একসময় ফুটপাতে উন্মুক্তভাবে পত্রিকা নিয়ে বসতেন সংবাদপত্র বিক্রেতারা। একটা মাঝারি আকারের চৌকির মধ্যে পত্রিকা সাজিয়ে রাখা হতো।
চৌকি জুড়ে সাজানো থাকতো সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকা। দৈনিক পত্রিকা থাকতো বিক্রেতার হাতের নাগালে। বৃষ্টি, তাপদাহে ওই দোকানের সামনে পাঠকের লাইন লেগে থাকতো। যতোজন পত্রিকা কিনতেন সারাদিনে তার কয়েকগুণ ছিল পড়ুয়া। পত্রিকার এই দোকানগুলোকে আমি জনপ্রিয় পাঠাগারের তালিকায় রাখতে চাই। বেশিরভাগ বিক্রেতাই পাঠকদের মনখুশি মতো পত্রিকা পড়তে দিতেন। অনেক পড়ুয়াই ওখানে দাড়িঁয়েই এক সপ্তাহের পত্রিকা পড়ে ফেলতেন। পড়ার ছলে পত্রিকা হাপিস করে দেবার ঘটনাও ঘটতো। ধীরে ধীরে বিক্রেতারা কঠোর হতে শুরু করেন। প্রথমে ক্লিপ দিয়ে পত্রিকা আটকানো, পরে পত্রিকাকে পলিথিনের প্যাকেট বন্দি করে ফেলা। ধীরে ধীরে সেই পত্রিকা বিক্রেতারা ফুটপাত ছেড়ে অনেকেই দোকানে গিয়ে ঢুকে পড়লেন। ফলে লাইন ধরে পত্রিকা পড়ার সেই দৃশ্য এখন প্রায় বিলুপ্ত।
ক্লাস ফাইভ থেকেই আমি ফুটপাতের সংবাদপত্রের দোকানের নিয়মিত পড়ুয়া ছিলাম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরির দেখা পাবার পরেও। কারণ, কতো বিচিত্র ধরনের পত্রিকা প্রকাশ পায়, সেটা পত্রিকার স্টলে না গেলে জানা যেতো না। কোন পত্রিকার সম্পাদক কে, তা জানার একটা কৌতুহল তখন ছিল, এখনো আছে। সেজন্য প্রায় সব পত্রিকাই উল্টে-পাল্টে দেখতাম। রাজনীতি, অর্থনীতি, সিনেমা বিষয়ক পত্রিকার পাশপাশি ১৯৯০ এর পর থেকে প্রচুর পর্নো ঘরানার পত্রিকা বের হতে থাকে। অশ্লীল ছবি আর চটকদার শিরোনাম দিয়ে বের হতো পত্রিকাগুলো। বেশিরভাগ পত্রিকাই প্রকাশ্যে বিক্রি হতো। কোন কোনটি বিক্রেতারা অন্য পত্রিকার আড়ালে রেখে দিতেন। বয়সের বিবেচনায় দুই-একটি ওই ঘরানার পত্রিকা বিক্রেতারা আমার হাতেও তুলে দিতেন।
একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো, তাহলো এসব পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে নারীর’র নাম ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে সাংবাদিকতা’র শুরুর দিকে ওইসব পত্রিকা’র ঠিকানায় গিয়ে দেখেছি, ওই পত্রিকাগুলোর কোনটিই নারীরা চালাচ্ছেন না। বেশির ভাগেরই ঠিকানা ভুল। এই জাতীয় পত্রিকা অবাধে বের হয়েছে যখন নব্বই’র দশকে পত্রিকার বিস্ফোরণ ঘটেছে এ দেশে। ধীরে ধীরে ওই পত্রিকাগুলো বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। দুই-একটি হয়তো এখনো প্রকাশ হয়ে থাকতে পারে। আমাদের অনলাইন পত্রিকার বিস্ফোরণটিও ঠিক তেমনি। প্রতিদিন নতুন নতুন অনলাইন পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটছে। এসব অনলাইন পত্রিকাগুলোও দুষ্ট হয়ে পড়ছে অশ্লীলতার দোষে।
অশ্লীলতা নির্ভর এই অনলাইন পত্রিকাগুলোর লিঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও। এসব অনলাইন পত্রিকাগুলো মূলধারা’র পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। অনলাইনের নিয়মিত পাঠকদের কাছে এই পত্রিকাগুলো অপরিচিত। পাঠক আকৃষ্ট করতে তারা প্রতিদিনই কোন না কোন স্ক্যান্ডাল বা যৌনতা নির্ভর খবর প্রকাশ করছে। ঘটনা’র সত্য-অসত্য যাচাই করা নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। তবে মূল বিষয় হলো প্রায় সব খবরই প্রকাশিত হয় বিকৃত হয়ে। ছবিরও বিকৃতি ঘটানো হয় অনেক ক্ষেত্রে।
স্বাভাবিক ভাবেই যৌনতা বিষয়ক খবরের প্রতি মানুষের এক প্রকার নিষিদ্ধ মোহ থাকে। চটকদার শিরোনাম যখন ফেসবুকে লিঙ্ক হিসেবে দেয়া হয়, তখন অনেক পাঠকই ওই খবরগুলো ভেতরে যাবার চেষ্টা করেন। দেখা গেছে বেশির ভাগ এই জাতীয় অনলাইন পত্রিকাও মিথ্যে ঠিকানা ও নাম দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে। সমস্যা হলো ফেসবুক কোন একটি নির্দিষ্ট বয়সীর সাইটে সীমিত নয় এখন।
ক্লাস থ্রি’র শিশুটিও ফেসবুকে উঁকি দিচ্ছে। তাদের সামনে যখন এমন লিঙ্ক উন্মুক্ত হয়ে পড়ে তখন এ জাতীয় খবর ও ছবি তাদের কাছেও সহজলভ্য হয়ে পড়ে। এতো গেল একটি দিক। অপর দিকটি হচ্ছে-বাংলা ভাষাভাষী খবরের ভোক্তারা যখন কাগজে পত্রিকার বদলে, অনলাইন পত্রিকার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন ক্রমশ:, তখন অনলাইন পত্রিকা’র আস্থা ও দায়িত্বশীলতা অনিবার্য হয়ে উঠছে। অনলাইন পত্রিকা’র বিস্ফোরণ ইতিবাচক। জেলাভিত্তিক একাধিক অনলাইন পত্রিকা’র আত্মপ্রকাশকেও স্বাগত জানাচ্ছেন পাঠকরা।
কারণ প্রবাসে বসেও একজন পাঠক তার জেলার খবরটি দ্রুত পেয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় অনলাইন পত্রিকা থেকে। জাতীয়ভাবে দুই-তিনটি অনলাইন পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তায় সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণকে ডিঙিয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে অনেক ব্যবসায়ী গ্রুপ এই মাধ্যমটিতে বড় ধরনের বিনিয়োগেরও পরিকল্পনা করছে। সব মিলিয়ে অনলাইন পত্রিকার বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। এই অবস্থাতেও বলতে হয়, অনলাইন বিষয়ে সামাজিক শিক্ষাটি এখনো অ,আ’র পর্যায়ে রয়েছে। তাই অনলাইন পত্রিকা’ গুলো’র অশ্লীলতার দিকে ঝুঁকে পড়াকে রোধ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে পর্নোসাইটের বিকল্প জায়গা যেনো না হয়ে উঠে অনলাইন নামধারী এসব পত্রিকা। এই দায়িত্বটি অনলাইনের মূলধারার পত্রিকার কর্মী ও পাঠকদের যেমন তেমনি সরকারেরও।
অনলাইন পত্রিকার যে আইনটি’র কথা ভাবা হচ্ছে, সেখানে যেনো এই প্রকারের অনলাইন পত্রিকাগুলোকে ছেঁকে ফেলা যায়, সেই উপায়টি রাখতে হবে। না হলে অনলাইন পত্রিকার বৃহস্পতিতে শনি ছায়া পড়তে হবে। অতএব সচেতনতা এখন থেকেই।
তুষার আবদুল্লাহ: বার্তা প্রধান, সময় টেলিভিশন
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৩
এডিএ/জেডএম/জিসিপি