে। বোরকা এখানে এসেছে ইসলামী সংস্কৃতি বা ইসলামী জাতীয়তার নিদর্শনরূপে। কিন্তু আমাদের মূল্যবান পরীক্ষিত বাঙালি জাতীয়তা এবং এর ভেতরের অন্তর্নিহিত ধর্মনিরপেক্ষ স্বত্ত্বা বোরকাকে বিপুলভাবে সাদরে গ্রহণ করতে পারেনি বা একে আদৌ প্রয়োজনীয় একটা পোষাক হিসেবে গ্রহণ করেনি। এখানে ইসলামী পরিচয়বাহক এই পোষাক তার গুরুত্ব যথেষ্টভাবে হারিয়েছে, তা প্রমাণিত।
আমাদের এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠী ইসলামী নিয়ম-কানুনকে তার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে নির্বিরোধিতায় এবং শান্তিপূর্ণতার সঙ্গে মিশিয়েছে। এখানকার জনগণ সৌদি বা মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ নয় (যদিও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও আচার-আচরণের বিভিন্নতা রয়েছে)। যেহেতু আমাদের একটা আলাদা ভাষা রয়েছে, সুতরাং আমাদের একটা আলাদা প্রকাশভঙ্গী এবং ইউনিক পরিচয় রয়েছে। আমাদের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার, ভাব-ভঙ্গীর মধ্যে নিজস্বতা রয়েছে, যা থেকে আমাদের বিচ্যূত করা অসম্ভব।
আমাদের এই নিজস্বতার সঙ্গে ভিন্ন সংস্কৃতি-কৃষ্টি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুস্থ, সবল উপকরণকে আমাদের সুবিধার্থে বা আমাদের উপকারার্থে আমরা আমাদের মত করে মিশিয়ে চলেছি। এটাই আমাদের অগ্রযাত্রা। নারীদের পর্দা করতে এখানে ঘোমটা আছে, ওড়নার ব্যবহার এসেছে, বিশেষ করে বয়স্ক নারীদের দেখা যাচ্ছে ওড়নার মত মোটা কাপড়ে মাথা এবং কাঁধ মুড়িয়ে নিতে। হেজাবও পরা হচ্ছে। আর এসব কোনটাতেই বোরকার মত করে সম্পূর্ণ মুখাবয়ব ঢাকা পড়ে না, আমাদের নারীরা ফেসলেস, বা অভিব্যক্তিহীন হয়ে পড়ে না। এটাও মনে রাখা উচিত, অভিব্যক্তিহীন হয়ে কারো ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠতে পারে না। সেই কারণে নারীদের ব্যক্তিত্বহীন করে রাখাটা এযুগের প্রেক্ষাপটে আদৌ সম্ভব বলে মনে করি না। সুতরাং আমাদের পুরুষ-জাত্যাভিমান দিয়ে একটা নারীর পোষাক বিবেচনা করা মোটেও সঠিক না।
বর্তমানে পাশ্চাত্যে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় মুসলিম জনগোষ্ঠী উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়ও মুসলিম জনগোষ্ঠী সাংখ্যিক দিক থেকে একটা ভাল অবস্থানে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসলমান নারীদের শতকরা একভাগের বেশি শীত প্রধান দেশ কানাডার এই টরন্টো শহরে বোরকার মত মুখাবয়ব আবৃত করে রাখে না। কিন্ত তাদের অনেকেই হিজাব পরে, রক্ষণশীল পোশাকে নিজেকে আবৃত করে। তাদেরই একজন কোন এক অফিসের কর্মচারী, রমজান মাসের ২২ রোজা অতীত হয়ে যাওয়ার পর রমজান মাস দ্রুত শেষ হয়ে যাবে বলে যখন বলেন, I will be missing it a lot, তবে কি সেই নারীকে কম মুসলিম বলা হবে?
স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবী যত এগিয়ে যাচ্ছে, পরিবারের গণ্ডি ছেড়ে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতি নারীদের দায়বদ্ধতা তত বেড়ে চলছে। নারীরাও কর্মক্ষেত্রে সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরুষের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা অর্জন করছে। নারী-পুরুষের পাশাপাশি কাজ করার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা বেড়েই চলছে। নারীদের ব্যক্তিত্বও সেই সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মুখাবয়ব আবৃতকৃত পোষাক, বোরকার ব্যবহার সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এই সত্য আপনি মুসলিম-জাত্যাভিমানের কারণে অস্বীকার করে আদৌ কি তা পরিবর্তন করতে পারছেন? নিজেকেই প্রশ্ন করুন প্লিজ।
পৃথিবী যত এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা তত যুক্তিবাদী হয়ে পড়ছি। সব কিছুকে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করছি। এটাই ভবিষ্যত পৃথিবীর ট্রেন্ড হয়ে পড়ছে। আপনি, বা আপনারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান। আমার তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু যুক্তিবাদী এবং নিরীশ্বরবাদীরা দিন দিন ধর্মকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে ধার্মিকদের ঈমানকে প্রশ্নসাপেক্ষ করে তুলছে। এর বিপরীতে আপনাকে উপরোক্ত দু`গোষ্ঠীর প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে হবে, তাদের তোলা বিতর্কের অবসান ঘটাতে হবে। তারা যদি বলে ‘বোরকা একটা হাস্যকর পোষাক’ অথবা `এখনকার সময়ে বোরকা ব্যবহারের কোন প্রয়োজন নেই`, তবে আপনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণসুলভ গালি-গালাজ ত্যাগ করে বর্তমানের নিরিখে উপযুক্ত পরিসংখ্যান এবং ব্যাখ্যা নিয়ে উপস্থিত হতে হবে। শুধু শুধু ধর্মের কথা বলে বা আল্লাহ-রাসুল-কোরআনের দোহাই দিয়ে এখনকার সময়ে পার পাওয়া সম্ভব হবে না।
শামান সাত্ত্বিক: কানাডা প্রবাসী ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট,
shamanshattik@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৫০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি