বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে। সিডর-আইলার ভয়াবহতা আমাদের চিন্তার সীমাকেও ছাড়িয়ে যেত, যদি এই সুন্দরবন নিজেকে উজাড় না করে দিয়ে আমাদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হত।
সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে হতে যাচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটা আয়তনে (১৮৩৪ একর) প্রায় তিনটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সমান। হিসেবের মারপ্যাঁচে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে সুন্দরবন থেকে ‘নিরাপদ’ দূরত্বে দেখানো হচ্ছে। আর এ কেন্দ্র চালাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ১৩ হাজার টন কয়লা পরিবহনের নৌরুট ঠিক করা হয়েছে পশুর নদে, যা সুন্দরবনের গভীরতম অংশের ভেতর দিয়েই প্রবাহিত। বিশাল সব জাহাজ চলাচলের শব্দ, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়া কয়লার ভাঙা টুকরা, বর্জ্য আর সার্চলাইটের তীব্র আলোয় শুরু হবে সুন্দরবনের দূষণ।
এরপর পশুর নদীর পানি ব্যবহার, কয়লা মজুদ ও খালাসের জন্য নদীটির পাড় ঘেঁষে তৈরি অবকাঠামো এবং নদী থেকে মাত্র ১২০ মিটার দূরে বিশালাকার ছাইয়ের পুকুর থেকে ছড়ানো আর্সেনিক, পারদ, সীসা, নিকেল, রেডিয়ামসহ নানা বিষাক্ত উপাদান, প্রতিদিন ১৪২ টন সালফার ডাই অক্সাইড ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এর উদগিরণ আর বিপুল পরিমাণ উড়ন্ত ছাই ছড়িয়ে পড়বে বন জুড়ে। আর এই দূষণের প্রথম শিকার হবে সুন্দরবনের পানি প্রবাহের অন্যতম উৎস পশুর নদী। অথচ পশুর নদীসহ চারদিকে যে সব জলাধার রয়েছে সেগুলো সুন্দরবনের প্রাণ-ভোমরা। এর যে কোন একটির ক্ষতি মানে সুন্দরবনেরই ক্ষতি! বাস্তবিক অর্থে সুন্দরবনকে তার সামগ্রিক প্রতিবেশগত ব্যবস্থা থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করে দেখার অবকাশ নেই। তাই রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবন থেকে কত দূরে অবস্থিত, সেই প্রশ্ন এখানে মোটেই আর প্রাসঙ্গিক থাকে না।
এছাড়া এই পশুর নদ এবং এর সংলগ্ন মেদারা ও চিংকুরা নদীর মোহনায় ইলিশ, পারশে, ভেটকী, তাপসী, তুলারডাণ্ডীসহ যে ১২০ রকম প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়, সবই ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাবে। এতে এই অঞ্চলের দরিদ্র মৎস্যজীবীদেরও জীবিকা নির্বাহের আর কোন উপায় থাকবে না। ইরাবতী ডলফিনের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার শঙ্কা বাদ দিলেও সুন্দরবনের প্রাণ-ভোমরা এই সীবশা-পশুর নদ ব্যবস্থার চরমতম দূষণের মাধ্যমে সুন্দরবনের আসন্ন ধ্বংস সুনিশ্চিত। ইতোমধ্যেই যারা জমি অধিগ্রহণের পর সামান্য অর্থ পেয়েছেন, তা ঋণ পরিশোধে ব্যয় করে ফেলেছেন। সব কিছু হারিয়ে তারা হয়েছেন বাস্তুভিটাচ্যূত, ছড়িয়ে পড়ছেন নতুন জীবিকার সন্ধানে। এই সব বাস্তবতা ও মানবিক বিপর্যয়কেও অস্বীকার করা যাবে না কোনভাবেই।
এই প্রকল্পটি বানিজ্যিক দিক থেকেও খুব সফল হবে তা বলা যায় না। যতই বলা হোক উন্নত মানের কয়লা আমদানি করা হবে, কিন্তু বিদেশ থেকে লাইটারেজের মাধ্যমে পরিবহন করে বন্দরে আনতে গেলে, এর পরিবহন খরচ হবে অনেক বেশি। তাছাড়া এ প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লার প্রাপ্যতা, দাম ও পরিবহন খরচের উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেওয়া যায় না।
আবার রামপাল প্রকল্পে ভারতের কোম্পানি এনটিপিসি মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োগে সমান (৫০%) অংশীদারিত্ব পাচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ ও প্রতিবেশগত বিপর্যয়ের বোঝা টানবে মূলত: বাংলাদেশ। আশ্চর্যের ব্যপার হচ্ছে ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ‘তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সংক্রান্ত গাইডলাইন–আগস্ট ২০১০’ অনুসারে কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং জীব বৈচিত্র্য সম্পন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিষিদ্ধ। অথচ বাংলাদেশে রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতীয় কোম্পানি নিজ দেশের আইন ভঙ্গ করছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে এ ধরনের কোন আইন না থাকায় ভারতীয় কোম্পানি বাংলাদেশের কোন আইন ভঙ্গ না করার দাবি করতে পারে। কিন্তু সুন্দরবনের মত এই বিশ্বসম্পদ সংরক্ষণের দায় শুধু বাংলাদেশের নয়, এই দায়িত্ব যে ভারতেরও, তা এই ভারতীয় কোম্পানি সুস্পষ্টভাবেই উপেক্ষা করছে।
এমনকি এ প্রকল্পের মারাত্মক দূষণের শংকাকে ‘সুপার ক্রিটিকাল’ প্রযুক্তি ব্যবহারের দোহাই দিয়ে খারিজ করে দেয়ার চেষ্টা চলছে। যদি ‘সুপার ক্রিটিকাল’ প্রযুক্তি ব্যবহার করাও হয়, তবে দূষণ কমবে মাত্র ১০ ভাগ। এ ধরনের প্রকল্পের শুরুতে সাধারণত দূষণ রোধে নানান ধরনের আশ্বাস দেওয়া হলেও পরবর্তীতে তা বাস্তবায়িত হয় না, আর তা হলেও প্রযুক্তির উচ্চব্যয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আর সুলভ থাকে না। তাছাড়া ‘সুপার ক্রিটিকাল’ প্রযুক্তি দিয়ে যদি দূষণের মাত্রা কমানোই যায়, তাহলে ভারত তার বনসীমার ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করলো কেন?
অন্যদিকে রামপাল প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য কাজ নিয়ম বহির্ভূতভাবে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অবস্থান সংক্রান্ত ছাড়পত্র প্রাপ্তি, পরিবেশগত সমীক্ষা দলিল (ইআইএ) প্রকাশের পূর্বেই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। কাজ শুরুর প্রায় ২ বছর পর যে ইআইএ প্রকাশ করা হয়েছে তাতে ‘যদি-তবে’, ‘হয়তোবা হবে’, ‘আশা করা যায়’- এ জাতীয় ওজনহীন ও বায়বীয় কথাবার্তার মাধ্যমে সুন্দরবন সুরক্ষার দিকটি উপেক্ষা করা হয়েছে। এর উপর অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে উপস্থিত বিশেষজ্ঞ-সচেতন মহলের সবাই একযোগে ইআইএ বাতিলের দাবি জানালেও অতি সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কেউ কেউ আবার বলেন যে, এই প্রকল্প দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্ম সংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এতে সুন্দরবনের উপর চাপ কমবে এবং এটি বেদখলের হাত থেকে বাঁচবে। তবে এ চিন্তার বিপরীতে দু’টি প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করা খুব জরুরি। প্রথমটি হল– ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত, একই রকম যুক্তিতে সুন্দরবনকে রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নামে বননির্ভর দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট আইপ্যাক(২০১০-২০১৩), সুন্দরবনের পরিবেশগত নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সংক্রান্ত (২০১০-২০১৪) প্রকল্পসহ কমপক্ষে ১০টি প্রকল্প সরকার বাস্তবায়ন করছে। তাহলে সুন্দরবন রক্ষায় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সেগুলোর কার্যকারিতা কী? এগুলোর অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র মানুষের জীবিকার ব্যবস্থার জন্য বিদ্যুৎ প্রকল্পটি রামপালে এবং সুন্দরবনের এত কাছে, এত জরুরি হয়ে পড়ল কেন?
উপরন্তু, ২০১১ সালে বাংলাদেশ-ভারত সুন্দরবন রক্ষায় যৌথ স্মারক সমঝোতাসহ বাঘ সংরক্ষণের নামে যে প্রটোকল স্বাক্ষর করেছে, সেগুলোর বাস্তব প্রয়োগই বা কী? দ্বিতীয়টি হল, সুন্দরবনের অবৈধ দখল নেওয়ার ক্ষমতা কী কখনো বন-নির্ভরদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ছিল? বনের জমি বেদখল হয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রতাপশালী ব্যক্তিদের দ্বারা, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ প্রশাসনিক ছত্রচ্ছায়ায়। সুন্দরবন কিংবা অন্য যে কোন বনাঞ্চল দখল করা এসব দরিদ্র মানুষের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়।
আবার যারা এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করছেন, তাদেরকে বলা হচ্ছে উন্নয়ন বিরোধী। তারা নাকি বিকল্প জ্বালানির উৎসের সন্ধান না দিয়ে পরিবেশকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে পরিবেশ/প্রকৃতি এবং উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে উন্নয়ন পরিবেশকে উপেক্ষা করে, তার শিকড় হয়ে পড়ে দুর্বল ও ব্যধিগ্রস্ত। সেই উন্নয়ন কখনো টেকসই হয় না, তার পতন অনিবার্য।
আবার রামপাল প্রকল্প নিয়ে আলোচনায় সরকারিভাবে মধ্যমপন্থা অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। এখানে স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে, দেশের অন্য কোন জায়গায় কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে দূষণের মাত্রা কমিয়ে কিভাবে তা জন-পরিবেশ বান্ধব করা যায় সে ব্যাপারে মধ্যমপন্থা গ্রহণকরা যেতে পারে। কিন্তু সুন্দরবনের গুরুত্ব বিবেচনায় এ ব্যাপারে সর্বাবস্থায় এই বিশ্ব সম্পদের পক্ষাবলম্বনের কোন বিকল্প নেই।
প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে, কিন্তু আমাদের সুন্দরবন একটাই। তাই ঝড়-ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছাসে আগলে রাখুক বাংলাদেশকে। তাই আমরা আশা করি ভারত ও বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন সুরক্ষার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। রামপাল প্রকল্প অবিলম্বে বন্ধ করে বাঁচিয়ে রাখবে সুন্দরবন। কোন কৃত্রিম বন সুন্দরবনের পরিপূর়ক হতে পারে না।
লেখক: বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী, গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি