ঢাকা: ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকদের চলতি দফার আন্দোলন গড়ালো পঞ্চম দিনে। ৩ হাজার টাকা থেকে ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকায় উন্নীত করার দাবিতে শ্রমিকরা এখন কারখানা ছেড়ে রাস্তায়।
শ্রমিক অসন্তোষের কারণে গত পাঁচ দিনে কমপক্ষে চারশ’ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি করছেন মালিকরা।
ন্যায্য দাবিতে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসলেও, শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে দেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের চক্রান্ত হচ্ছে বলেও মনে করছেন অনেকেই।
সোমবার রাতে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেও অচলাবস্থার নিরসন করতে ব্যর্থ হন নৌপরিবহন মন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খান।
এ পরিস্থিতিতে দেশের সচেতন প্রত্যেক নাগরিকের মনেই এই প্রশ্ন, কোন পথে দেশের গার্মেন্টস খাত?
চলমান শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপারে অনেকেরই ধারণা, দেশের প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার পোশাক রফতানির বাজার কবজা করতেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে চক্রান্তকারীরা। চলমান শ্রমিক অসন্তোষকে নিজ স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার করছে তারা। পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী দেশেরও এতে ইন্ধন থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের গার্মেন্টস অস্থিরতাকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রচারকেও মনে করা হচ্ছে উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
আবার মজুরি বৃদ্ধির দাবিকে ন্যায্য মনে করে অনেকেই শ্রমিকদের এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটাতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বর্তমান বেতন যে একেবারেই অপ্রতুল, সেটাও মিথ্যে নয়।
এ পরিস্থিতিতে সরকার পড়েছে বেকায়দায়। তাদের অবস্থা হয়েছে ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’। একদিকে দেশের গার্মেন্টস মালিকদের প্রভাবশালী সংগঠন বিজিএমইএ ক্ষুব্ধ হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারছে না, অপরদিকে শ্রমিকরাও সন্তুষ্ট হয়ে আবার কারখানায় ফিরে যায় এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গলদঘর্ম হচ্ছেন সরকারের কর্তারা। তার ওপর সরকার পক্ষে মধ্যস্থতাকারী নৌ মন্ত্রী শাজাহান খান আবার নিজেই একজন প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা।
শাজাহান খান সরকার দলীয় শ্রমিক সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের সহসভাপতি, আবার সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের প্রভাবশালী সংগঠন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনেরও তিনি কার্য্যকরী সভাপতি।
এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের সমস্যাসঙ্কুল গার্মেন্টস খাতের চলতি পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউই।
এদিকে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের এ অচলাবস্থা শিরোনামে স্থান করে নিয়েছে বিশ্ব মিডিয়ার প্রথম পাতায়। বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ বাণিজ্য বিষয়ক পত্রিকা ব্লুমবার্গে পোশাক শিল্পের চলমান অস্থিরতা নিয়ে ছাপা হয়েছে ধারাবাহিক প্রতিবেদন। এছাড়া প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে হাফিংটন পোস্টসহ অন্যান্য পত্রিকাতেও।
মূলত সব প্রতিবেদনেই তুলে ধরা হয়েছে মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের রাজপথে নেমে আসার বিষয়টিই।
ব্লুমবার্গে বলা হয়, ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠে হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক রাজপথে নেমে এসেছে। আন্দোলনের মুখে ইতোমধ্যেই অনেক কারখানা বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন মালিকরা। এসব কারখানার অনেকগুলোই ওয়ালমার্টের মত ব্রান্ডগুলোর সরবরাহকারী।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী ব্লুমবার্গকে বলেন, কারখানা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে এটা আমাদের জন্য খুবই দুঃখজনক। একদিন কারখানা বন্ধ মানে, মালিকদের বিপুল অংকের ক্ষতি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ৫ মাসের মাথায় আবার মাথাচাড়া দিলো এ শ্রমিক অসন্তোষ। রানা প্লাজার ওই দুর্ঘটনায় মারা যান সহস্রাধিক পোশাক শ্রমিক।
