ঢাকা, বুধবার, ১০ পৌষ ১৪৩১, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ বিজয়

অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩
দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্যপূর্ণ বিজয়

সোমবার রাতে টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে চলমান লেখাটা পড়লাম। মঙ্গলবার কাদের মোল্লার আপিলের রায় হবে।

ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করলাম, রায় দেওয়ার সময় উপস্থিত থাকার। বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৫ সদস্যের আপিল বোর্ড রায়টি দেবেন। যার প্রত্যাশায় সেই গত ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা অপেক্ষা করছি।

মনে নানা সংশয়। বিজ্ঞ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চেয়েছি, কি হতে পারে আপিলের রায়ে। অধিকাংশের মত ছিলো ৫ ফেব্রুয়ারির রায়ই অপরিবর্তিত থাকবে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বাড়িয়ে ফাঁসির রায় সাধারণত আপিলে হয় না।

তারপরও হৃদয়ের গভীরে প্রবল প্রত্যাশা, `মিরপুরের কসাই` কাদের মোল্লার ফাঁসি যেন হয়। সকাল সাড়ে সাতটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা অভিমুখে রওনা হয়েছি। ন’টার মধ্যে পৌঁছুতে হবে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাসে। ড্রাইভার মমিনকে বার বার তাগাদা দিচ্ছি আরো দ্রুত গাড়ি চালাতে। পথের যানজট বার বার গতি শ্লথ করে দিচ্ছে।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান সমন্বয়ক জানিয়েছিলেন, ঠিক ন’টায় আপিল বোর্ড রায় দেবে। ন’টায় পৌঁছুতে পারিনি। অনেকটা দৌড়ে যখন দোতলায় সুপ্রিমকোর্টের এজলাসে প্রবেশ করতে পারলাম, তখন ন’টা পনের বেজে গেছে। পেছনের দিকেই বসলাম। বিশাল আকারের এজলাস। কালো গাউনে আচ্ছাদিত আইনজীবীরা ঠাসাঠাসি করে বসেছেন। সাংবাদিকরা আছেন।

মন আনন্দে ভরে উঠলো এই দেখে যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালের স্পর্ধিত মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামা বসেছেন কাছেই। সে সময়ে মিরপুরের মামা বাহিনীর অধিনায়ক শহীদুল হক কালের সাক্ষী হয়ে আছেন। নরঘাতক কসাই কাদের মোল্লার নৃশংস হত্যাযজ্ঞের জীবন্ত সাক্ষী হয়ে আছেন। আমরা অপেক্ষা করছি। মহামান্য বিচারকদের আসনের পেছনের দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। কখন সেগুলো খুলে যাবে।
JU-VC
একটু কাছে দু’জন বিদেশিনীকে দেখলাম। তাদের দৃষ্টিও সম্মুখপানে। ন’টা বেজে ছত্রিশ মিনিট। আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ হলো। দরজাগুলো খুলে গেলো। মান্যবর প্রধান বিচারপতি, আরো চারজন বিচারককে নিয়ে আসন গ্রহণ করলেন। পিনপতন নীরবতা চারদিকে। সরকার পক্ষ ও আসামি পক্ষের কয়েকজন আইনজীবী উঠে দাঁড়ালেন। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কি কথা হলো তা ঠিক বোঝা গেল না। কারণ মাইক্রোফোনের লালবাতি তখনো জ্বলেনি। দ্রুতই তাঁদের কথোপকথন শেষ হলো। প্রধান বিচারপতি তাঁর সহযোগী বিচারপতিদের দিকে এক নজর তাকালেন, মাইক্রোফোনের বোতামে চাপ দিলেন। লালবাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে ফেললাম, আমরা পেতে যাচ্ছি একটি ঐতিহাসিক রায়।

