এ মাসের ১২ তারিখ বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজিব ওয়াজেদ জয় সবাইকে জানিয়ে দিলেন, তিনদিন পর সমগ্র দেশবাসী `চমক’ দেখতে পাবেন।
বলাবাহুল্য, নির্বাচন নিয়ে দোদুল্যমান জনগণ আমেরিকাবাসী জয়ের চমক দেখার আশায় নড়েচড়ে বসেছেন।
সমস্যাসঙ্কুল এই দেশে তিনদিনে কি করা সম্ভব হতে পারে, তিনদিনের মধ্যে কি এমন চমক আসতে পারে, সেই চমকে আমরা জনগণ কতখানি চমকিত হতে পারি তা নিয়েই চলছে জল্পনা-কল্পনা। তীর্থের কাকের মতই সবাই চেয়ে আছে জয়ের চমকের আশায়। তিনি কি করছেন, কি বলছেন, কোথায় যাচ্ছেন, সবকিছুই সবাই লক্ষ্য করছে, আর আশায় আছে এই বুঝি চমক দেখতে পারব।
তিনি বলেছিলেন যে, সাধারণ মানুষ চমক পছন্দ করে। তাই তিনি চমক দেখাবেন তিনদিন পর। আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত ইংরেজি শব্দ ‘সারপ্রাইজ’ বাংলায় এসে ‘চমক’ হয়ে গেছে। আমেরিকানরা কথায় কথায় সারপ্রাইজ পছন্দ করলেও আমরা সাধারণেরা যে চমক পছন্দ করি এটা ধারণা করে নেবার কোনো কারণ নেই।
কারণ, পছন্দ-অপছন্দ করা-না করা নির্ভর করে চমকের ধরনের উপর। এখন যদি তিনি চমক দেখানোর কথা বলে দুম করে বলে বসেন নির্বাচন হবে না- তবে সাধারণ জনগণ নিশ্চয় এই চমক পছন্দ করবেন না।
কিন্তু ঘোষিত তিনদিন তো পার হয়ে গেল। অনেকের মতই ভাবছি কোথায় সেই চমক? কি সেই চমক?
চমক দেখার আশায় যখন বসে আছি তখনি সব আশায় পানি ঢেলে দিয়ে ১৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে জয় দুম করেই বলে বসলেন যে, তিনি আসলে চমকের কথা কিছু বলেন নাই। তিনি তিনদিন পর কিছু একটা দেখাব বলেছেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময়কে তিনি ‘চমক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
চট্টগ্রামের তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময়কে কেন তিনি চমক বললেন সেটা তেমন একটা বোধগম্য নয়। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, চট্টগ্রামের তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময় ছাড়াও কথাবার্তা ও কাজে জয় এরই মধ্যেই বড় বড় চমক দিয়ে সাধারণ জনগণের পিলে চমকে দিয়েছেন।
জয়ের তিনদিনের কার্যক্রম লক্ষ্য করলেই অনেক চমক পাওয়া যায়। যেমন, জয়ের মাতা প্রধানমন্ত্রী যেখানে ‘প্রার্থী নয় নৌকা দেখে ভোট দিতে বলেন’, সেখানে জয় ‘মার্কা নয়, যোগ্য নেতৃত্বের’ কথা বলেন। জয়ের এই সদুপদেশ কিন্তু নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অনেক বড় চমক। প্রচলিত দলীয়করণের বাইরে গিয়ে তিনি যোগ্যতা দেখে ভোট দেবার জন্য এমনতর আহবান জানিয়েছেন। এটা চমক ছাড়া আর কি-বা হতে পারে।
আবার বিরোধীদের মিথ্যাচার (!) রুখতে দলীয় নেতা-কর্মীদের শুক্রবার মসজিদে যাওয়ার পরামর্শ তিনি দিয়েছেন। জু’মার দিনে নামাজ পড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে, নাকি বিরোধীদের মিথ্যা প্রচারণার জবাব দিতে মসজিদে যাওয়া দরকার এই নতুন নির্দেশনাই কি বড় চমক নয়?
৩০০ প্রার্থীর জন্য ৩০০ ফেসবুক পেজ দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর কথা বলাও তো একটি বড় চমক, তাই নয় কি? এখন সেসব প্রার্থীর অনেকেরই এবং সেই সঙ্গে সাধারণ জনগণের আদৌ ফেসবুক নিয়ে কোনো ধারণা আছে কি নেই সে নিয়ে জয়ের যে তেমন ধারণা নেই, সেটা জানাও তো আমাদের জনগণের জন্য বড় ধরনের একটি চমক। তাই না?
তবে, জয়ের তৃণমূলযাত্রা যে সবার জন্য বড় চমক সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই যে রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে তিনি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দেবার আশা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, জঙ্গিবাদ থেকে দেশকে দূরে রাখার জন্য বিরোধীদের ভোট দিতে মানা করছেন, নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার কাজ করছেন, এসবও আমাদের জন্য বড় চমক নয় কি?
তাঁর ভাষায় ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’ সমাপ্ত করার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেছেন। চট্টগ্রামের তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে সেই চমকের যাত্রা শুরু হলো বলে জয় মন্তব্য করেছেন।
আমরাও তাই শেষ নয়, জয়ের চমকের শুরু দেখতে চাই। দেখতে চাই দেশের মানুষের জন্য জয়ের দেশপ্রেম। দেখতে চাই দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জয় কিভাবে অসমাপ্ত বিপ্লবকে সমাপ্তির পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। দেখতে চাই সুদূর আমেরিকা থেকে নয়, দেশে থেকেই জয় গড়ে তুলছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর থেকে বড় চমক আর কি-বা হতে পারে? তাই না?
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, জয়ের চমকের দৌড় কি ভোটের মওসুম পর্যন্ত? অতিথি পাখির মত ভোটের বাজারে ভোট চেয়েই কি তিনি ফের যুক্তরাষ্ট্রে উড়াল দেবেন? ক’দিনের জন্য দেশে এসে চমক দেখানোর শুরুর কথা বলে তিনি কি আমেরিকা উড়াল দিয়ে সবাইকে চমকের শেষ দেখিয়ে দেবেন? ‘চমকের শেষ নাকি শুরু?’ প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।
জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩/১৩৩৫ ঘণ্টা
জেডএম/জেসিকে/জিসিপি