৬২’র শিক্ষা আন্দোলনকে স্মরণে রেখে প্রতি বছর ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালিত হয়। অন্যান্য বছরগুলোর মতো এবারো খুব ছোট করে কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগ-আয়োজনে শেষ হয়ে যাবে দিনটি।
কারণ এখন আর সর্বস্তরের মানুষের কাছে চাঁদা পাওয়া যায় না। যেসব রাজনৈতিক দল বা সংগঠন এসব ছাত্রসংগঠনকে নানাভাবে সহযোগিতা সমর্থন দিয়ে আসছে, তাদের অবস্থাটাও ভালো না। ফলে নিরাশা বাড়ছে শিক্ষার অধিকার আদায়ে নিবেদিত ছাত্র সংগঠনগুলোর।
এবারের শিক্ষা দিবসেও হাইকোর্ট মাজার এলাকায় শিক্ষা অধিকার চত্বরে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে শিক্ষার সংগ্রামে নিহতদের স্মরণ করেছে এসব ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব শহীদদের নাম ক’জন মনে রেখেছে? বিগত আড়াই দশকে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মদদপুষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্য ধরে রাখা, নিজেদের মধ্যে কোন্দল, টেন্ডারবাজিসহ নানা কারণে অস্ত্র এবং পেশীশক্তির প্রদর্শন ক্রমেই বেড়েছে। আর তার ফলে ক্যাম্পাসে প্রাণ দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। কলুষিত হয়েছে ছাত্র রাজনীতির নাম। শিক্ষার্থীরা ঘৃণা করতে শুরু করেছে ছাত্র রাজনীতিকে। তবুও আবার কেউ বাধ্য হয়ে অথবা অনেকে আধিপত্য, সুবিধা আর স্বার্থের কারণে অস্ত্রবাজ, আদর্শহীন, লেজুড়বৃত্তির ছাত্র সংগঠনের মিছিলে স্লোগান তুলছে। দৃশ্যমান হচ্ছে শিক্ষার সংগ্রামে অবিরাম লড়াকু ছাত্র সংগঠনগুলোর ক্ষয়িষ্ণু ধারা।
সবচেয়ে ভাবনার বিষয় হলো, সার্বজনীন শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে ছাত্রদের সংগঠিত করে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা না গেলেও, শিক্ষা নিয়ে জমজমাট ব্যবসাদার সংগঠন ফুলেফেঁপে উঠছে কম সময়ের মধ্যে।
এখন শিক্ষা নিয়ে বহু এনজিও কাজ করছে। বিদেশি ডোনেশন আনছে, তা দিয়ে প্রকল্পভিত্তিক নানা কাজ করছে। কিন্তু শতশত ডলার অথবা পাউন্ডে পাওয়া ডোনারদের অর্থায়নে এসব এনজিও শিক্ষার মৌলিক সংকটগুলো নিয়ে কতোটা কাজ করছে বা করতে পেরেছে সেটি কি কেউ খতিয়ে দেখেছে?
আরো অবাক হতে হয়, যখন রাষ্ট্রীয় যে কোন নীতিনির্ধারণের সময় বিভিন্ন এনজিওবাজদের মতামত, অভিমত নেয়া হয় গুরুত্বের সঙ্গে।
এনজিওবাজেরা জানেন, শিক্ষার মৌলিক সংকট দূর হয়ে গেলে তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে যাবে। তাই পলিসি মেকিং এর ক্ষেত্রে তাদের সুপারিশগুলো কখনোই গভীর এবং মৌলিক হয় না।
আমাদের শিক্ষার মৌলিক সংকটটি হলো বৈষম্য। এখানে অন্যান্য আর সব পণ্যের মতো শিক্ষাকেও বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। যা একটি জাতিকে চিরকাল পঙ্গু রাখার জন্য, একটি রাষ্ট্রকে পরনির্ভর রাখার জন্য যথেষ্ট। অথচ এই সত্যটাকে আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা কেউ মন থেকে একটি বারের জন্যও ভাবছেন না। যার টাকা আছে সে ভালো শিক্ষা কিনবে আর যার টাকা নেই সে ভালো শিক্ষা কিনবে না- এই নীতির বাইরে বের হতে পারিনি আমরা।