৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’ দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী। এরা প্রত্যেকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে ১৯৭৫ সালে হত্যা করার কারণে ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কার আদর্শ থেকে সরে গিয়েছিল। এই ব্যবস্থা অনেকদিন চলেছে। ছিটমহলে পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ ও ১৯৬১ সালে জনগণনা করা হয়েছিলো। এর দীর্ঘদিন পর মনমোহন- হাসিনার ২০১১ সালের চুক্তি ছিটমহলবাসীদের আশাবাদী করেছে।
এই নিরীহ মানুষগুলোর জন্যে ও কথা বলতে হবে বাংলাদেশ এবং ভারতের সচেতন নাগরিকদের। সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা প্রশ্নে এদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং নিরাপত্তাহীনতা ভারত বাংলাদেশ দুই দেশকেই চরম হুমকির মুখে রেখেছে। এই বাস্তবতা দুই দেশের নীতিনির্ধারক এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।
ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের নাগরিক হলেও বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না । নেই তাঁদের ভোটার পরিচয়পত্র। একই চিত্র বাংলাদেশে থাকা ভারতের ছিটমহলেও। ছিটমহলবাসীদের পরগাছা হিসেবে নিজেদের নাম-পরিচয় লুকিয়ে বাস করতে হচ্ছে ।
ভারতীয় ছিটমহল বা বাংলাদেশের ছিটমহলের প্রকৃত বসবাসকারীরা এখন আর নেই। বাংলাদেশি ছিটমহলে ভারতীয় আর ভারতীয় ছিটমহলে বাংলাদেশিরাই বর্তমানে বসবাস করেন। এটি একটি জটিল সমস্যা। ছিটমহল বিনিময় হলে ভারতের ১০ হাজার একর জমি বাংলাদেশকে দিয়ে দিতে হবে। ভারতের সংবিধান অনুসারে জমি নেয়া যেতে পারে কিন্তু দেওয়া যায় না। এর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এখানেই তৃণমূল নেত্রী মমতা এবং ভারতীয় উগ্র মৌলবাদী সংগঠন বিজেপির আপত্তি।
বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে এবং ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার ভারত ভূখণ্ডে রয়েছে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল। এর মধ্যে ৪৮টি কোচবিহার জেলায়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। ১৯১১ সালের ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত উভয় দেশের যৌথ আদমশুমারী অনুযায়ী, ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ১৪ হাজার ২১৫ জন নাগরিক বাস করছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন ভারতীয় নাগরিক ( নাগরিকত্ব না থাকলেও জন্মসূত্রে নাগরিক)। আইন মোতাবেক ভারতের ভূখণ্ডে বসবাসকারী ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দা বাংলাদেশি আর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ১১১টি ছিটমহলে বসবাসকারীরা ভারতীয় । ভারত-বাংলাদেশ –দুই দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থেই ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব দেবার সময় এসেছে।
আর কতোকাল প্রতিহিংসার রাজনীতির বলি হতে হবে নিরীহ মানুষকে? ছিটমহলের ‘নাইদেশের নাগরিক’দের মানবেতর জীবনের জন্যে দায়ী রাজনীতিকদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সময় এসে গেছে। ছিটমহল বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক অধিকারকে সুরক্ষিত করা এবং তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবিতে বিশিষ্ট আইনজীবী অনির্বাণ দাস কোলকাতা হাইকোর্টে গত সোমবার ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ একটি জনস্বার্থ মামলা করেছেন ।
বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার ছিটমহল বিনিময়ের জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে রাজি থাকলেও বাদ সাধেন ভারতের আসাম রাজ্যের দুই বিজেপি সাংসদ আর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল নেত্রী মমতার দাবি , এই চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে। ‘নিজেদের স্বার্থ’ বিসর্জন (?) দিয়ে কোনো বিনিময় চুক্তি হতে দেবেন না তিনি। মুখ থুবড়ে পড়ে ছিটমহল বিনিময়-প্রক্রিয়া। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ছিটমহলজুড়ে। ছিটমহল বিনিময়ের দাবি আরো জোরালো হয়ে ওঠে ।
মমতা কদিন আগে হঠাৎ বলেন, “ছিটমহলবাসী চাইলে ছিটমহল বিনিময় হবে”। অথচ ১৯৯৪ সাল থেকে ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী অবস্থান ধর্মঘট ও অনশন সহ নানান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। মমতা এসব না জানার ভান করলেন। মমতার এই বক্তব্যকে খণ্ডন করেছেন ছিটমহলবাসী।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহ-সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত আমাকে বলেছেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে দুই দেশেই আন্দোলন করছি। আমরা চাইছি, ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিটমহল বিনিময় হোক। এতে ছিটমহলের বাসিন্দারা একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হয়ে বাস করতে পারবে। এটা তাদের মৌলিক অধিকার । ’
সম্প্রতি ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করতে দেয়া হয় নি। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি র আসামের দুই সাংসদ আপত্তি করেছে। বিলটি লোকসভায় উত্থাপন করা যায়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয় ছিটমহলবাসী। জ্বলছে তাঁদের মনে ক্ষোভের আগুন। তাঁরা ক্ষুব্ধ হন মমতার বিরুদ্ধে।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহ-সম্পাদক জানান, ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল যদি সংসদে না ওঠে, তবে তাঁরা মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনি লড়াইয়ের পথে যাবেন। মামলা করবেন উচ্চ আদালতে।
নাগরিকত্ব না থাকার কারণে ছিটমহলের মেয়েদের বিয়ে হয় না। কোনো সন্তানসম্ভবা মা তার সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন না। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি নেই। এ কারণে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে এই বাসিন্দারা যা এড়াতে পারে না দু’দেশ ।
এই ছিটমহল বিনিময় না হওয়ার ফলে দুদেশের সরকার যে রাজস্ব বা বিভিন্ন প্রকারের কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তার হিসেব কে করবে? এই সুযোগে একদল অসাধু লোক ছিটের বাইরের লোকেদের সাহায্যে ভয় দেখিয়ে জোর করে নামমাত্র মূল্যে ছিটমহলের নামে স্ট্যাম্প পেপার তৈরি করে জমি -বাড়ি রেজিস্ট্রি করাচ্ছে। এই খবর প্রথম বাংলানিউজে প্রকাশ হবার পর ছিটমহলের নিরীহ বাসিন্দাদের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা আগুন লাগিয়ে দেয়।
আগেই বলেছি, নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ নেই বলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা থাকছেন ভারতের ছিটমহলে। পরদেশে পরগাছা হিসেবে বাস করছেন তারা । ছিটমহলের ঠিকানা বদলিয়ে ভারতের কোনো ঠিকানা ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের ভারতীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন, দিনমজুরের কাজ করতে হচ্ছে। ভারতের এলাকায় ভুয়া ঠিকানা দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন । সন্তান প্রসবের সময় প্রসূতি মায়েদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে ভারতের ঠিকানা দিয়ে ।
এমনই মানবেতর জীবন যাপন করছে ছিটমহলের নিরীহ মানুষ গুলো। এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চান তারা। বাস করতে চান একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে। সুযোগ-সুবিধাও চান সেই দেশের। বাংলাদেশ তাঁদের গ্রহণ না করলে তাঁরা ভারতের মাটিতেই থাকতে চান। তাই তাঁরা ছিটমহল বিনিময়ের দাবি তুলেছেন ।
আমার বিশ্বাস ,মানবতার প্রতি সম্মান করে যে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এই দাবির সাথে একাত্মতা জানাবেন। কারণ, ২০১৩ সালে এসে বিশ্বের কোন প্রান্তে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক থাকবে-এটা মেনে নেয়া যায় না।
ছিটমহল বিনিময়ের অযৌক্তিক বিরোধিতা ছিটমহলবাসীর জটিল সংকট নিরসনের প্রতিবন্ধক । তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ ঠেকিয়ে দেবার কারণে মমতা-বিজেপি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই ছিটমহলবাসী ক্ষুব্ধ ।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছিটমহল বিনিময়ে দুই দেশ রাজি হলে ছিটমহল বিনিময়ের কয়েক দশকের আন্দোলন সফলতার পথ উন্মুক্ত হয়। সেই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নেয় উভয় দেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবার আমন্ত্রণ জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সফরের তিনদিন আগে মমতা হঠাৎ বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন । আপত্তি তোলেন ছিটমহল বিনিময়ের বিরুদ্ধে। স্থগিত হয়ে যায় ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়া।
তবে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়, যাতে দুই দেশের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় এবং ছয় দশমিক এক কিলোমিটার অমীমাংসিত সীমানা চিহ্নিত হওয়ার কথা রয়েছে।
তবু তখন ছিটমহল বিনিময় নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে একটি প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়।
সম্প্রতি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে জানা যায়, দৈর্ঘ্যে তিন কিলোমিটার আর প্রস্থে পৌনে তিন কিলোমিটার ভারতের বাত্রিগাছ ছিটমহল। এখানে বাংলাদেশের অন্তত ৫০০টি পরিবার বাস করে। ছিটমহলবাসী আজাদ হোসেন, জয়নাল মিয়া, মোহাম্মদ আলী, বকুল মিয়া ও কল্পনাথ রায় হতাশ, ক্ষুব্ধ স্বরে সাংবাদিকদের বলেছেন, “লুকোচুরি খেলে তো জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এভাবে আর বাঁচা যায় না। এবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য দিতে হবে ছিটমহল বিনিময়ের সুযোগ”। হচ্ছে না। এবার এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চাইছেন তারা। আকুল আবেদন করেছেন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে। তারা যেন ছিটমহল বিনিময়ের দাবির পাশে এসে দাঁড়ান।
তিনবিঘা করিডোরে চুক্তির সময় বলা হয়েছিল এবার ছিটমহল বিনিময় হবে। আইনি জটিলতার কারণে কখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১০ সালে ভারতের জনগণনার সময় কোচবিহারের জেলাশাসক বলেছিলেন আমার জেলায় গণনা করতে গেলে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য লাগবে। কারণ বাংলাদেশী ছিটমহল এই জেলায় রয়েছে। তাদের প্রশ্ন তাহলে এই এলাকায় ভারতের সার্বভৌমত্ব কোথায় আছে? ছিটমহলবাসী প্রশ্ন তোলেন, গোয়া, সিকিম যদি ভারতের অর্ন্তভুক্ত হতে পারে তাহলে কেন ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে না?
বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারকে বিস্তারিত সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সঠিকভাবে জানতে হবে ছিটমহলের বাসিন্দারা কে কোথায় যেতে চান।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ছিটমহলগুলো ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক পাচারের কেন্দ্র । সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, কোচবিহার জেলার বাংলাদেশি ছিটমহলে প্রায় ১৬ কোটি রুপির গাঁজা নষ্ট করা হয়েছে ২০১২ সালে।
জেলাপ্রশাসক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, উদ্ধারকৃত গাঁজার অর্ধেক নষ্ট করা যায়নি। কেন সেসব রেখে দেয়া হয়েছে-বা কোথায় সেসব –তা বিস্তারিত আসেনি কোন সংবাদমাধ্যমে।
বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে ৩৭ হাজার ৩২৯ জন বাস করেন। ছিটমহল বিনিময়ের পরে তার মধ্যে মাত্র ৭৪৩ জন ভারতে আসতে চান -এটা জরিপের তথ্য। ২০১২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিটমহল সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় মনসুর আলি মিঞা বলেন, “আমি আজ যেভাবে এখানে এসেছি, তা রাষ্ট্রের ভাষায় অবৈধ। কারণ আমি খাতা-কলমে বাংলাদেশের বাসিন্দা। কিন্তু আমার বাংলাদেশের কোনো পরিচয়পত্র নেই। আমার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। বাংলাদেশে গিয়ে আমি শরণার্থী হতে চাই না। আমি জন্মেছি ভারতে। ভারতেই মরতে চাই। একইভাবে বাংলাদেশের ভেতরে ছিটের বাসিন্দারাও তাই চান। একজন মুসলিম হয়ে আমার ইচ্ছা ছিল হজে যাওয়া। সেই অধিকার আমার নেই । ” তিনি প্রশ্ন করেন, “আমার মতো অনেককেই হজে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কি মানবাধিকার হরণের মধ্যে পড়ে না?”
৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভিতে সম্প্রচারিত এক মুক্ত আলোচনায় বিজেপির মুখপাত্র তরুণ বিজয় স্বীকার করেন, ভারতের ‘জাতীয় স্বার্থেই’ বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে ভারতীয় পার্লামেন্টের বিরোধী দল বিজেপি তাদের শক্ত অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে মনে হচ্ছে। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস ও আসাম গণ পরিষদ এখনো বিরোধিতা করে যাচ্ছে।
এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য পার্লামেন্টে বিল পাস করতে হলে রাজ্যসভা ও লোকসভায় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার, যা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকারের নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ তিন দফা বিল তোলার উদ্যোগ নিলেও দুইবার বিজেপি ও আসাম গণ পরিষদ এবং একবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। মমতার ভূমিকা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভ্রান্তি হিসেবে উল্লেখ করে মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের তীব্র সমালোচনা করা হয় এই টক শো তে।
টিভি টক শোতে বিজয় বলেন, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ প্রশমনে সাড়া দিয়েছেন। এখন বাংলাদেশের মানুষকে ‘সঠিক বার্তাটি’ পৌঁছে দিতে’ ভারতেরও উচিৎ ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করা।
পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বরুণ গান্ধীও গত মাসে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেন।
তবে এনডিটিভির টক শোতে বিজয় আবারো বলেছেন, মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের উচিৎ ছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি করার আগে বিরোধী দলের মতামত নেয়া। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ চুক্তির বিষয়ে যে উদ্বেগের কথা বলে আসছেন, তাও কেন্দ্র সরকারের আমলে নেয়া উচিৎ বলে মনে করেন এই বিজেপি নেতা। তবে তৃণমূল সাংসদ স্বাগত রায় এই চুক্তির চরম বিরোধিতা করে এই চুক্তির পক্ষাবলম্বীদের সমালোচনা করেন। এই টক শোতে তিনি দাবি করেন এই চুক্তি হলে ভারত ছিটমহলের ১১ হাজার একর জমি হারাবে। এটা কোনোভাবেই হতে দেয়া যায় না। একই সাথে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনাকে আবারো নির্বাচিত করার জন্যে অনেকে এই চুক্তি করতে চায়, যা ভারতের দায়িত্ব নয়। তার মতে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যে-ই আসুক তাদের সঙ্গেই দর কষাকষির জন্য প্রস্তুত হতে হবে ভারতকে।
কংগ্রেসের মন্ত্রী শশী ঠারুর ও বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি এ চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতে জনমত গড়ে তোলার পক্ষে জোরালো মত দেন। শশী ঠারুর বলেন, “ঢাকা আমাদের বড় বন্ধু। এখন আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি অঙ্গীকার রাখতে না পারলে তা হবে একটি বিপর্যয়। ”
বীণা সিক্রি বলেন, “ অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী। ভারত যদি বিশ্বের কাছে গুরুত্ব আশা করে, তাহলে কোনো দেশের সঙ্গে করা চুক্তি বাস্তবায়নের সামর্থ্য তার থাকা উচিৎ। ” স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম ভূমি হারাবে বলে যে অভিযোগ তৃণমূল ও আসাম গণ পরিষদ করে আসছে, তাও নাকচ করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
শশী ঠারুর ও বীণা সিক্রির সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রবীণ সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক বলেন, পররাষ্ট্রনীতি যদি পাকিস্তানের মতো রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়-সেটা ভয়ংকর বিপর্যয়। ভারতের ভবিষ্যত এর পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে যোগযোগের ওপর অনেকটা জড়িত। আর এ দুটো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে। আর সম্পর্ক উল্টে গেলে ক্ষতিও হবে একই মাত্রার।
তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেন , খালেদা জিয়ারশাসনামলের শুরুতেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বেড়ে যায়। বাংলাদেশে উলফার ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধারসহ বাংলাদেশে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবাধ তৎপরতা ভয়ংকর পর্যায়ে যায়। তারেক জিয়া দুবাইতে দাউদ ইব্রাহিমের সাথে দেখা করেন- জঙ্গী সংগঠকদের সাথে তার সম্পৃক্ততা ভারতীয় গোয়েন্দা তথ্যে উদ্ঘাটন হয়েছে । সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে হাসিনার শাসন প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের জন্যে নিরাপদ। কারণ , শেখ হাসিনা জঙ্গীবাদ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সুবীর ভৌমিক আরো বলেন, “১১ হাজার একর বা কতো জমি-সেটা অতো জরুরি নয়, যতোটা জরুরি এই মুহুর্তে দিল্লির অনুধাবন করা যে, খালেদা চরম সাম্প্রদায়িক শক্তি জামাতের সাথে জোট করেন- যারা জঙ্গীবাদের সাথে যুক্ত। যারা সংখ্যালঘু নির্যাতন করে। ”আলোচনার এই পর্যায়ে বিজেপি নেতা তরুণ বিজয় বলেন, “আমি সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে একমত। ”
আলোচকদের অধিকাংশই চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মত দেয়ায় একপ্রকার কোনঠাসা স্বাগত রায় ‘কূটনৈতিক কৌশলের’ আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, একজন মন্ত্রী হিসাবে শশী ঠারুরের এমন কিছু বলা উচিৎ নয়, যাতে মনে হয় যে দিল্লি ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। জবাবে স্বভাবসুলভ রসিকতার সুরে শশী বলেন, “কার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে মিস্টার রায় এবং তার নেত্রী (মমতা) কি তা নিয়ন্ত্রণ করতে চান? তারা কি ভাবছেন যে, কে আমার বন্ধু আর কে তা নয়- এটা বোঝার মতো বুদ্ধিও আমার নেই?”
এই টক শো দেখে ছিটমহলবাসীর মনে অন্তত আশা জেগে থাকবে যে, তাদের দাবি এবার নীতিনির্ধারকদের নজরে আসবে। উচ্চ আদালত অথবা গণমাধ্যম –-- সকল প্রচেষ্টা সফল করে ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে ভারত সরকার সচেষ্ট হবেটাই এমন আশা করছে ৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’-দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী।
sumikhan29bdj@gmail.com
সম্পাদনা: জেএম/জিসিপি