ইংরেজিতে আপিলের যে রায়টি তিনি পড়ে শোনালেন তার জন্য সময় নিলেন মাত্র কয়েক মিনিট। ৪২ বছরের অপেক্ষার সব মিনিটের সমান ছিল সেই ক’টি মিনিট। পুরো আদালতে উপস্থিত সবাই আমরা রায়টি শুনলাম। রায়ের বাংলা করলে যা দাঁড়ায় তাহলো: আসামি পক্ষের আপিল খারিজ করা হলো।

প্রধান বিচারপতি সরকার পক্ষের আপিলের জবাব এক এক করে উচ্চারণ করলেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-২ এর দেওয়া কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের রায় অপরিবর্তিত রাখার সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। তারপর এলো সেই  কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ। ৪:১ বিভক্ত রায়ে ৬ নং অভিযোগ, মিরপুরের ১২ নং সেকশনের হযরত আলী লস্কর, তার স্ত্রী, দুই কন্যা এবং দুই বছরের এক ছেলে হত্যা ও অপর এক কন্যাকে ধর্ষণের দায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির কথা উচ্চারিত হলো। লক্ষ্য করলাম, নীরব চাঞ্চল্য চারদিকে। সবাই বাইরে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছিলেন। আমিও বেরিয়ে এলাম।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখন মন ছিলো বিষন্ন। এক গভীর হতাশা এবং হাহাকারের ছাপ ছিলো অবয়বে। আর আজ ভেতর থেকেই এক আনন্দ আমাকে আপ্লুত করছে। এখন আমি হাইকোর্টের দোতলার ব্রিজে। সেখানে অপেক্ষায় আছে অনেকগুলো টিভি চ্যানেলের উৎসুক সাংবাদিক।

অজান্তেই আমার হাত উত্তোলিত হলো, বিজয় চিহ্ন দেখালাম। মনের আয়নায় ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখের চিত্রগুলো এক এক করে ভেসে উঠতে থাকলো। সেদিন কসাই কাদের মোল্লা বিজয় চিহ্ন দেখিয়েছিলো। আর আমি বিষণ্ন মুখে বলেছিলাম, এই রায় মেনে নেয়া যায় না।

শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দৃশ্যপটগুলো এক এক করে ভেসে উঠলো। অল্প ক`জন তরুণ-তরুণী অসাধ্য সাধনে নেমে পড়েছিলো। শাহবাগ চত্বরে রচিত হয়েছিলো এক মহাকাব্য। কয়েকদিনের মাথায় কয়েকজন পরিণত হয়েছিলো কয়েক লক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণের সৃষ্টি করেছিলো নতুন প্রজন্ম।

“ধিক্কারে, ঘৃণায়, ক্ষোভে কখনো যেও না বনবাসে”- ১৯৭২ সালে কবি শামসুর রাহমানের সেই অমর পংক্তি যেনো উচ্চারিত হলো আমাদের নতুন প্রজন্মের মুখে। মনে পড়তে থাকলো সেই উজ্জ্বল মুখগুলোর কথা। যারা উচ্চারণ করেছিলো সেইসব স্লোগান:-- ‘ক’ তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।

বাংলা ভাষার বর্ণগুলো কি দারুণ শক্তিমান হয়ে রাজাকার - যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে এক একটি অগ্নিগোলক হয়ে নিক্ষিপ্ত হতে থাকলো। মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর নতুন প্রজন্মের মুখে আমরা শুনলাম একাত্তরের রণধ্বনি ‘জয়বাংলা’। মনে পড়লো এই ``জয়বাংলা`` রণধ্বনি উচ্চারণ করেই তো আমরা মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুনিধনে এগিয়ে গিয়েছিলাম।

শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছি। পাকিস্তানের মেশিনগানকে স্তব্ধ করে দিয়েছি। সেই ‘জয়বাংলা’কে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। জয়বাংলা শুধু উচ্চারিত হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মুখে, এমন কি দেশের প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিতরাও ``জয়বাংলা`` ধ্বনি উচ্চারণে আড়ষ্ট রইলেন। এক জগদ্দল পাথর আমাদের বুকের উপর চাপা ছিলো। নতুন প্রজন্ম ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারণ করে সেই পাথর অপসারণ করেছে। গণজাগরণ মঞ্চের উদ্দীপ্ত ঘোষণা---- কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ দিতে হবে। জাতীয় সংসদে আইন পরিবর্তন করতে হবে। তাই হলো। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দ্বিধাহীন চিত্তে সংসদে বিল পাসের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটি নিলেন। তারই সূত্র ধরে কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলো। উভয়পক্ষের দীর্ঘ শুনানি এবং বিজ্ঞ আমিকাস কিউরিদের অভিমত শোনা হলো।

তারপরও দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সুপ্রিমকোর্টের অবকাশও এক সময় শেষ হলো। আমরা রায় পেলাম। আমার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হচ্ছিলো। বললাম, জীবনে গভীর আনন্দের দিন আজ। শুধু আমার জীবনে নয় মিরপুরের আলোকদী (আলব্দী) গ্রামের গণহত্যার স্মৃতি নিয়ে যারা এখনো বেঁচে আছেন, কবি মেহেরুন্নেসার বেঁচে থাকা পরিবারের সদস্য কিংবা শহীদ সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবের কন্যা, যারা ৪২ বছর ধরে কাদের মোল্লার হত্যাযজ্ঞ, অপমান, লাঞ্ছনার প্রতিকার চেয়ে অপেক্ষা করেছিলেন, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদের পরিবার এবং সর্বোপরি জেগে ওঠা নতুন প্রজন্ম তাদের সবার জীবনেই আজ এক গভীর আনন্দের দিন।

বলেছি, এই তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় বাংলাদেশের বিজয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিজয় এবং সর্বোপরি নতুন প্রজন্ম ও গণজাগরণের বিজয়। এ বিজয় শাহবাগ চত্বরে জেগে ওঠা নতুন প্রজন্ম - যারা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধকে সম্পূর্ণ করবার মহাভার নিজেদের স্কন্ধে তুলে নিয়েছিলো তাদের।

তাদের সূচিত সেই মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় আজ অর্জিত হলো। এ বিজয়ের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। এ বিজয়ের হাত ধরে নতুন প্রজন্মকে পাড়ি দিতে হবে আরো দুরূহ সংগ্রামের পথ। আমরা যারা ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং বিজয় অর্জন করে স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি তারা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সৈনিকদের এই বিজয়ে সবিশেষ আনন্দিত।

তোমাদের নেতৃত্বে আমরা চলতে চাই। জানি, নানা কারণে বর্তমান সরকারের প্রতি তোমরা ক্ষুব্ধ হয়েছ, মুখও ফিরিয়ে নিয়েছ। তোমাদের প্রতি আকুল আবেদন করছি দেশের মহাসংকটে তোমরা ঐক্যবদ্ধ হও। এক ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তির এই ঐক্য আজ বড় জরুরি। কাতারবন্দি হয়েছে জামায়াত, হেফাজত ও বিএনপিসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। নির্বাচনে জয়ী হলে মুক্তিযুদ্ধের সব মহান অর্জনকে আবার তারা ভুলুণ্ঠিত করবে। অগ্রসরমান বাংলাদেশ আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। এদের বিরুদ্ধে এক বৃহত্তর ঐক্যে সামিল হও। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে দেশের অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, মানবিক শক্তি এক হও। এই শক্তিই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। সামনের জাতীয় নির্বাচনকে দেখতে হবে একাত্তরের রণাঙ্গন হিসেবে। এই রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে জয়ী হতে হবে। আর সে জয়ের মধ্য দিয়ে নতুন-প্রজন্ম-সূচিত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে যাবে পূর্ণতার দিকে।

অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন: উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৩/আপডেট ১৬৫০ ঘণ্টা
জেডএম/জিসিপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।