আমার ছয়জন ছাত্রছাত্রী একসাথে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। একজন চাকরি করতে অন্যেরা পি.এইচ.ডি করতে।
যাবার আগে আমার ছাত্রছাত্রীরা সবাইকে নিয়ে বিশাল একটা পার্টি দিয়েছে। আমি আমেরিকায় আঠারো বছর ছিলাম, এর পরেও অনেকবার যেতে হয়েছে। তাই পার্টি শেষে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি যাবার আগে সেই দেশটি নিয়ে কোন বাস্তব উপদেশ শুনতে চাও? যে উপদেশ বইপত্র ইন্টারনেট কোথাও পাবে না? তারা সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে রাজি হলো। আমি তাদেরকে তখন এক ডজন তথ্য এবং উপদেশ দিয়েছিলাম, যেগুলো ছিল এরকম:
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা সহজ কথায় আমেরিকা পুরো পৃথিবীকে দেখে স্বার্থপরের মতো। কিন্তু তারা নিজের দেশের জন্য সাংঘাতিকভাবে নিঃস্বার্থ। (একাত্তরে দেশটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু দেশের মানুষ ছিল আমাদের পক্ষে)। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে যেসব দেশে হানাহানি খুনোখুনি যুদ্ধ বিগ্রহ হচ্ছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সব জায়গায় সূক্ষ্মভাবে হলেও আমেরিকার একটা যোগাযোগ আছে। তবে দেশটি যেহেতু নিজের দেশের মানুষকে ভালোভাবে দেখে শুনে রাখে, তাই থাকার জন্য সেটি চমৎকার একট জায়গা। সারা পৃথিবী থেকে সব দেশের মানুষ সেখানে গিয়ে এটাকে একটা মিনি পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে। এই দেশে কেউই বিদেশি নয়। তাই থাকার জন্য, লেখাপড়া বা গবেষণা করার জন্য আমেরিকার কোনো তুলনা নেই।
২. আমেরিকার সাধারণ মানুষেরা গোমড়ামুখী নয়, তারা খুব হাসিখুশি। পথেঘাটে সুন্দরী মেয়েরা খামোখা মিষ্টি হাসি দিলেই তারা প্রেমে পড়ে গেছে ভাবার কোনো কারণ নেই।
৩) পশ্চিমা দেশের মানুষেরা নাম নিয়ে মোটেও সৃজনশীল নয়। তারা ধরেই নেয় সবার নামের দুটি অংশ থাকবে। প্রথম অংশটা হচ্ছে ঘনিষ্টদের ডাকার জন্যে আর শেষ অংশটা আনুষ্ঠানিক পারিবারিক নাম। পারিবারিক নাম যে নামের প্রথমে থাকতে পারে (শেখ মুজিবর রহমান) সেটা তারা মানে না। খেয়ালী বাবা হলে যে পারিবারিক নাম নাও থাকতে পারে (বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ, মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ছোট ভাই আহসান হাবীব) সেটাও তারা মানে না।
একটু ঘনিষ্টতা হলেই নামের প্রথম অংশ দিয়ে ডাকা শুরু করে বলে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরা আমেরিকা পৌঁছানোর কিছুদিনের ভেতরে আবিষ্কার করে সবাই তাদের মোহাম্মদ বলে ডাকছে। তাই ঘনিষ্টদের কাছে কে কী নামে পরিচিত হতে চায় সেটা একেবারে প্রথম দিনে পরিষ্কার করে খোলাখুলি বলে দেয়া ভালো। আমেরিকায় নামের আগে মোহাম্মদের সংক্ষিপ্ত রূপ MD. লেখা খুবই বিপজ্জনক। তারা সেটাকে ডিগ্রি মনে করে সব সময়ই নামের পেছনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে! (ডাক্তারি)
৪. যখন প্রথম প্রথম কেউ আমেরিকা যায় তখন তাদের স্কলারশিপ বা বেতনের চেক পায় ডলারে। কিন্তু যখন খরচ করতে যায় তারা সেটা ডলারে খরচ করতে পারে না, তারা খরচ করে টাকায়। নিজের অজান্তেই কোনো কিছুর দাম দেখা মাত্র মনে মনে ৮০ দিয়ে গুণ করে ভিমরি খেতে শুরু করে। এক কাপ কফির দাম একশ থেকে তিনশ টাকা, সিনেমার টিকিট আটশ থেকে হাজার টাকা, আইসক্রিম কোন দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা, গানের সিডি প্রায় হাজার টাকা, একটা বই দুই থেকে তিন হাজার টাকা। মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্যে সেখানে কেনাকাটা করা রীতিমত কঠিন একটা ব্যাপার। (তবে বড় লোকের ছানাপোনারা- যারা এই দেশে বনানী-গুলশানের হাইফাই দোকানপাট রেস্টুরেন্টে ঘোরাফেরা কিংবা খানাপিনা করে অভ্যস্ত তাদের জন্য ব্যাপারটা সহজ। এই দেশে তারা মোটামুটি আমেরিকান দামেই কেনাকাটা বা খানাপিনা করে। ) কাজেই, অন্য সবার প্রথম কাজ হচ্ছে কোনো কিছু কেনার আগে আশি দিয়ে গুণ করে ফেলার অভ্যাসটুকু ঝেড়ে ফেলা।
আমেরিকায় কেনাকাটার আরেকটা বিষয় ‘টিপস’ এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে বখশিশ। কিন্তু বখশিশ শব্দটার মাঝে তাচ্ছিল্য এবং অবমাননার ছাপ রয়েছে।
টিপস শব্দটিতে তাচ্ছিল্য কিংবা অবমাননা নেই। আমেরিকার (মূলধারায়) প্রায় সব তরুণ-তরুণী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করে বড় হয়েছে। তখন তাদের বেতন বলতে গেলে ছিলই না এবং খদ্দেরদের টিপসটাই ছিল তাদের বেতন। সে দেশের রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, নাপিত বা ক্যাব ড্রাইভারকে টিপস দিতে হয়। হতচ্ছাড়া কিপটে মানুষদের হাত গলে ১০% টিপসও বের হতে চায়না, দরাজদিল মানুষেরা দেয় ২০% আর মাঝামাঝি পরিমাণ ১৫%!
কাজেই বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিয়ে কোথাও খেতে গেলে মেন্যুতে খাবারের দামটা দেখে আগে থেকেই তার সাথে ১৫% থেকে ২০% যোগ করে রাখা জরুরি।
৫. আমরা হাত দিয়ে ডাল-ভাত, সবজি, মাছ, মাংস মাখিয়ে মাখিয়ে খাই। আমেরিকা গিয়েও বাসার ভেতরে নিজে রান্না করে সবকিছু হাত দিয়ে খাওয়া যাবে। বাইরে হ্যামবার্গার, স্যান্ডউইচ কিংবা পিৎজা (উচ্চারণটা পিজ্জা নয়, পিৎজা) হাত দিয়ে খেতে পারলেও বেশিরভাগ খাবার ছুরি-কাটা ব্যবহার করে খেতে হবে। আমাদের এই অঞ্চলে খাবার জন্যে চামচ দেয়া হয়। ইউরোপ আমেরিকায় কিন্তু ডাইনিং টেবিলে চামচ নেই। শুধু ছুরি আর কাটা। কোন হাতে ছুরি কোন হাতে কাটা ধরতে হয় সেরকম নানা ধরনের নিয়ম কানুন রয়েছে। সেই নিয়ম আবার ইউরোপে একরকম আমেরিকায় অন্যরকম। কিন্তু মূল বিষয়টা খুব সহজ। বেশিরভাগ মানুষ ডান হাতে কাজ করে এবং কাটাকাটি করতে একটু জোর
লাগে। তাই ছুরিটা থাকবে ডান হাতে (এবং খাওয়া ভঙ্গিমাতে সেটা কখনো মুখে ঢোকানো যাবে না, প্রয়োজনে আমি ডাইনিং টেবিলে একে অন্যের ছুরি ব্যবহার করতে দেখেছি)। এটাই নিয়ম।
আমেরিকাতে কাটার জন্যে কোন নিয়ম নেই। যারা ডান হাতে কাজ করে অভ্যস্ত তারা ছুরি দিয়ে কাটাকাটি শেষ করে প্লেটে ছুরিটা রেখে ডান হাতে কাটাটা তুলে নিয়ে খায়। শুনেছি বিশুদ্ধ অ্যারিস্ট্রোকেট (বাংলা প্রতিশব্দ অ্যারিস্টোক্রেসি পুরোটা ফুটে ওঠে না, তাই আসল শব্দটিই ব্যবহার করতে হলো)। মানুষ মরে গেলেও ডান হাতে খাবার তোলে না। এই নিয়মগুলো কে করেছে এবং কেন এই নিয়মেই খেতে হবে, অন্য নিয়মে কেন খাওয়া যাবে না, আমি তার উত্তর জানি না। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, অনেক আমেরিকানরা চপ স্টিক (দুই টুকরো কাঠি) দিয়ে খেতে পারে। আমার ধারণা, একবার চপস্টিক দিয়ে খেতে শিখে গেলে, থাওয়ার জন্য এটা খুব চমৎকার একটা পদ্ধতি।
আমার কিছু আমেরিকান বন্ধু আমার দেখাদেখি হাতে খেতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা আঙ্গুল দিয়ে খাবার মাখিয়ে মুখ পর্যন্ত নিয়ে গেলেও মুখে সেই খাবার ঢোকাতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। পাঁচটা আঙ্গুল মুখের ভিতর ঢুকিয়ে সেখানে খাবারটা ছেড়ে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে কাজটা মোটামুটি অসম্ভব। যারা আগে কখনো লক্ষ্য করেনি তাদেরকে বলে দেয়া যায়, আমরা কিন্তু মুখের ভেতর আঙুল ঢোকাই না, বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠেলে খাবারটা মুখে ঢুকিয়ে দেই, অত্যন্ত দক্ষ একটা পদ্ধতি।
খাবারের কথাটি বলতে হলেই পানীয়ের ব্যাপারটা তার সাথে চলে আসে। আমেরিকায় ট্যাপের পানি বিশুদ্ধ, তাই পানি কিনে খাবার প্রয়োজন নেই। শুনেছি নিউ ইয়র্কের মানুষ মোটা হয়ে যাচ্ছে বলে বিশাল আকারের সফট ড্রিংক বেআইনি করে দেয়া হয়েছে। তবে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় (সোজা কথায় মদ) নিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করা যায়। যারা এটা খেতে চায় না আমেরিকানরা কখনোই সেটা খেতে জোরাজুরি করবে না। তবে মদ খাওয়া বাঙালিদের কথা আলাদা। তারা নিজেরা সেটা খায় বলে অন্যদের খাওয়ানোর জন্যে বাড়াবাড়ি ব্যস্ত থাকে। বাঙালিদের আসরে তারা অন্য বাঙালিদের জোর করে, তাদের চাপ দেয় এবং না খেলে তাকে নিয়ে টিটকারি ঠাট্টা তামাশা করে। এর কারণটা কী আমি এখনো বের করতে পারিনি।
৭. খাবার এবং পানীয়ের কথা বলা হলেই এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে টয়লেটের কথা বলা উচিৎ। লোকচক্ষুর আড়ালে এর খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু ছাপার অক্ষরে কিছু লিখে ফেলাটা শোভন হবে না। এই ভয়ঙ্কর বিয়ষটা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে, আমরা যেভাবে শিখেছি।
৮. ডাইনিং টেবিল আর টয়লেটের পর নিশ্চয়ই বাথরুমের ব্যাপারটা আসার কথা। নিজের বাসায় নিরিবিলি বাথরুমের মাঝে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমেরিকার গণবাথরুমের মতো ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
আমাকে আগে থেকে কেউ সতর্ক করে দেয়নি। তাই প্রথমবার যখন আমার ডর্মিটরির গণবাথরুমে একজন আমার সামনে জামা কাপড় খুলে পুরোপুরি ন্যাংটো হয়ে গিয়েছিলো সেই আতঙ্কের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না! এরপর অনেকদিন পার হয়েছে। আমি অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হয়েছি কিন্তু গণবাথরুমে উদাস মুখে শরীরে একটা সুতা ছাড়া সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই দৃশ্যে আমি কোনোদিন অভ্যস্ত হতে পারিনি। এই জন্মে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
ছেলেরা ছেলেদের সামনে এবং মেয়েরা মেয়েদের সামনে জামা কাপড় পুরোপুরি খুলে ফেলতে কোনো লজ্জা অনুভব করে না, এই ব্যাপারটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে আমি কোনোদিন বুঝতে পারব না।
৯. আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে পোশাকের ব্যাপারটা সবচেয়ে সহজ। সেটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। যার যা খুশি পরতে পারে। তাই যে যেটা পরে আরাম পায় সেটাই পরে। টি-শার্ট আর জিন্স পরে পুরো জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। (হাওয়াইয়ে আমার পরিচিত একজন বাংলাদেশের অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে গ্রীষ্মকালে ক্লাশ নেয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ ছাত্রীরা বিকিনি পরে ক্লাশে চলে আসে। তবে হাওয়াইয়ের কথা আলাদা। মূল ভূখণ্ডে এত বাড়াবাড়ি নেই!) একজন সহকর্মী হঠাৎ কার মরে যাওয়ার পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যাওয়ার সময় স্যুট পরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো সময় আমার স্যুট টাই পরার সুযোগ হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না!
আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হয় সেরকম জায়গা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে সেরকম জায়গায় খুব বেশি যেতে হয়নি। (কী আনন্দের কথা, দেশে ফেরার পর বাকি আঠারো বছরেও আমার সেরকম জায়গায় যেতে হচ্ছে না!)
১০. আমাদের দেশে পান খাওয়ার একটি ব্যাপার আছে। তার সাথে জড়িত আছে পানের পিক, পান চিবুতে চিবুতে এদিক সেদিক পিচিক করে পানের পিক ফেলাটা প্রায় কালচারের অংশ হয়ে গেছে। (কেউ কী আমাদের সদর হাসপাতালগুলোর দেওয়ালের কোণাগুলো দেখেছে? মনে হয় সেগুলো তৈরিই হয়েছে পানের পিক ফেলার জন্যে!) শুধু পানের পিক নয় চিপসের প্যাকেট, ঠোঙা, পানির খালি বোতল, চুইংগামের কাগজ, সিগারেটের গোড়া- যেখানে সেখানে ছুড়ে ফেলে দেওয়াটা এখানে কেউ অন্যায় কিছু মনে করে না।
বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে যাবার জন্য প্লেনে ওঠার আগে এই অভ্যাসগুলো বাক্সবন্দি করে দেশে রেখে যেতে হয়। আমেরিকার কোনো রাস্তায় অন্যমনস্কভাবে একটা ঠোঙা ছুড়ে ফেলার পর যদি কোনো থুরথুরে বুড়ি সেটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠিক জায়গায় ফেলতে বলে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। (দোহাই লাগে এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হলে কেউ যেন নিজের দেশের পরিচয় দিয়ে দেশের বেইজ্জতি না করে। )
দেশের বাইরে গেলে শারীরিক কিছু ব্যাপার স্যাপারেও একটু সতর্ক থাকা ভালো। ভালোমন্দ কিছু খেলে খাবার শেষে একটা বড়সড়ো ঢেকুর তোলাটা আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। (আমি শুনেছি কোনো কোনো কালচারে খাওয়া শেষে অতিথিরা ঢেকুর না তুললে সেটাকে অপমান হিসেবে ধরা হয়) পশ্চিমা দেশে প্রকাশ্য জায়গায় ঢেকুর তোলাটা বন্ধ রাখতে হবে। তবে হাঁচি, কাশি, ঢেকুর, এ রকম গর্হিত ব্যাপার যদি ঘটেই যায় তাহলে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ক্ষমা চাইলে সবাই সেই অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এই সাথে আরেকটা বাক্যাংশ শিখে নেওয়া ভালো- সেটা হচ্ছে ‘থ্যাংক ইউ’। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আমরা যদি কারও প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা অনুভব করি তারপরও সেটা মুখ ফুটে বলি না। আমেরিকা গেলে এটা মুখ ফুটে বলা শিখে নিতে হবে। বাক্যাংশটি চমৎকার, যে বলে এবং যাকে বলে দু’জনেই এটা থেকে আনন্দ পেতে পারে।
১১. আমেরিকাতে তরুণ তরুণীরা (এবং বুড়ো-বুড়িরাও) তাদের ভালোবাসা যথেষ্ট খোলামেলাভাবে প্রকাশ করে। দু’জন তরুণ তরুণী হাত ধরাধরি করে কিংবা জড়াজড়ি করে হাঁটছে- এটা খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য। কিন্তু দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে এটা মোটেও পরিচিত দৃশ্য নয়। দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হতে পারে কিন্তু কখনোই তারা একে অন্যের হাত ধরে হাঁটবে না কারণ তাহলে অন্যেরা সেটাকে বিশেষ এক ধরনের সম্পর্ক হিসেবে ধরে নেবে! (কোনো লেখায় আমার নাম থাকলে বাচ্চা কাচ্চারা পড়ে বলে খবর পেয়েছি। তাই এই বিষয়টিকে আর বিস্তৃত করা গেলো না!)
১২. আমার এক ডজন তথ্য এবং উপদেশের শেষটিতে চলে এসেছি। আসলে এখানে যে কথাটি বলতে চেয়েছি সেটা বলার জন্য ওপরের কথাগুলো একটি ভণিতা মাত্র! উপরের ভূমিকাটি শেষ করে এবার আমি আসল কথাটিতে চলে আসতে পারি।
আমাদের দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেগুলোতে সত্যিকার অর্থে গবেষণা শুরু হয়নি (শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য সরকার যে পরিমাণ টাকা খরচ করে সেটা একটা কৌতুকের মতো)। তাই এই দেশের উৎসাহী ছেলে-মেয়েরা প্রতিবছর বাইরে পি.এইচ.ডি. করতে যায়। এদের অনেকে এতো উৎসাহী, এতো সৃজনশীল যে তাদের একটা ছোট অংশ দেশে ফিরে আসতো তাহলে দেশে মোটামুটি একটা বিপ্লব ঘটে যেতো। কিন্তু তারা আসলে দেশে ফিরে আসে না।
আমি আশায় আশায় থাকি যে কোনোদিন এই দেশেরে সরকার একটি দু’টি ছোট বিষয় নিয়মের মাঝে নিয়ে আসবে এবং আমাদের এই উদ্যমী সোনার টুকরো ছেলে মেয়েরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করবে। যতদিন তারা দেশে ফিরে না আসছে আমার খুব ইচ্ছে তারা অন্তত এই দেশটির কথা তাদের বুকের ভেতরে লালন করুক। এর বেশি আমার কিছু চাইবার নেই।
আমাদের দেশে থেকে যারা লেখাপড়া করতে বিদেশ গিয়ে সেখানে থেকে যায় তাদের আসলে মোটামুটি দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগ কখনো ভুলতে পারেনা যে তারা এই দরিদ্র দেশটির মূল্যবান সম্পদ ব্যবহার করে লেখাপড়া করেছে, প্রতিদানে তারা দেশেকে কিছু দেয়নি। দরিদ্র দেশে প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া শিক্ষাটুকু ব্যবহার করে আমেরিকা (বা সেরকম কোনো একটা দেশ) কে সেবা করে যাচ্ছে। সে জন্য তাদের ভেতর একটা অপরাধবোধ কাজ করে। তারা সবসময়ই দেশের ঋণটুকু শোধ করার জন্য নানাভাবে কাজ করে।
আরেকভাগ মানুষ এই অপরাধবোধ থেকে বের হবার জন্যে অন্তত বিচিত্র একটা উপায় খুঁজে বের করেছে, সেটা হচ্ছে সবকিছুর জন্যে নিজের দেশটিকে দায়ী করা। তারা প্রতি মুহূর্তে দেশকে গালাগালি দেয়। তারা বড় গলায় সবাইকে জানিয়ে দেয়- এই পোড়া দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণার সুযোগ নেই। তাদের মেধা কিংবা প্রতিভা ব্যবহারের সুযোগ নেই। এই দেশে জন্ম হওয়াটাই অনেক বড় ভুল হয়েছিল। এখন আমেরিকাতে আসন গেঁড়ে সেই ভুল সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিজের দেশটিকে কীভাবে রসাতলে যাচ্ছে তার সমস্ত পরিসখ্যান তাদের নখদর্পে। দেশের অবিবেচক মানুষ.....
কীভাবে রাজনীতি করে, হরতাল দিয়ে, সন্ত্রাস করে, দুর্নীতি করে পুরো দেশটাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে সেটা তারা শুধু নিজেদের মাঝে নয়, বাইরের সবার সাথেও আলোচনা করে সময় কাটায়।
আমার যে ছাত্রছাত্রীরা আমেরিকা লেখাপড়া করতে যাচ্ছে তাদের এই স্বার্থপর অঙ্ক থেকে সতর্ক থাকতে বলেছি। সম্ভব হলে একশ হাত দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছি। পৃথিবীতে যত রকম অনুভূতি আছে তার মাঝে সবচেযে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে ভালোবাসা। আর পৃথিবীতে যা কিছু ভালোবাসা সম্ভব তার মাঝে সবচেয়ে সেরা জিনিসটি হচ্ছে মাতৃভূমি।
মাতৃভূমিটি যখন সবকিছুতে আদর্শ হয়ে উঠবে শুধু তখন তাকে ভালোবাসব। যখন সেটা দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণায় জর্জরিত হবে, তখন তাকে ভালোবাসবো না, সেটা তো হতে পারে না। যেসব হতভাগারা নিজের দেশকে ভালোবাসার সেই মধুর অনুভূতি কখনো অনুভব করেন, আমি আজকাল তাদের জন্য করুণাও অনুভব করি না।
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করতে গিয়েচিলাম তখন আমি ছিলাম সেখানকার একমাত্র বাংলাদেশি (দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে যে ছাত্রীটি এসেছিল ঝটপট তাকেই আমি বিয়ে করে ফেলেছিলাম!) এখন সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকার যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক বাঙালি আছে-খাঁটি বাংলাদেশের বাঙালি।
মাতৃভূমি ছেড়ে প্রবাসী হবার পর বাংলাদেশের সেই মানুষগুলোই হয়ে ওঠে পরিবারের মানুষ, হয়ে ওঠে আপনজন। সুখে দুঃখে তারা পাশে থাকে। যখন দেশকে তীব্রভাবে মনে পড়ে তখন এই দেশের মানুষগুলোই তাদের সান্ত্বনা দেয়।
তখন কিন্তু একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সুখে দুঃখে সার্বক্ষণিকভাবে শুধু বাংলাদেশের মানুষকে নিয়েই সময় কাটাবে নাকি পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন কালচারের মানুষগুলোর সাথেও একটা আন্তরিক সম্পর্ক করে তুলবে? যারা শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালিদের সাথেই গল্পগুজব আড্ডা রাজনীতি কিংবা অনেক সময় দলাদলি করে সময় কাটায়, তারা কিন্তু অনেক বিশাল একটা ক্যানভাসে নিজের জীবনটাকে বিস্তৃত করার একটা চমৎকার সুযোগ হারায়।
একটা দেশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে একটা পৃথিবীর মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ কিন্তু অনেক বড় সুযোগ। কেউ যখন প্রথমবার আবিষ্কার করে গায়ের রং, মুখের ভাষা, ধর্ম কালচার, সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও সবাই যে হুবহু একই রকম মানুষ সেটি অসাধারণ একটি অনুভূতি।
কাজেই আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের বারবার বলেছি, তারা যেন নিজের দেশের মানুষের পাশাপাশি আমেরিকার মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করে, সম্পর্ক গড়ে তোলে। ভিন্ন কালচারের বৈচিত্র্যের সৌন্দর্যটা যেন উপভোগ করে। তারা যেন হাইকিং করে, জগিং করে, ক্যাশিং করে, হাজার হাজার মাইল ড্রাইভ করে ঘুরে বেড়ায়, গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে বনেট খুলে ঠিক করে ফেলতে শেখে, তারা যেন তুষারে ঢাকা পাহাড়ে ওঠে, সমুদ্রের নিচে স্কুবা ডাইভিং করে, ছবি আঁকতে শেখে, গান গাইতে শেখে, মিউজিয়ামে যায়, অপেরা দেখে, কনসার্টে যায়— এক কথায় যে বৈচিত্র্যময় কাজগুলো কখনো করার সুযোগ পায়নি, সেইগুলো করে জীবনটাকে উপভোগ করে। (কেউ কি বিশ্বাস করবে আমার মতো একজন মানুষ পর্বতারোহণের ট্রেনিং নিয়ে সাইস এক্স আর ক্লাইসিং রোপ হাতে তুষারে ঢাকা পাহাড়ে উঠে বরফের ওপর ক্যাম্প করে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়েছি? পর্বতের চূড়ায় উঠে উল্লসিত হয়েছি?)
কোনো কিছু থেকে কি সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে? আগে ছিল না, এখন আছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র কাজী নাফিসের ঘটনাটি হচ্ছে তার উদাহরণ। এই দেশের যুদ্ধাপরাধীদের চ্যালা-চামুণ্ডারা সেই দেশে আজকাল খুব সক্রিয়। আমেরিকার সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে তারা শুধু নিজেরা থাকে না, তাদের আগে পেছনের কয়েক প্রজন্মকে সেই দেশে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু দেশটিকে তারা মনে করে কাফিরদের দেশ। ভিন্ন ধর্মের জন্য অবজ্ঞা দেখিয়ে যখন কেউ কাফিরদের দেশে থাকার কলাকৌশল শেখাতে এগিয়ে আসবে তাদের থেকে সাবধান!
ভিন্ন ধর্ম আর ভিন্ন কালচার মানে খারাপ ধর্ম আর খারাপ কালচার নয়। ভিন্ন মানে বৈচিত্র্য, আর বৈচিত্র্য হচ্ছে সৌন্দর্য। এটা যত তাড়াতাড়ি জানা যায়, ততই ভালো। যারা জানে না তারা নতুন পৃথিবীর মানুষ নয়, তাদের থেকে সাবধান!
আর সেই দেশে দীর্ঘদিন থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনকে উপভোগ করে কখনো যদি দেশের জন্য বুক টনটন করে তখন কী করতে হবে?
তখন তারা আবার এই দেশটাতে ফিরে আসতে পারবে। মা যেমন করে সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে, দেশ মাতৃকাও ঠিক সেরকম করে তার সন্তানের জন্য গভীর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। অপেক্ষা করে আছে। আমি বাড়িয়ে বলছি না— আমি এটা জানি।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক, কলামিস্ট, অধ্যাপক
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৩
এএ/জিসিপি