ব্লুমবার্গে আরও বলা হয়, এশিয়ায় মিয়ানমারের পর বাংলাদেশেই পোশাক শ্রমিকদের বেতন সবচেয়ে কম। অথচ এ শ্রমিকরাই বাংলাদেশের ১৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক শিল্প রফতানির মূল চালিকাশক্তি। পাশাপাশি বিশ্বের খুচরা ক্রেতাদের কাছেও সস্তায় কাপড় সরবরাহের অন্যতম নিয়ামক তারা।
মূলত, আন্দোলনরত শ্রমিকরা মাসিক ন্যূনতম ৮ হাজার ১১৪ টাকা বা ১০৪ ডলার বেতন দাবি করছেন, যা বর্তমানে মাত্র ৩ হাজার টাকা বা ৪০ ডলারেরও কম। অবশ্য গত ১৭ সেপ্টেম্বর বৈঠকে সর্বনিম্ন মজুরি ছয়শ’ টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ছয়শ’ টাকা করার প্রস্তাব দেয় মালিক পক্ষ।
তবে বর্তমান বাস্তবতায় এ মজুরি কাঠামোকে অযৌত্তিক ও হাস্যকর হিসেবে অভিহিত করছে বাংলাদেশের শ্রমিক সংগঠনগুলো। বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের সংগঠন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার ব্লুমবার্গকে বলেন, যদি মালিকরা শ্রমিকদের জন্য সামান্য সদিচ্ছা দেখাতেন, তবে হয়তো সহিংসতা এড়ানো সম্ভব হতো। গার্মেন্টস মালিকদের প্রস্তাবকে হাস্যকর বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মাসিক গড় বেতন ৭৪ ডলার। গড়ে যা এশিয়ায় শুধুমাত্র মিয়ানমারের (৫৩ ডলার) থেকে বেশি। গত ডিসেম্বরে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অরগানাইজেশনের বার্ষিক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়।
এদিকে চলমান অস্থিরতায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে মালিক পক্ষ। ভাঙচুর ও লুটপাট প্রতিরোধে নিজেদের কারখানায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা দাবি করছেন তারা। পাশাপাশি চলমান শ্রমিক অসন্তোষের সুযোগে কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে গার্মেন্টস মালিকদের তরফে। এছাড়া শ্রমিকদের দাবি করা বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন হলে অনেক কারখানাই বন্ধ হয়ে যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন মালিকরা।
মেয়াদের ঠিক অন্তিম সময়ে এসে শ্রমিকদের আন্দোলনে বিব্রত সরকার নিজেও। পরিস্থিতি উত্তরণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। নৌমন্ত্রী শাজাহান খান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, যদি শ্রমিকরা কাজে যোগ না দেন তা হলে আমরা বুঝবো এটি ষড়যন্ত্রের অংশ। অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও হঁশিয়ারি দেন তিনি।
তবে শ্রমিকরা কাজে ফিরবেন বলে আশা করছেন নৌমন্ত্রী। এছাড়া নভেম্বরের মধ্যেই শ্রমিকদের জন্য একটি নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণেরও আশ্বাস দেন তিনি। যদিও কতখানি বেতন বাড়ানো হবে সে সম্পর্কে কোনো আভাস তিনি দেননি।
এদিকে বাংলাদেশের চলমান পোশাক শিল্পের অস্থিরতায় চাপের মুখে রয়েছে আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ব্রান্ডগুলোও। ইতোমধ্যেই শ্রমিকদের বেতন ভাতা বৃদ্ধির যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হেনস অ্যান্ড মরিতজ এবি (এইচঅ্যান্ডএমবি)।
এইচঅ্যান্ডএম এর মুখপাত্র অ্যান্দ্রেসা রু বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবিকে সমর্থন জানাই। এক ইমেইল বার্তায় তিনি বলেন, বাংলাদেশ এইচঅ্যান্ডএম’র গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী। টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির ন্যূনতম বেতন কাঠামো বৃদ্ধি করার পাশাপাশি প্রতি বছরই এই বেতন পর্যালোচনা করতে আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
এছাড়া পৃথক ই-মেইল বার্তায় শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅলের সাধারণ সম্পাদক জার্কি রেইনা।
এ পরিস্থিতিতে এখন দেখার বিষয় কোন পথে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত।
বাংলাদেশ সময়: ০৩০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৩
আরআই/আরআইএস