ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এ কেমন বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন!

কবির পারভেজ নয়ন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৩
এ কেমন বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন!

ঢাকা: প্রতিদিনের মতো রোববারও সূর্য উঠেছিল পূর্ব দিগন্তে। খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠলো ইসতিয়াক আহমেদ (ছদ্মনাম)।



ইসতিয়াকের এই সকালে ঘুম থেকে ওঠার অন্যতম একটা কারণ ছিল পরীক্ষা (টার্ম ফাইনাল)। প্রতিটি পরীক্ষার্থীর জন্যই পরীক্ষার দিনের সকাল থেকে পরীক্ষার শেষ সময় পর্যন্ত সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ সময়ে সে বাইরের কোনো কিছুতে (পরীক্ষার বিষয় ব্যতিরেকে অন্য বিষয়ে) মনোযোগ কিংবা সেটি সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানার কোনো আগ্রহই দেখায় না।

ইসতিয়াকের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। পাঠকের জানার জন্য একটি কথা বলে রাখি, ইসতিয়াক বর্তমানে দেশের স্বনামধন্য একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।

সে জানে না যে, ১ সেপ্টেম্বর (রোববার) তার বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’। আজকের এই দিনেই তার এই বিশ্ববিদ্যালয়টিই এক সময়ের দীর্ঘদিনব্যাপী ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তীব্র আন্দোলনের ফলেই বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি) থেকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে।

ইসতিয়াকের এই না জানা কিংবা উদাসীন থাকার কারণটা যে পরীক্ষা, এটির আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এটি জেনে পাঠকেরা হয়ত-বা অনেকটা অবাকই হবেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের দিনে আবার ক্লাস, পরীক্ষা, প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশন, ল্যাব কীভাবে হয়! বঙ্গদেশে সবই সম্ভব!
 
দেশে বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান নানাবিধ স্মৃতিমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজনের করে থাকে। আর সেই দিনটি যদি হয় অনেক কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত, তাহলে অনেকক্ষেত্রেই সেটি শুধুমাত্র স্মৃতিমূলক অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না থেকে উৎসবে পরিণত হয়।

এই রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল গত ১ সেটেম্বর চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ উদযাপনকে কেন্দ্র করে। এ দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীরই আশা থাকে, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসকে মহাধুমধামে উদযাপন করতে। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই দিনেই যদি ক্লাস, প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশন, ল্যাব কিংবা পরীক্ষা দিয়ে রাখেন, তাহলে অনেক শিক্ষার্থীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত থাকতে হয় এ উৎসব থেকে। আর এই উৎসবের আনন্দটুকু কেড়ে নেওয়াটা শুধুমাত্র অধিকার হরণই নয় বরং এক ধরনের ‘মানবিক অপরাধ’ হিসেবেই গণ্য করা যায়।

পাঠকেরা এই স্বনামধন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়টি রূপান্তরের ইতিকথা শুনলে আরো অবাক হবেন যে, যে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘ আন্দোলন করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করলো, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীই পারছে না এই দিবসটি সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে কিংবা অতীত ইতিহাসকে স্মরণ করতে!

পাঠকের সামনে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির রূপান্তরের কিছু অংশ উপস্থাপন না করলে লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
 
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ- বিআইটি - প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

‘প্রাচ্যের রানী’ নামে খ্যাত বন্দর নগরী চট্টগ্রামে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে ১৯৬২ সালে এক সরকারি আদেশে ‘চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ হিসেবে বর্তমান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) প্রতিষ্ঠিত হয়।

যদিও এর মূল কর্মকাণ্ড শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। তৎকালীন প্রশাসনিক কাঠামো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এবং একাডেমিক কর্মকাণ্ড চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো।

তৎকালীন সময়ে শুরু থেকেই ধারণা করা হয়েছিল যে, এই প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দক্ষ প্রকৌশলী তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রামের শিল্পন্নোয়নকে ত্বরান্বিত করবে, যেখানে দেশের একমাত্র পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র, বৃহত্তর ইপিজেড, তেল শোধনাগার, কাগজকল ইত্যাদি শিল্পকারখানা অবস্থিত।

চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম কাপ্তাই সড়কের ওপর রাঙ্গুনিয়া রাউজান সংযোগস্থলে পাহাড় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের কথা থাকলেও তৎকালীন সময়ে তা করা হয়নি।

এটিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় না করে বরং ১৯৮৬ সালে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (বিআইটি) রূপান্তর করা হয়। আর নামে মাত্র স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটিকে বহাল রাখা হয়। নামে মাত্র স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে তৎকালীন সময়ে বিআইটির সব নিয়ন্ত্রণ ন্যস্ত করা হয়েছিল বোর্ড অব গর্ভনেন্স ও বিআইটি কাউন্সিলের ওপর; যার পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন এমন সব ব্যক্তি, যারা বিআইটির সঙ্গে কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট নন।

এছাড়াও নামে স্বায়ত্তশাসন হলেও এর তৎকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিআইটি ডিরেক্টরের হাতে একজন পিওন নিয়োগের ক্ষমতাও  ছিল না।

এছাড়াও বিআইটিতে রূপান্তরের ফলে তৎকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ও চাকরির ক্ষেত্রে নানাবিধ বৈষ্যম্যের স্বীকার হতে হয়েছিল। কারণ, তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকার সময় এই প্রতিষ্ঠানটির নাম ওয়ার্ল্ড লার্নিং বুকে অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং একটি ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও ছিল।

কিন্তু, তৎকালীন বিআইটি অর্ডিন্যান্সে বিশ্ববিদ্যালয় মানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটির নাম উল্লেখ না থাকায় AUB (Association of University of Bangladesh) তাদের সদস্য বলে গণ্য করতে নারাজ ছিল। এর ফলে, কমনওয়েলথ বুক ইয়ার ও ওয়ার্ল্ড লার্নিং বুক থেকে মুছে যায় এ প্রতিষ্ঠানটির নাম।

আর এভাবেই তৎকালীন সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চ শিক্ষা লাভের পথ বন্ধ হয়ে যায়। দেশে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা চাকরির ক্ষেত্রে বৈষ্যম্যের শিকার হতে থাকেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সৃষ্টি হয়েছিল বিআইটি থেকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের আন্দোলন। গঠিত হয়েছিল ‘চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ’।

তৎকালীন সময়ে এই আন্দোলনটি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এতে সমর্থন দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, আইনজীবী ও সর্বস্তরের জনসাধারণ। আর এর পাশাপাশি তৎকালীন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান, পানি সম্পদমন্ত্রী এলকে সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন, বেসরকারি বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সমর্থন জানান।

পরবর্তীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ২০০২ সালের ১০ মার্চ বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের ৪৬তম সম্মেলনে চট্টগ্রামসহ দেশের চারটি বিআইটিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা দেন।

এ ঘোষণার ফলেই চার বিআইটি- চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) ও ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) উন্নীত হয়।
 
উপরোল্লিখিত আলোচনায় পাঠকেরা হয়ত-বা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। বিআইটি থেকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি দীর্ঘদিন একই সঙ্গে আন্দোলন করতে পারলেন, সেখানে বর্তমান সময়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’-এ কেন সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে করতে পারলো না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন?

এ প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই সবার কাছে চলে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইচ্ছা করলে বিভিন্ন বর্ষের/বিভাগের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সব পরীক্ষা, ল্যাব ও প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশন অন্যদিনে নিলে হয়ত-বা এই ধরনের প্রশ্নের উত্থাপন হতো না!

একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে এই কাজটি করা তেমন একটা কঠিন কিছু ছিল না। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এর প্রতিফলন দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। শিক্ষার্থীদের অসংখ্য অভিযোগগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল- যথাযথ পন্থায় টি-শার্ট, খাবার বিতরণ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীদের এই অভিযোগটি কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, প্রতিবছরই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’-এ এ ধরনের অভিযোগ ওঠে।

অনেকের মুখে শোনা যায়, পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে হিসাব-নিকাশ কিংবা কৌশলগত বিষয়ে ভুল কখনোই আশা করা যায় না। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ সব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।        

কবির পারভেজ নয়ন- প্রাক্তন শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)
E-mail: kabir.cuet@gmail.com ফোন: ০১৭৭৮২৬৩৬৩৫

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৩
এবি/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।