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর মধ্য দিয়েও এর কোন প্রতিকার ঘটেনি। ফলে শিক্ষার মধ্য দিয়ে অর্ধশিক্ষিত, অপ্রশিক্ষিত, অযোগ্য মানুষ তৈরি করছি আমরা বছরের পর বছর। আর যারা টাকা দিয়ে ভালো শিক্ষা কিনতে পারছে তারা আবার শিক্ষা শেষে সেই টাকা তুলে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শুনেছি, শিক্ষায় অর্থায়ন সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। এই সত্য কথাটি যতোটা জোরের সঙ্গে তিনি বলেছেন, ততোটা গভীরতার সঙ্গে তিনি অনুভব করতে পারেননি। পারলে শিক্ষার বেসরকারিকরণের ভয়াবহ রূপ দেখা যেতো না, শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় অর্থায়ন এবং বাজেটে বরাদ্দের চিত্রটা এতো হতাশাজনক হতো না। শিক্ষা বাণিজ্যের একটি পথও বন্ধ হয়নি। বরং কোচিং ব্যবসা ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লেখাপড়ার চেয়ে যেনো ছাত্রছাত্রী-অভিভাবকদের কাছে কোচিং অনেক প্রিয়! চল্লিশ বছরের শিক্ষাব্যবস্থা এই ধরনের মানুষই তো তৈরি করেছে। আর কি কোন উদাহরণ দরকার আছে?
বহু ধারায় বিভক্ত শিক্ষা শিশুর বেড়ে ওঠার মধ্যে সৃষ্টি করছে বৈষম্যের মনন। কেউ মাদ্রাসার শিক্ষা নিয়ে আসছে আবার কেউ আসছে ইংলিশ মিডিয়াম থেকে। জাতির মনন গড়ে উঠবে কীভাবে? সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য, অথনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং পরিকল্পনা কে করবে? কারা করবে? আমার দেশের শিক্ষিত সন্তানেরা কি পারছেন নীতিনির্ধারণে কার্যকর কৌশল এবং মেধা প্রয়োগ করতে? নাকি, বহু ধারায় বিভক্ত শিক্ষার মধ্য দিয়ে আসা বিভক্ত চিন্তা এবং মানসিকতার কারণে কোন পরিকল্পনাই লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারছে না জাতিকে! আর বারবার আমরা ধরে নিচ্ছি, বাঙালির মেধা নেই, যোগ্যতা নেই। ভিনদেশি জ্ঞানদাতারা, পলিসিমেকাররাই সব দেবতুল্য, উন্নয়নের দূত!
এই সরকারের মেয়াদ শেষ। শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবার কথা মুখে বললেও মৌলিক জায়গাগুলোতে কাজ কতোটা হয়েছে তা সহজেই ধরা যায়। বিনামূল্যে বই বিতরণ, ভর্তি বাণিজ্য বন্ধ, শিক্ষকদের বেতনভাতা বাড়ানোসহ কিছু বিষয় প্রশংসা কুড়ালেও বাণিজ্যিকীকরণ, বেসরকারিকরণ বন্ধ হয়নি। বাড়েনি শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ।
ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা যে মৌলিক জায়গাগুলোতে হাত দিতে পারবেন, বা দেবেন সেটা বলা যাচ্ছে না। তবে, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের জায়গা থেকে যদি শিক্ষার সাংবিধানিক যে অধিকার তা প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়া না হয় তাহলে সারাজীবন খুঁড়িয়ে চলবে এই দেশ। আজীবন পরনির্ভর হয়ে থাকতে হবে। আর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রত যে ছাত্র সংগঠনগুলোর কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, ধীরে ধীরে তাদের আর খুঁজে পাওয়া না গেলেও দাবিগুলো কিন্তু বিলীন হবে না। বৈষম্যহীন, একই ধারার, বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, জীবনমুখী শিক্ষা সবার জন্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব যতোক্ষণ না রাষ্ট্র গ্রহণ করবে, ততক্ষণ উন্নয়ন-অগ্রগতির সব প্রচেষ্টাতেই রয়ে যাবে ফাঁকি। শিক্ষা দিবসের ৫১ বছরে না হোক, কোনা না কোন দিন আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকেরা অবশ্যই অনুধাবন করবেন- সেটাই প্রত্যাশা।
সঞ্জীব রায়: রিপোর্টার, সময় টেলিভিশন, royratan.sanjib@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি